সোশাল মিডিয়া ও বুলিইং ঃ কেন আমি ইন্টারনেট মেমে তীব্রভাবে অপছন্দ করি? StopCyberBullying

(অরিজিনাল লেখাটা ফেসবুকে নোট এবং বিভিন্নবার বিভিন্ন স্ট্যাটাস আকারে আগে দিয়েছিলাম। সেখানে থেকে এক বন্ধুর রিকুয়েস্টে কিছুটা পরিমার্জনা , সংযোজন এবং বিয়োজন করে সরবে তুলে ধরছি।)

আমার নিরস এবং আকাইম্মা সিরিয়াস হিসাবে দুর্নাম বেশ ভালো :brokenheart: । কেনো এইটা এই লেখা পড়লেই বুঝা যাবে :love: ।

একটা সাধারন রুল হিসাবে আমি জীবিত মানুষের ছবি নিয়ে ইন্টারনেটে মেমে বানায়ে ছাড়াটা অপছন্দ করি, বিশেষত সেই ধরনের মেমে যেগুলোর টোন আমার কাছে মজার চাইতে অপমানসূচক এবং বেশি ব্যক্তিগত মনে হয়। আমি আগে মেমে শেয়ার অথবা পোষ্ট যদি কিছুটা করেও থাকতাম – বেশ কিছুদিন হলো সেগুলো করা বন্ধ করে দিয়েছি। এর কারন বয়স বাড়ার সাথে সাথে আমি বুঝতে পেরেছি যে বেশিরভাগ মেমে , যেগুলো আমাদের কাছে ফানি মনে হতে পারে – সেগুলো যাকে নিয়ে করা সেটা তার কাছে মজার নাও হতে পারে। এবং বেশিরভাগ সময়ে এই মেমে এর সাবজেক্ট যে, সে যথেস্ট আঘাত পেতে পারে।

আমরা বেশিরভাগ সময়ে বিভিন্ন তারকা – যেমন মুভি স্টার , খেলোয়াড়, বিশেষ কোনো ব্যক্তিত্ব এর দিকে তাকিয়ে মনে করি যে তাদের তারকা খ্যাতির কারনে আমাদের আলবত হক আছে তাদেরকে নিয়ে যা খুশি বলার , যেকোনো ধরনের ফান করার এবং যেভাবে হোক তাদের প্রাইভেসি লঙ্ঘন করার। এবং বেশিরভাগ সময়ে আমরা তারকাদের নিয়ে আমাদের করা “সো কলড মজা” টাকে শুধুমাত্র সেই তারকাটি পর্যন্ত সীমাবদ্ধ রাখিনা। আমরা তাদেরকে নিয়ে মজা অথবা মকারি করার সময় তাদের বৌ, গার্লফ্রেন্ড, বাপ, মা, ছেলে-মেয়ে, অথবা রিয়েল লাইফ সাধারন মানুষকে টেনে নিয়ে আসি যারা সেই তারকাখ্যাতি পাওয়া ব্যক্তিটির সাথে এসোশিয়েটেড। এবং মনে করি যে তাদেরকে টেনে নিয়ে আসাটা লজিকাল এবং মেনে নেয়া যায় যেহেতু তারা সেই তারকাটির সাথে জড়িত। কোনো একটা মানুষের সাথে জড়িত হওয়ার অপরাধে সম্পূর্ন অপ্রাসঙ্গিকভাবে কাউকে টেনে নিয়ে জড়িয়ে মজা করাটা কোনো কালেই আসলে ফেয়ার গেম ছিলো না, কিন্তু আমরা তা বেশিরভাগ সময়ে ভূলে যাই।

যত সময় যাচ্ছে আর আমরা সোশাল মিডিয়াতে যত বেশি ইনভলভড হচ্ছি, তত আসলে আমাদের “মজা” নামক বস্তুটির সেন্স আর ডেফিনিশন পাল্টায়ে যাচ্ছে – জিনিশটা আরো কুৎসিত হয়ে যাচ্ছে। আর হবে নাই বা কেনো? বাংলাদেশি মানুষজনের জীবনে বিনোদনের খোরাক কম। ঘুরার যায়গা নাই। আউটিং বলতে কোনো ফাস্টফুডের দোকানে যাওয়াটাই সবচাইতে কমন বিনোদন এর যায়গা। অথবা শপিং মল এ ঘুরাঘুরি। মুভি দেখবে কোথায়? পরিবার নিয়ে মুভি দেখতে যাওয়ার যায়গা বলতে ঢাকা শহরে মাত্র ২ টা – সাধারন সিনেমা হলগুলো আস্তে আস্তে উঠে যাচ্ছে। ভালো মুভি বলতে বাংলা সিনেমা তে কালেভদ্রে কিছু ভালো মুভি আসে। কিন্তু সুশীল মুভি বলতে আসলে যা আসে তা আসলে লম্বা নাটক বাদ দিয়ে আর কিছু না। শহরে খেলাধুলার যায়গা কোথায়? ছেলেমেয়েগুলার গ্রোথের জন্য বিকেলবেলা খেলতে দেয়াটা আজকাল শহরের দিকে রেয়ার হয়ে গেছে – কম্পিটিশন অনেক বেশি। জিপিএ ফাইভ পেতে হবে। ৪টা শিক্ষকের বাসায় যাওয়াটা ফ্যাশন না – নেসেসিটি। কারন সেখানে গেলে পড়াশুনার সাথে বন্ধুদের সাথে আরো কিছুক্ষন দেখা করা যায় – একটু বোরিং লাইফ থেকে বেরোনো।

১২ বছর আগে ক্লাস নাইনে পড়তাম। তখন সমাজ বই যতদুর মনে পড়ে বিভিন্ন অধ্যায় আর পরিচ্ছেদে ভাগ ছিলো – ঠিক মনে পড়তেসেনা। প্রথম অধ্যায়ের পঞ্চম পরিচ্ছেদ এ মনে হয় (বই অনেক চেঞ্জ হওয়ার কথা) একটা কথা পড়েছিলাম। বাংলাদেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির একটা মূল কারন হলো গ্রামাঞ্চলের দিকে বিনোদনের অভাব। পড়লেই হাসি চলে আসতো – কিন্তু এখন বুঝি কথাটা ভূল কিছু না।

ফেসবুক আসার পরে এখন এই বিনোদনকামি মানুষগুলোর একটা ভেন্টিং এর যায়গা হইসে। বিনোদন এখন সাইবার-স্পেসে। বিনোদন এর অভাবে সুস্থ চিন্তাতে ব্যঘাত ব্যপারটা যে পুরা একটা সামাজিক ব্যধিতে দাড়াইসে এটা মানুষজনের ফেসবুক গ্রুপের কাজকারবার দেখলে বুঝা যায়। আমরা বিনোদন পেতে এখন অন্যদেরকে পচাই – সাইবারস্পেসে মুখোশের আড়ালে অন্যকে ৪ টা গালি দিতে পারলে – আঙ্গুল তুলে হাসতে পারলে আমাদের শান্তি লাগে। কম্পিউটারে কিবোর্ডের আড়ালে সবাই বীরপুঙ্গব – আমরা সবাই বুকে থাবড়া দিয়ে হিরো হতে চাই। না হয়ে করবো কি? আমাদের জীবনে আর কোনো বিনোদনের যায়গা আছে?

মুরাদটাকলার মত গ্রুপে মেম্বার তেতাল্লিশ হাজারের মত। একবার মনে হয় দেখেছিলাম কারোর বিয়ের ছবি পোস্ট করে সেখানে বৌ আর বৌ এর বান্ধবিকে নিয়ে কিছু মজা করতে চাওয়া মন্তব্য এবং সেখানে দেড় থেকে দুই হাজার প্রচন্ড কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য। হন্যে হয়ে বলদ খুজছি বলে একটা গ্রুপে কি কারনে জানি একবার যোগ দিয়েছিলাম যেখানে প্রায়ই বিভিন্ন লোকজনের ফেসবুক ওয়ালে ইন্টার‍্যাকশন আসতো যেটা দেখে দেদারসে পচানি দেয়ার চেস্টা করা হতো। আমি আরো কাউন্টলেস উদাহরণ দিতে পারবো – সাকিবের বৌ বিষয়ে খবরের মন্তব্যতে অথবা বিভিন্ন আড়িপাতা গ্রুপ নিয়ে – যেখানে প্রায়ই বিনোদনের খোরাক হিসেবে টিউশনির বিভিন্ন আদিরসাত্মক গল্প শোনা যায়।

যখন মানুষজনের বিনোদনের অভাব কমে যায় তখন মানুষ অতিরিক্ত ধার্মিক হয়ে পড়ে – আল্লাহ বিল্লাহ করে অবসর সময় পার করে, অথবা পরনিন্দাচর্চা এবং নেগেটিভ কার্যকলাপে লিপ্ত হয়। বিচিত্র কারনে বাংলাদেশে দ্বিতীয় গ্রুপের সংখ্যা অনেক বেশি – চক্রবৃদ্ধিহারে বাড়ছে। কারন “পচানো” ইজ দি নিউ স্মার্টনেস। কে কত বেশি পচাতে পারে তার স্মার্টনেস এর র‍্যাঙ্কিং তত ভালো। কোনো বিচিত্র কারনে মানুষ পজেটিভ হইতে পছন্দ করেনা। কারন পজেটিভ কমেন্টে লাইক কম। কাউকে উৎসাহ দিবা? কয়টা লাইক? কাউকে অনুপ্রেরণা দিবা? কয়টা লাইক? কিন্তু তোমাকে গালি দিয়ে কেউ ২ টা পোস্ট করবে সেটাতে কিন্তু তুলনামুলকভাবে অনেক বেশি লাইক পড়বে। কিছু করার নাই – আজকাল বেশিরভাগ মানুষ এভাবেই চিন্তা করে – এটা শুধুমাত্র একটা গ্রুপের মধ্যে সীমাবদ্ধ না। সব স্তরের মানুষ – উচ্চশিক্ষিত পিএইচডি পোস্টডক মারানো মানুষ হতে শুরু করে স্বল্পশিক্ষিত / অর্ধশিক্ষিত “বন্দো হতা চায়” টাইপ মানুষ এর মধ্যে এই বিহেভিয়রটা প্রকট।

গত কয়েক সপ্তাহে আমি কিছু বাস্তব রিয়েল লাইফ উদাহরন দেখেছি যা ইন্টারনেট মেমে এবং সোশাল মিডিয়া বিহেভিয়র সম্পর্কে আমাকে যথেস্ট পরিমান চিন্তা করতে বাধ্য করেছে। ক্রিকেট ওয়ার্ল্ড কাপে বাংলাদেশ টিমের ওভারঅল পার্ফররমেন্স বেশ ভালো ছিলো, কিন্তু স্টার প্লেয়ার যেমন তামিম অথবা সাকিব ইন্ডিভিজুয়ালি খুব শাইন করতে পারেনি। আমাদের টিম নিয়ে আমাদের অনেক আশা ছিলো – মানুষ সোশাল মিডিয়াতে এনকারেজিং কথা যেমন লিখেছে, তেমনি যারা ভালো পারফর্ম করতে পারেনি তাদেরকে নিয়ে আজেবাজে কথা বলাও ছাড়েনি। কিছুটা হয়তবা এই ক্ষোভটা স্বাভাবিক বলে ধরে নেয়া যায় – কিন্তু দৃস্টিকটু লাগে যখন এই প্লেয়ারদেরকে ক্রিটিসাইজ করতে গিয়ে তাদের বৌদের অথবা বাপ মা, বৈবাহিক রিলেশনশিপ, প্রেমিকা / এক্স-প্রেমিকা এইসব আনরিলেটেড লোকজঙ্কে আজাইরাভাবে টেনে নিয়ে আসা হয়। তামিম অথবা সাকিবের বৌ, মাহমুদুল্লাহ অথবা মুশফিকের শ্বশুরবাড়ি এরা কি আসলেই প্লেয়ারদেরকে ক্রিটিসাইজ করার সময় অপমানের টার্গেট হিসাবে ফেয়ার গেম? কে জানি আমাকে একবার বলেছিলো, সাকিবের বৌ শিশির নাকি লাইভ খেলা দেখতে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে তাকে রিসেন্ট সময়গুলাতে যে পরিমান আনওয়ারেন্টেড অপমান , কৌতুহল ও কটু কথার শিকার হতে হয়েছে তার জন্য। এগুলো কি সীমার অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি না?

বাংলাদেশ টিম দেশে ফেরার পরে আমি একটা নিউজ পড়েছিলাম। যেখানে তামিম যথেস্ট ভগ্নহৃদয়ে বাংলাদেশি সমর্থক এবং ইন্টারনেট ইউজারদেরকে রিকুয়েস্ট করছেন তার পারফরম্যান্সের জন্য তার পরিবার অথবা প্রিয়জনকে নিয়ে অপমানসূচক কথা না বলতে। এই খবরটা পড়ার পরে আমি চিন্তা না করে পারিনি যে তামিম – তামিমের বৌ কে নিয়ে ছড়ানো ইন্টারনেট মেমে গুলা কি আসলেই সে দেখেছে ? সোশাল মিডিয়াতে কিছুটা হলেও চোখে পড়ার কথা, আর যদি চোখে পড়ে থাকে তাহলে কি সে বিরক্ত হয়নি? আর সেই বিরক্তিটা কি হয়তবা তার খেলাতে কিছুটা হলেও এফেক্ট ফেলাতে পারেনা? আপনি নিজেকে তার যায়গাতে চিন্তা করে দেখেন। আপনি যদি আপনার বৌ, বোন ভাই বাপ মা এদের কারো ছবি নিয়ে বিকৃত করে মেমে দেখতেন যেগুলোর টার্গেট হত আসলে আপনাকে ক্রিটিসাইজ করা – আপনার কি গায়ে লাগতো না? আপনার কি মেজাজ খারাপ হতো না? কেউ নিজে টারগেট হওয়াটা মেনে নিতে পারে, কিন্তু সবাই নিজের প্রিয়জনকে আসলে এসব ঝামেলা থেকে বাচিয়ে রাখতে চায় – আপনি, আমি অথবা যে কেউ। আপনি যদি এইরকম যায়গায় হতেন আর আপনি দেখতেন কেউ আপনাকে আঘাত করার জন্য আপনার পরিবার অথবা প্রিয়জন কে টার্গেট করছে, আপনি কি ওই লোককে চিপায় নিয়ে গিয়ে কিছু :dhisya: “কথা” বলতে চাইতেন না ?(ইফ ইউ নো হোয়াট আই মিন!!!)

আচ্ছা ঠিক আসে। বুঝলাম। আপনি বলতেসেন যে সে তো সুপারস্টার, তারে নিয়ে তো এই মজা করাই যায়! “আরে অনন্ত জলিল রে নিয়ে যদি মজাই না করি তাহলে স্মার্টনেস থাকে নাকি?” এইসব আজাইরা আর্গুমেন্ট নিয়ে প্রসিড করার আগে আমি আপনারে স্বাগতম জানাবো যে তাদের জায়গায় দাড়ায়ে আপনি তাদের দিকে যা ছুড়ে মারছেন তা সারভাইভ করার চেস্টা করেন। কিরকম লাগে।

এটা সাইবার বুলিইং ছাড়া কিছুই না। ব্যক্তিগতভাবে, আমি সাইবার বুলিইং জিনিশটা প্রচন্ড ঘৃণা করি – সাইবার বুলিইং মানুষকে কিভাবে এফেক্ট করতে পারে এটা আমার দেখা – খ্যাতিসম্পন্ন মানুষ এর ক্ষেত্রেও, আর খুব সাধারন মানুষের ক্ষেত্রেও । বাংলাদেশ আর আমেরিকা দুই যায়গাতেই। আমাদের ছোড়া অশালিন মন্তব্য অথবা প্রাইভেসির লঙ্ঘন কিভাবে আরেকজনকে মানসিকভাবে ইফেক্ট করতে পারে তা বুঝতে পারার পর এই বিষয়গুলোকে আমি ভিন্নভাবে চিন্তা করতে বাধ্য হয়েছি। মানুষজন কম্পিউটার স্ক্রিনের অপরপ্রান্তে বসে মারাত্বক বর্ণবাদি, অশালীন এবং ঘৃণ্য আচরণ করতে পারে , কারন সেখানে তাদের একটা এনোনিমিটির একটা সুযোগ থাকে। একই কথা অথবা একই আচরন গুলো একই মানুষেরা সামনাসামনি কারো মুখের উপর করতে পারেনা, কারন সেখানে মুখোশ থাকেনা এবং পরিচয়টা জানা থাকে।

তারকারাই যে খালি এইরকম সাইবার বুলিং এর শিকার হন এরকম কিন্তু না। খুব সাধারণ লোকজনও ইন্টারনেটে , সোশাল মিডিয়াতে প্রচুর পরিমান সাইবার বুলিইং এর শিকার হন , এবং বেশিরভাগ সময়ে সেইসব মানুষ দ্বারা যারা বাস্তব জীবনে তাদের পরিচিত। আপনার মাঝে মাঝেই মনে হবে যে এই “বন্ধু” কে নিয়ে একটু মজা করা যায় – কাজেই আপনি তার একটা পারিবারিক ছবি অথবা প্রিয়জনের সাথে একটা ছবি নিবেন, কিছু এডিট করে কিছু মজার কথা লিখবেন যেটা বর্ডারলাইন সূক্ষ খোচামূলক অথবা অপমানসূচক হবে এবং তা ইন্টারনেটে অথবা সোশাল মিডিয়াতে ছেড়ে দিবেন। এবং কিছুক্ষন পরেই ঘটনাটা আরো জটিল আকারে দাঁড়াবে – আপনি দেখবেন আপনার অথবা আপনার ইন্টেন্ডেড টার্গেটের খুবই স্বল্পপরিচিত লোকজন ও এসে মারাত্বক আজাইরা এবং অপমানসূচক কথা লিখে যাবে – কিছু না যেনেই যে আপনার ইন্টেন্ডেড টার্গেট কে অথবা তার সাথে আপনার সম্পর্ক কি। মুরাদটাকলা টাইপের গ্রুপগুলাতে রেগুলার এরকম হচ্ছে, এরকম রেগুলার হচ্ছে বিভিন্ন ভার্সিটিগুলোর গ্রুপে – প্রতিদিন, প্রতি ঘন্টায়। আপনি একটা পিঞ্চিং রিমার্ক একটা পরিচিত মানুষের কাছে শুনে হেসে উড়ায়ে দিতে পারবেন – কিন্তু সেই ব্যক্তি যিনি মন্তব্য করছেন তিনি যদি আপনার খুব কাছের না হন, তাহলে সেটা আপনার যথেস্ট গায়ে লাগবে। ইন্টারনেট মেমে – ছবি নিয়ে বিকৃত করে ছেড়ে দেয়াটাকে যেকোনো টার্গেট তার ব্যক্তিগত প্রাইভেসির লঙ্ঘন হিসাবে মনে করবে। আপনি বুঝবেন না – ততক্ষন পর্যন্ত আপনি বুঝবেন না যতক্ষন পর্যন্ত অন্য কেউ এটার শিকার হচ্ছে। ততখন পর্যন্ত এটা যাস্ট ফান। কিন্তু কেউ আপনার ব্যক্তিগত একটা ছবি নিয়ে বিকৃত করে পোষ্ট করুক – তখন বুঝবেন। এইটাই মনুষ্যচরিত্র। যতক্ষন পর্যন্ত নিজের সাথে না হয় ততক্ষন পর্যন্ত বোঝা যায় না।

আমি এই পয়েন্টটা নিয়ে কয়েক হাজারবার চিল্লায়ে আসছি এবং চিল্লায়ে যাবো – “আমাদের মূল সমস্যা হলো আমরা মানুষকে সম্মান দেয়া ভূলে যাচ্ছি – তারা যেই হোক না কেনো”। আমরা সোশাল মিডিয়াতে ডিল করতে করতে ভূলে যাচ্ছি যে আমরা আসলে বাস্তব কিছু মানুষের সাথে ডিল করছি। কম্পিউটারের স্ক্রিনের অপরপ্রান্তে আরেকটি মানুষ বসা যে আমার ছোড়া মন্তব্য পড়ে অথবা আমার আচরনে আঘাত পেতে পারে। আর আমরা যা করি অথবা যা বলি – তা একবার হয়ে গেলে ফিরায়ে নেয়া সম্ভব না। সাইবার বুলিইং জিনিষটা আরেকটা মানুষকে ঠিক সেইভাবে এফেক্ট করবে , যেভাবে করবে আপনাকে – যদি আপনি এর শিকার হন।

আমরা বেশিরভাগ সময়ে স্বপ্ন দেখি সমাজকে পরিবর্তনের – আমরা মনে করি একটা ঝাড়ু নিয়ে আমরা সমাজের সব আবর্জনা কে ঝেড়ে মুছে পরিস্কার করতে পারবো। স্বপ্নটা কিছুটা অবাস্তব – কোনো একটা মানুষের পক্ষে একা পুরা সমাজকে পরিবর্তন করা সম্ভব না। আপনি হাজার চিল্লায়ে, ভয় দেখায়ে পুরা সমাজকে পরিবর্তন করতে পারবেন না – কিন্তু আপনি নিজেকে পরিবর্তন করতে পারবেন। আপনি যদি সমাজকে পরিবর্তন করতে চান, আপনাকে নিজেকে আগে পরিবর্তন করতে হবে। আপনি যদি ইন্টারনেটে নিজে সাইবার বুলিইং এর শিকার হয়ে কমফর্টেবল ফিল করেন, তাহলে ভালো। বুলিইং করতে থাকেন। ছাড়তে থাকেন ইন্টারনেট মেমে, করতে থাকেন র‍্যান্ডম মুক্সুদ্দিরে নিয়ে আদিরসাত্মক জোক্স। কাউকে অপমান করার জন্য ইচ্ছামত তার পরিবারের পিছনে লাগেন ইন্টারনেটে। এতে আপনার একটা মানুষ হিসাবে আসলে দুই পয়সার ইম্প্রুভমেন্ট আসবে না এটা বলে দেয়া যায়। আর যদি সেটা আপনি নিজে শিকার হয়ে কমফর্টেবল ফিল না করেন তাহলে সেটা নিজে করা আগে থামান। পরিবর্তনের শুরুটা আপনার নিজের থেকেই আসতে হবে।

আপনি যদি নিজের সাথে সাইবার বুলিইং এ কমফর্টেবল না ফিল করেন, তাহলে শুধুমাত্র আপনার সেটা করা থেকে নিজেকে বিরত রাখাটাই যথেস্ট নয়। আপনাকে এর বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে হবে – আপনি যখন দেখবেন আপনার পরিচিত কেউ সাইবার বুলিইং এর শিকার হচ্ছে অথবা করছে – তখন তার বিরুদ্ধে কথা বলতে হবে – অন্যদের দৃস্টি আকর্ষন করে বুঝানোর চেস্টা করতে হবে এর ক্ষতিকারক দিকগুলো কি। আর এটা আসলে ব্যাপার না যে ইনটেন্ডেড সাইবার বুলিইং এর টার্গেট কি কোনো তারকা নাকি কোনো সাধারন মানুষ – আপনাকে একটা দৃড় অবস্থান নিতে হবে কারন এটা একটা অপরাধ।

কেনো? কারন মানুষ স্বাভাবিকভাবেই নিজের পারিপার্শ্বিক অবস্থা দিয়ে ইনফ্লুয়েন্সড হয়। এটা জানা কথা। যদি আপনার চারপাশে থাকা লোকজনের মেন্টালিটি বাজে হয় এবং আপনি তাদেরকে বার বার একই কাজ করতে দেখেন, (উদাহরণস্বরুপঃ ইভটিজিং) – আপনার কাছে সেটাকেই স্বাভাবিক বলে মনে হবে। মানুষ স্রোতের সাথে যেতে পছন্দ করে – মেজরিটির সাথে সুর মিলাতে পছন্দ করে। আর এধরনের নেগেটিভ পারিপার্শ্বিক আচরনের বিরুদ্ধাচারন না করা হলে আসলে একটা নিউট্রাল মানুষ বুঝেও উঠতে পারেনা যে কেনো এ আচরনটা করা উচিত নয়। সাইবার স্পেসের ক্ষেত্রেও ব্যপারটা একই রকম। সাইবারস্পেসে আপনি কাদের সাথে ইন্টার‍্যাকট করছেন, তাদের সোশাল আচরনটা কিরকম এটা দিয়ে আসলে আপনার আচরন অনেকাংশে নির্ধারিত হবে। আপনি যদি দেখেন আপনার লিস্টের সবাই কাউকে “পচায়ে” যাচ্ছে, আপনিও সেখানে “পচানি” তে অংশগ্রহন করতে প্রলুব্ধ হবেন। মুরাদটাকলা গ্রুপে যখন বিভিন্ন মানুষের প্রোফাইল এর স্ন্যাপশট নিয়ে গনমানুষের সামনে ছেড়ে দেয়া হয়, তখন এই বিহেভিয়রটা লক্ষ্যনীয় – আপনার লিস্টের কেউ গিয়ে সেখানে বাজে একটা মন্তব্য করে আসলে সেটা আপনার নিউজফিডে আসবে। এবং আপনি সেটা দেখবেন এবং ভাববেন – “আচ্ছা, সবাই পচাচ্ছে? আমিও পচাই – সবাই যেহেতু করছে, সেহেতু এটা করা টা নিশ্চই এক্সেপ্টেবল।” উদাহরনস্বরুপ কয়েকদিন আগে সৌদি প্রবাসি এক মহিলার গান নিয়ে ফেসবুকে তুমুল পচানি চলতেসিলো – মহিলাটির গান হয়তবা সুরেলা ছিলোনা। কিন্তু পুরা ভিডিওটা যারা দেখেছে তারা বুঝতে পেরেছে এরকম একটা পোস্টের পিছনে একটা প্রবাসি বাঙ্গালীর কি পরিমান আবেগ আর কস্ট কাজ করে। অথচ ভিডিওটিকে হাজারবার শেয়ার দেয়া হয়েছে শুধুমাত্র মহিলাটিকে “পচানি” দেয়ার জন্য – এবং তখন বেশিরভাগ মানুষ ভিডিওটার শেষ অংশ না দেখেই খুব সুন্দরভাবে আজেবাজে মন্তব্য করে গিয়েছে।

এই সাইবার বুলিইং আচরণের বিরুদ্ধে ঠিক ওই সময়ে কয় জনকে প্রতিবাদ করতে দেখা গিয়েছে? হাতে গোনা কিছু লোককে। যখন প্রতিবাদ করা লোকের সংখ্যা বেড়েছে , তখন আস্তে আস্তে বুলিইং এর পরিমান কমা শুরু হয়েছে – নেগেটিভ কমেন্টের স্রোত কমা শুরু হয়েছে এবং অনেকে ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করে নিজেদের আচরণের ভূলটা বুঝতে পেরেছে।

আর একারনেই সাইবার বুলিইং থেকে শুধুমাত্র নিজেকে বিরত রাখাটা যথেস্ট নয় – এটা থামাতে আপনার জোর প্রতিবাদ জরুরী। কারন আপনি যখন একটা অবস্থান নিবেন এবং কোনো আচরনের বিরুদ্ধে দাড়াবেন – তখন মনে রাখবেন, একটা ক্ষুদ্র পার্সেন্টেজ হলেও আপনার বিরুদ্ধ অবস্থান দেখে নিজের বুলিইং আচরন সম্পর্কে একবার ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করতে বাধ্য হবে। এবং এই ক্ষুদ্র পার্সেন্টেজ এর অতি ক্ষুদ্র অংশ হলেও আপনার বিরুদ্ধাচারন করা দেখে বুলিইং থামায়ে আপনার সাথে গলা মিলাবে। আপনি যতটা ইনফ্লুয়েনশিয়াল ইউজার হবেন – এই পার্সেন্টেজ তত বৃদ্ধি পাবে। আর জিনিশটা অনেকটা চেইন রিএকশনের মত – আপনি আজকে সোচ্চার দেখে আপনাকে দেখে আরো ২ জন তাদের নিজেদের আচরনকে নিয়ে চিন্তা করবে। হয়তবা তাদের মধ্যে একজন আপনার সাথে যোগ দিবে। এখন আপনারা ২ জন। রিপিট দি লুপ – ২ জন থেকে আরো ২ জন – মোট ৪ জন। রিপিট – ৮ জন। আস্তে আস্তে প্রতিবাদকারীর সংখ্যা বাড়তে থাকবে, এবং একটা পর্যায়ে দেখবেন যে প্রতিবাদকারীদের দল ভারি হয়ে গিয়েছে । এবং আপনি আসলেই একটা পার্টিকুলার সাইবার বুলিইং একটিভিটি থামাতে পারছেন।

লেখাটা অনেক বড়ো হয়ে গেলো। আমি প্রায়ই সাইবার বুলিইং এর বিরুদ্ধাচারণ করে থাকি – সেটা যেকোনো ফর্মেই হোক না কেনো। বেশিরভাগ সময়েই মনে হয় লেখাগুলো অন্ধ চোখে পড়ে – বধির কানের কাছে যেনো আমি চিল্লায়ে বেড়াই। তবুও আমি না থেমে চিল্লায়ে যাই এবং লিখতে থাকি – কেনো? কারন আমি এধরনের কিছু বাস্তব ঘটনা জানি যারা সাইবার বুলিইং এর শিকার হয়ে নিজেদের জীবন শেষ করেছে। কারো ছোটো বোন, ভাই, বান্ধবি – বন্ধু । প্রতিদিন আমেরিকা অথবা বাংলাদেশে অসংখ্য মানুষ সাইবার বুলিইং এর শিকার হয় – এবং এতে সৃস্ট মানসিক চাপে আত্মহত্যার হার দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। যখন আপনি এধরনের কোনো ঘটনা কাছে থেকে দেখবেন – আপনি বাধ্য হবেন একটা অবস্থান নিতে। আমি নিয়েছি।

আমি চিল্লাচ্ছিলাম, সাইবার বুলিইং নিয়ে চিল্লায়ে যাবো। কেউ শুনুক অথবা না শুনুক।

মাফ চাই আপনার মেমে আপনার কাছে রাখুন। আপনার কাছে ফান টা আমার কাছে সাইবার বুলিইং ছাড়া আর কিছুই না।

 

শিমন সম্পর্কে

M.S student, Colorado State University. একজন গর্বিত আইবিএ ড্রপ আউট, কিঞ্চিত ব্যর্থ সফটওয়ার ইঞ্জিনিয়ার যিনি কোডিং করার চাইতে উইকিপিডিয়া পড়তে বেশি ভালোবাসেন।
এই লেখাটি পোস্ট করা হয়েছে ইতিবাচক, চিন্তাভাবনা, বিবিধ, সচেতনতা, হাবিজাবি-এ। স্থায়ী লিংক বুকমার্ক করুন।

3 Responses to সোশাল মিডিয়া ও বুলিইং ঃ কেন আমি ইন্টারনেট মেমে তীব্রভাবে অপছন্দ করি? StopCyberBullying

  1. বোহেমিয়ান বলেছেনঃ

    আমাদের ভেতরে একই সাথে ভালো এবং খারাপ দিকগুলো আছে। অনলাইনে খারাপ দিকগুলা একটু বেশিই চলে আসে।

    বুলিইং বন্ধ হোক।
    নিজেদের আমরা প্রশ্ন করা শিখি।

    বেশ ভালো একটা ইস্যু নিয়ে আসছিস।
    আশা করি তোর পোস্ট কয়েক জনকে অন্তত উৎসাহিত করবে ভাবতে।

    সেই মহিলার ভিডিওটা নিয়ে আমাদের কুৎসিত আচরণে বেশ খারাপ লাগছিল। হিউম্যান নেচারে সম্ভবত বহুত আজেবাজে জিনিস আছে…অনেক নার্চার দরকার।

  2. জ্ঞানচোর বলেছেনঃ

    অতিব ব্যতিক্রমি বিষয়।

    কমেন্টে দেবার জন্য একটা ইমোটিকন খুঁজছিলাম। কিন্তু, কেন জানি মনে হলো, ইমোটিকনগুলো বড় বেশী মেমে মেমে লাগছে।

    তাই এমনিতেই বলছি, অসাধারণ লিখেছেন।
    আশা করি চালিয়ে যাবেন। মানুষের মাঝে চিন্তা ঢুকিয়ে দেবেন।

  3. শারমিন বলেছেনঃ

    দারুণ 🙂

বোহেমিয়ান শীর্ষক প্রকাশনায় মন্তব্য করুন জবাব বাতিল

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।