মূল লেখা: মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে কৃষকও কর্তা ছিল
লেখক: আফসান চৌধুরী (গবেষক ও সাংবাদিক)
ইতিহাস চর্চাবিদদের জন্য নানা চ্যালেঞ্জ রয়েছে। অন্যতম চ্যালেঞ্জ হলো, তারা কোন বিষয়টিকে গুরুত্ব দেবেন, কতটুকু সীমারেখা টানবেন এবং কতটুকু প্রবাহিত করবেন। জাতীয় ইতিহাস চর্চার ক্ষেত্রে এ চ্যালেঞ্জ আরো বেশি। আমরা ইতিহাস মূলত দেখি কয়েকটি মুহূর্ত, কয়েকটি ঘটনা এবং কয়েকজন ব্যক্তির মাধ্যমে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে আমরা খণ্ডিতভাবে ইতিহাসকে দেখি। সেটা না দেখলে জাতীয়তাবাদের ইতিহাস চর্চা ব্যাহত হয় বটে। সে কারণে ইতিহাসকে খণ্ডিতভাবে দেখার জন্য ইতিহাসবিদদের ওপর এক রকম চাপ থাকে।
১৯৭১ সালের ইতিহাস নিয়ে প্রচুর গবেষণা হয়েছে। প্রচুর বই প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে তাদের পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেছেন। মান সবসময় রক্ষা হয় না। সেটা সম্ভবও নয়। আমরা একদৃষ্টিতে ইতিহাসকে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছি। ভিন্ন দৃষ্টিতে নানা প্রেক্ষাপট থেকে ইতিহাসকে দেখতে অভ্যস্ত নই। আমরা দেখতে চাই পাকিস্তান আক্রমণ করেছিল, যুদ্ধ করেছিলাম এবং আমরা জয়ী হয়েছি। সেখানেই আমরা থেমে যাই। ইতিহাসকে সামনে নিয়ে আর এগোয়নি। একাত্তরকে একটি বড় ইতিহাসের অংশ চিন্তা করলে সেটাকে বোঝা অনেক সহজ হয়। তাহলে আমরা ঘটনার পূর্ব এবং পরবর্তী সম্পর্কে জানতে পারতাম। কিন্তু আমরা যারা ইতিহাস চর্চা করছি, তাদের অধিকাংশই পশ্চিমা ধ্যান-ধারণার ধারক ও বাহক। তারা কলোনিয়ালিজম নিয়ে ইতিহাস শুরু করেন। জাতীয়তাবাদের ইতিহাসের ক্ষেত্রেও একটি স্থান ও সময় আছে। কিন্তু সেই স্থান ও সময় নির্ধারণ করতে গিয়েই সমস্যা তৈরি হচ্ছে। ফলে আমরা আগের ধারা বা ঘটনাপ্রবাহ বুঝতে পারি না। এ পরিপ্রেক্ষিতে তিনটি ঘটনাপ্রবাহ বা ধারার উল্লেখ করা যেতে পারে, যা আমরা বিশ্লেষণ করছি এবং পড়াচ্ছি। বাংলাদেশে তিনটি ঘটনা ঘটেছে। বাঙালি জাতি তৈরি হয়েছে কখন? প্রশ্ন করা হলে উত্তর হবে সপ্তম শতকের দিকে। যাকে আমরা নব্য প্রস্তর যুগ বলি। নব্য প্রস্তর যুগে এখানে ধান চাষ করা হতো, সেটা ছিল এখনকার পাহাড়ি অঞ্চলের মানুষের জুম চাষের মতো। ধান ছিল পাহাড়ি এবং এর উৎপাদন ছিল সীমিত। পরবর্তীতে আমরা পানির ব্যবহার শিখলাম। আমাদের হাতে বীজ এল। আরো পরে শিখেছি লাঙল এবং গরু ব্যবহারপূর্বক চাষ করতে। ফলে আমাদের উৎপাদন বেড়েছে। নব্য প্রস্তর যুগে রীতিমতো বিপ্লব সংঘটিত হলো কৃষিতে। এভাবে অনেক মানুষ এসেছে এখানে। কারণ এখানে খাদ্য উৎপাদন ছিল অপেক্ষাকৃত সহজ। ভূমি উর্বর হওয়ায় উৎপাদনও হতো বেশি। সে সময় যারা আলাদা হয়ে গিয়েছিল, তাদেরকেই আমরা আদিবাসী বলছি। নিচু মাটিতে যারা বসবাস করত, তাদেরকেই আমরা বাঙালি বলছি। বাঙালিরা মিশ্র জাত। এককভাবে দাবি করা যাবে না কেউ বাঙালি। যারা মঙ্গোলিয়ান বা বার্মা থেকে এসেছে, তারা বাঙালি সভ্যতা গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রেখেছে। আমাদের মধ্যে নিগ্রয়েড আছে, প্রটোঅস্ট্রোলয়েড আছে। আরো অনেক কিছু আছে। সব মিলিয়ে বাঙালি একটি মিশ্রিত জনগোষ্ঠী।
আর্যদের সময়ে এখানে কৃষিকাজ হয়েছে অনেক। প্রথমে অস্বীকার করলেও পরবর্তীতে তারা এখানে আসে এবং ধান চাষ শুরু করে। সেটা করতে গিয়ে তারা আধিপত্য বিস্তার করে। তারা যুদ্ধ করেই প্রভাব বিস্তার করেছে। আর্যরা সবল ছিল এবং তাদের প্রতিষ্ঠিত সৈন্যবাহিনী ছিল। তাই তারা সেটা করতে পেরেছে। কিন্তু এ অঞ্চলের বাঙালি জনগোষ্ঠী ছিল কৃষক। তারা ছিল দুর্বল। আমাদের ইতিহাসে যে পাল কিংবা সেন বংশের কথা উল্লেখ করি, তারা কেউ বাঙালি ছিল না। এমনকি বখতিয়ার খিলজিও না। তারা সবাই এ অঞ্চলের সম্পদের লোভে এসেছিলেন। আর এই পাল কিংবা সেন অথবা তুর্কি খিলজিদের সঙ্গে এখানকার স্থানীয়দের কোনো সম্পর্ক ছিল না।
পরবর্তীতে মোগলদের সময় কৃষি বিপ্লব হয়। সে সময়ে একটি ভূমিকম্প হয়। ভূমিকম্পের ফলে সৃষ্টি হয় মেঘনা নদীর। ফলে নতুন কিছু এলাকায় মানুষের যাওয়ার সুযোগ তৈরি হয়। নোয়াখালী, বরিশালের মতো এলাকা বাংলার সঙ্গে যুক্ত হলো। মোগলরা বাইরের মানুষ হিসেবে সেখানে প্রবেশ করে। তারা কৃষিকে গ্রামের সাধারণ মানুষের কাছে নিয়ে যায়। মানুষ কৃষিনীতি ও নতুন কৃষি পদ্ধতি গ্রহণ করল। এখানকার মানুষ যাদেরকে পীর-আউলিয়া বলে জানে, তারা আসলে মোগলদের কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা ছিলেন। তাদের মাধ্যমেই এ অঞ্চলে কৃষি বিপ্লব সংঘটিত হয়েছে। এ কর্মকর্তারা তাদের দায়িত্বের কারণে বিভিন্ন অঞ্চলে গিয়ে থাকতেন। আর তারা যেহেতু মুসলিম ছিলেন, সেহেতু তাদেরকে মানুষ সম্মান করত। কারণ তারা চারিত্রিকভাবে বেশ নম্র ও বিনয়ী ছিলেন। ফলে ইসলাম ধর্মের প্রসার ঘটে। তারা জোর করে ইসলাম চাপিয়েছেন, সেটা বলা যাবে না। তাদের চারিত্রিক গুণাবলির কারণেই স্থানীয়রা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছে। তখন তারা আল্লাহকে বলতেন নিরঞ্জন।
অনেকেই মুসলমান হলেন কৃষির মাধ্যমে। পরবর্তীতে ইংরেজদের সময়ে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তর মাধ্যমে একটি বিপ্লব হয়। তারা চেয়েছিল পুঁজিবাদী কৃষির প্রসার। কিন্তু সেটা তারা করতে পারেনি। অনেক কারণে হয়নি। সেটা আরো বড় আলোচনার বিষয়। জমিদাররা এখানে থাকত না বলে ইংরেজরা মধ্যস্বত্বভোগীদের অনেক ক্ষমতা দিয়ে দেয়। মধ্যস্বত্বভোগীরা ছিল মুসলিম। তারা পরবর্তীতে শিক্ষিত জনগোষ্ঠী হিসেবে পরিণত হয়। জন্ম হয় শিক্ষিত মুসলিম বাঙালি জনগোষ্ঠীর। অর্থাৎ প্রথমে আমাদের মুসলিম জনগোষ্ঠী তৈরি হয়েছে, পরবর্তীতে তৈরি হয় বাঙালি। এভাবেই মূলত বাঙালি মুসলমানের শুরু।
পরবর্তীতে শিক্ষিত বাঙালি মুসলমানের রাজনৈতিক যাত্রা হয়। ইংরেজ আমলে বঙ্গভঙ্গের মাধ্যমে এর শুরু। শেষ পর্যন্ত গিয়ে পাকিস্তান হলো। বাঙালির রাজনীতি বলি, বাঙালির জাতীয়তাবাদ বলি— এসবের পেছনে একটি ইতিহাস আছে। সেসব না জেনে কথা বললে তা সঠিক হবে না। ইতিহাসের ভিত্তি প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যায়। ইতিহাস বলছে, এখানকার মানুষের আত্মপরিচয় নির্মিত হয়েছে প্রতিপক্ষ দ্বারা। এছাড়া তারা শুধু কাজ করেছে। খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকতে যা করতে হয় তা-ই করেছে। বাঙালি মুসলমানদের ক্ষেত্রেও কিন্তু কোনো ধর্মীয় ভিত্তি ছিল না। যখন তার উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হলো, তখন সে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পরিবর্তন করল। ইংরেজরা এখানে এসে হিন্দুদের সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলেছিল বলেই মুসলমানরা তাদের রাজনীতি পরিবর্তন করে। তারা সুবিধা পাওয়ার রাজনীতি করেছিল। হিন্দুদের প্রতিপক্ষ বানিয়ে ইংরেজদের কাছে সুবিধা চাইল মুসলমানরা। ফলে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন। সেখান থেকে পাকিস্তান সৃষ্টির আন্দোলন। পাকিস্তান আন্দোলন বাঙালি মুসলমানদের আন্দোলন নয়। বাঙালি মুসলিমদের আন্দোলন ছিল স্বতন্ত্র। তারা এতে যুক্ত হয়েছিল মাত্র।
এটা রাজনীতিতে হয়েছিল কিন্তু কৃষিতে কী হয়েছিল? কৃষিতে তেতাল্লিশের মন্বন্তর হয়েছিল অর্থাৎ দুর্ভিক্ষ। তিন বছর পর ভোট হয়েছিল। সেখানে পাকিস্তানের জন্ম। সেদিক থেকে বিবেচনা করলে বাংলার মানুষ পাকিস্তান যতটুকু চেয়েছিল, তার থেকে অধিক চেয়েছিল তাদের অবস্থার পরিবর্তন। এক্ষেত্রে যা-ই হতো, সেটাই মেনে নিত। ভারত একটা রাষ্ট্র হলেও সেটা মেনে নিত। তাদের অবস্থার উন্নতি ঘটলে সে সময় যে ব্যবস্থাই তাদের সামনে আসত, সেটাই তারা মেনে নিত। দীর্ঘ একটি আন্দোলন বাঙালির ছিল। বিভিন্ন সময়ে তাদের প্রতিপক্ষ পরিবর্তন হয়েছে। প্রথমে মুসলমান বাঙালিদের প্রতিপক্ষ হিন্দু। পরবর্তীতে অবাঙালি পাকিস্তানিরা মুসলিম বাঙালিদের প্রতিপক্ষ। তাদের সঙ্গে আমাদের জাতীয়তাবাদের পার্থক্য ছিল। বাঙালিরা কখনই পাকিস্তানের আন্দোলন করেনি। কিন্তু আন্দোলনটা দেখতে মনে হয়েছে সে রকম কিছুই। সেই আন্দোলনটাই পরবর্তীতে একাত্তরে হয়েছে। শহরের বাঙালিরা কখনই একসঙ্গে থাকতে শেখেনি। গ্রামে যখন আমরা গবেষণা করছি, তখন দেখছি গ্রামের মানুষের মধ্যে সেই সাম্প্রদায়িকতার মানসিকতা নেই। এটা শহরেই সীমাবদ্ধ। অর্থাৎ আমরা যে বলছি সাম্প্রদায়িকতা আমাদের গিলে খাচ্ছে, সেটা বলা ভুল হবে। এটা রাজনৈতিক। সবল দুর্বলকে অত্যাচার করবে, এটা আমাদের সংস্কৃতি। এর বিরুদ্ধে আন্দোলন কখনই গড়ে ওঠেনি। এটা রাজনীতি থাকলেও হবে, না থাকলেও হবে। সেক্ষেত্রে একাত্তর সালে কি সামাজিকভাবে কোনো পরিবর্তন এসেছিল? সেটা দেখতে হবে। নতুন কোনো শ্রেণী ক্ষমতায় এসেছিল কিনা। হ্যাঁ, এসেছিল। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পর ‘ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো’ ডাকে সাড়া দিয়ে সংগ্রাম কমিটি গঠিত হলো গ্রামে। সেটা গ্রামে শ্রেণী তৈরি করল। শহরে আওয়ামী লীগের একটা শ্রেণী তৈরি হয়েই ছিল। সংগ্রাম কমিটির বিরুদ্ধে তৈরি হলো শান্তি কমিটি। কিন্তু শান্তি কমিটি তৈরি হয়ে খুব বেশি কাজ হলো না। কারণ একই জনগোষ্ঠী থেকে দুটি শ্রেণী উঠে আসায় একে অন্যের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারছিল না। কেননা আপন ভাইকে কেউ মারবে না, যদিও সে সংগ্রাম কমিটিতে আছে। সেক্ষেত্রে আমরা এখন যে ইতিহাস বলি, সেটা রাজনৈতিক সুবিধা পেতে বলি। মূলধারার ইতিহাস সেটা বলে না। আমরা যে ইতিহাস পড়ি, সেটা শহরের এলিট শ্রেণীর। ধনীদের ইতিহাস। মানচিত্র ও পতাকা সৃষ্টির ইতিহাসে গ্রামের কৃষকদের কোনো স্থান আমরা দেখতে পাই না। এটা আমাদের স্বাভাবিক ইতিহাস নয়। আমরা আসলে সবসময় দেখেছি, ধনীরা সুবিধা পেয়ে এসেছে, গরিবরা কিছুই পায়নি। ইতিহাসে গরিব কৃষকদের অনুপস্থিতি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের দুর্বলতা তুলে ধরে। মৌলিক সমস্যাগুলোকে আরো প্রকট করে তোলে। শূন্যতাগুলো চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। তবে এটা সমাধানে কাজ করছি। আরো অনেকেই হয়তো করছেন। জানি না কতটুকু করতে পারব। আমাদের ইতিহাসে চালের দাম, ডালের দাম বেড়েছে স্থান পায়নি। একজন কৃষক না খেতে পেয়ে মারা যাচ্ছেন, সেটা আসেনি। শুনতে খারাপ লাগলেও সেটাই আমাদের ইতিহাস। আমরা এখন যা চর্চা করছি, তাতে আমাদের ইতিহাস পশ্চিমাদের মতো রাষ্ট্রকেন্দ্রিক। আমাদের সমাজকেন্দ্রিক ইতিহাস নেই। আমরা গণমানুষের কথা বলি হরহামেশাই। কিন্তু ইতিহাসে তার প্রমাণ নেই। যুদ্ধের সময় পাশের একটি মানুষ আমাকে গুলি এগিয়ে দিয়েছিল কিংবা আহত হওয়ার পর আমাকে সেবা করে সুস্থ করে তুলেছে, সে ইতিহাস নেই। সেটা থাকলেই গণমানুষের ইতিহাস তৈরি হতো।
মূল লেখার লিঙ্ক ((http://www.bonikbarta.com/2015-03-26/news/details/32321.html))
মুক্তিযুদ্ধের রাষ্ট্রনৈতিক ইতিহাস যে খুব বেশী মানুষের মাঝে জনপ্রিয়তা পেয়েছে, তাও কিন্তু দেখি না।
বরং, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে মনে হয়, গ্রামে গ্রামে প্রতিরোধ সংগ্রামের গল্পই মানুষ বেশী মনে রাখে।
আর একটা ব্যপার হল, শহরে শহরে প্রতিরোধ মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধ ছিল গেরিলা স্টাইলের।
আর তার বিপরীতে, গ্রামগুলো ছিল, মুক্তিবাহিনীর আশ্রয়দাতা, রসদ সরবরাহকারী, গোপন অ্স্ত্রাগার। সিনেমা নাটকে, আর গুরুজনদের মুখে মুখে গল্পটা এভাবেই শুনে এসেছি। অথচ, আনুষ্ঠানিক ইতিহাস চর্চায় এর এত অভাব হল কি করে?