সরব স্বরের চতুর্থ ইভেন্টের বিষয়বস্তু ছিল- ‘৪৪ বছরে বাংলাদেশ: প্রতিষ্ঠান না দাঁড়ানোর ইতিহাস’। স্পিকার আলাউদ্দীন মোহাম্মদ। শুরুতে ‘ওল্ড ইন্সটিটিউশনাল ইকোনমিকস’, থর্সটেইন ভ্যাবলেনের ‘থিউরি অফ লেইজার ক্লাস,সমান্তবাদ (Feudalism), ফ্রেঞ্চ রিভোলুশ্যান, ১৯২৯ সালের ‘ওয়াল স্ট্রীট ক্রাশ বা ব্ল্যাক টুইজ-ডে’, লিবারেলিজম নিয়ে প্রাসঙ্গিক এবং তথ্যনির্ভর বক্তব্য দেন। যার মাধ্যমে অর্থনীতির সাথে প্রতিষ্ঠানের সম্পর্ক এবং গুরুত্বালোচনার পটভূমি তৈরি হয়।
প্রতিষ্ঠানের বেশ কিছু সংজ্ঞা আলোচিত হয় কিন্তু স্পীকার বেশি জোর দিয়েছেন ১৯৯০ সালে প্রাতিষ্ঠানিক অর্থনীতিবিদ ডগলাস নর্থ প্রণীত সংজ্ঞাটির প্রতি, যা হলো-
“Institutions are the rules of the game in society or, more formally, are the humanly devised constraints that shape human interactions. In consequence they structure incentives in human exchange, whether political, social or economic.”
যার মূল বিষয়টি সহজবোধ্য করে প্রকাশের উদ্দেশ্যে স্পিকার বলেন, “ সমাজের ক্রিয়াকলাপ এবং আন্তঃসম্পর্কগুলো যে বস্তুটি ঠিক করে দেয় সেটিই হলো প্রতিষ্ঠান।”
এখন সমাজের ক্রিয়াকলাপ এবং আন্তঃসম্পর্কিক বিষয়গুলো কারা (কোন প্রতিষ্ঠানগুলো?) / ঠিক করে দেবে বা কারা ঠিক করে দেয়/ কাদের ঠিক করে দেয়া উচিত? এক্ষেত্রে তিন ধরনের প্রতিষ্ঠান এগুলো করে থাকে।
-সামাজিক প্রতিষ্ঠান,
-রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান,
-অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান।
যাদের একত্রে বলা হয়ে থাকে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান। এ প্রসঙ্গে তিনি আরো বলেন, “রাষ্ট্র একটি প্রতিষ্ঠান মাত্র। রাষ্ট্রের উৎপত্তি তথ্যগুলোতে এর প্রমাণ মেলে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হবস, লক এবং রুশো রাষ্ট্রকে সামাজিক চুক্তির ফল হিসেবে বিবেচনা করেছেন যাদের তিনজনেরই চূড়ান্ত প্রস্তাব মূলত একই যদিও তারা তিনটি ভিন্ন প্রেক্ষাপটকে এই চুক্তির সম্ভাব্য কারণ হিসেবে বিবেচনা করেছেন। প্রাচীন ভারতবর্ষের বৌদ্ধিক রাষ্ট্রতত্ত্বেও রাষ্ট্রকে ‘মহাসম্মত’ বা ঐক্যমত্যের ফল হিসেবে দেখা হয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত কারো দ্বিমত নেই যে রাষ্ট্র একটি চুক্তিমাত্র এবং এই চুক্তির শর্ত মানাটা এর প্রাতিষ্ঠানিক বাধ্যবাধকতা এবং চুক্তির শর্ত না মানলে কিংবা এটাকে যথার্থ মনে না করলে নতুন রাষ্ট্রের উদ্ভব এটাই প্রমাণ করে যে এই প্রতিষ্ঠান সময়ে ভাঙতে পারে এবং সচরাচর তা দেখাও যায়।
চুক্তির শর্ত না মানায় নতুন রাষ্ট্রের উদ্ভব- এ প্রসঙ্গ ব্যাখ্যা করার জন্য খুব দূরে হাতড়ানোর প্রয়োজন নেই। তাকাতে হবে অখণ্ড পাকিস্থান ভেঙ্গে বাংলাদেশের স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম ইতিহাসের দিকে। ‘প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাংলাদেশ রাষ্ট্র যে দাঁড়াতে পারে নি তার প্রমাণ রাষ্ট্রটি গোটা যৌথ সময়ে মাত্র ছয় বছর গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে পরিচালিত হয়েছে, পাশাপাশি জাতিকে একটি গ্রহণযোগ্য সংবিধান দিতে পারে নি কিংবা প্রণীত সংবিধান টিকিয়ে রাখতে পারে নি। সত্তুরের নির্বাচনে আওয়ামীলীগের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে সেখানেও ক্ষমতা হস্তান্তর না করাটাকে অবশ্যই একটি প্রাতিষ্ঠানিক ব্যর্থতা হিসেবেই দেখতে হবে, যেখানে প্রতিষ্ঠান কয়েকজন ব্যক্তি কিংবা ক্ষুদ্র একটি গোষ্ঠীর খামখেয়েলীতে পরিণত হয়েছে।’
(চলমান সংকট মোকাবেলায় চাই শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান: আলাউদ্দীন মোহাম্মদ। ২০ শে জানুয়ারি; বাংলা ট্রিবিউন।)
১৯৭১সালের পর থেকে আমাদের প্রাপ্তি কী? জাতি হিসেবে আমরা কতোটা সফল? প্রাপ্তির খাতাটা নুন আনতে পান্তা ফুঁড়োয় টাইপ হাড়হাভাতে টোকাইয়ের অস্থিচর্মসার শরীরের মতন না, নব্য ঘুষে নিতম্বে চর্বির আধবিঘত লেয়ার পড়া চাকুরের মতন-ই। বিদ্রুপ, ঠাট্টা যেকোনো একটাতে ফেলতে পারেন। আমরা আগের চাইতে অনেক বেশি ধান উৎপাদন করি, আমাদের দারিদ্র্যের হার অনেক বেশি কমে এসেছে, জিডিপি বেড়েছে, মাথাপিছু আয় বেড়েছে, ব্যক্তিগত অর্জনের পাল্লাও নেহাত কম নয়। প্রাপ্তি অনেক আছে কিন্তু গ্রহণযোগ্য, শক্তিশালী, নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা কতটি বেড়েছে? পার্লামেন্ট, আদালত, আইন প্রণয়নকারী সংস্থা আছে, তারা কাজও করছেন কিন্তু তাদের নিরপেক্ষতা কতোটুকু ট্রান্সপারেন্ট? এই প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি আমরা কতোটা আস্থাশীল? এই প্রতিষ্ঠান গুলোরই বা আমাদের আস্থা অর্জনে কতোটুকু তাড়না অনুভব করে? বিগত একদশকে স্কলরাশিপ নিয়ে দেশের বাইরে গমন কারী তরুণের সংখ্যা অনেক বেশি? কিন্তু উচ্চশিক্ষা অর্জন করে দেশে ফিরে আসিয়েদের পার্সেন্টেজটা বেশি নয়। কারণ জানতে চেয়ে প্রশ্ন করলে সম্ভাব্য যে উত্তরটা সবচেয়ে বেশি পাওয়া যাবে তা হলো- ‘দেশে এসে লাভ কী? উচ্চ শিক্ষা প্রাসঙ্গিক কর্মক্ষেত্র/রিসার্চ ফিল্ড তৈরি হয়নি। ব্লা…ব্লা…’
এটা ফেলে দেয়ার মতো কারণ না, গুরুত্বপূর্ণ একটা ইস্যু। কিন্তু আমাদের আরেকটা কারণ সুপ্ত থেকে যায় অথবা অবচেতনে রয়ে যায়- আস্থাহীনতা অনুভব করা, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান গুলোতে আস্থাহীনতা অনুভব করা! কেন আস্থা অনুভব করতে পারছেনা? দেশের চলমান পরিস্থিতি-ই হয়তো এর একটা উত্তর হতে পারে!
রাজনৈতিক সঙ্কট, গ্রহণযোগ্য, শক্তিশালী, নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠতে না পারার পরও আমাদের অনেক ক্ষেত্রেই স্বয়ংসম্পূর্ণতা এসেছে, উন্নতি সাধিত হয়েছে। তার কারণ অন্তর্নিহিত বাংলাদেশের মানুষের বেঁচে থাকার অদম্য সংগ্রামের মধ্যে যে সংগ্রামে সুশাসন কিংবা প্রাতিষ্ঠানিক ছাউনি অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে বাঁধা হতে পারে না।
ভিন্ন প্রসঙ্গে যাওয়া যাক, আচ্ছা, একজন ব্যক্তি নিজেই কী একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারেন? পারেন, উদাহরণ বিলগেটস কিংবা জকারবার্গকে টানার প্রয়োজন নেই, আবদুল্লাহ আবু সাইয়ীদ স্যার-ই উজ্জ্বল উদাহারণ। কিন্তু ব্যক্তি একদিনেই একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হতে পারে না। দৃঢ়সংকল্প, ত্যাগ, প্রচেষ্টা, নিরলস পরিশ্রমের মাধ্যমে একটা সময় পর ব্যক্তি প্রতিষ্ঠান হিসেবে দাঁড়িয়ে যান। একটা আস্থার অবলম্বন হিসেবে পৌছানোর পর-ই তা সম্ভব।
রিফ্রেশমেন্ট বিরতির পর যথারীতি শুরু হয় প্রশ্নোত্তর এবং মুক্ত আলোচনা পর্ব। আগের তিনটি স্বরের মতো এবারও উপস্থিত অংশগ্রহণকারীদের প্রায় সবাই কথা বলেছেন, নিজেদের চিন্তা-ভাবনা শেয়ার করেছেন। ভিন্ন-ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে সমস্যা অবলোকন করে সমাধানের সম্ভাব্য পথ খোঁজার চেষ্টা করেন। দেশে প্রায় দুই লক্ষ আশি হাজার রেজিস্টার্ড এনজিও প্রতিষ্ঠান আছে, কিন্তু তাদের ভূমিকা কি সক্রিয় প্রতিষ্ঠান তৈরিতে? কিংবা তারা কি নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে পারছে? পক্ষে-বিপক্ষে অনেক উত্তর আসে। আমরা যা-ই করি, যেভাবেই চিন্তা করি, আলটিমেটলি পরিবর্তন আনার জন্য আমাদের কোন পন্থা অবলম্বন করা উচিত? কোনটা তুলনা মূলক বেশি ইফেকটিভ হতে পারে? সমস্যার সমাধান ‘থ্রু পলিটিকাল অ্যাক্টিভিটির’ মাধ্যমেই সমাধান করা বেশি সহায়ক? আরও অনেক প্রশ্ন অনেক উত্তর আরেকটা টান-টান, ঝাঁজালো, ডাই ভার্সিফাইড মুক্ত আলোচনা পর্ব যার সবকিছু লিখে প্রকাশ করা প্রায় অসম্ভব।
মাগরিব পেরিয়ে আরেকটু আলোচনা। তারপর সবার বাড়ি ফেরা। আয়োজন, অংশগ্রহণ কারীদের উপস্থিতি বিবেচনায় আমাদের পরিসরেকে হয়তো ‘ছোট’ ট্যাগ দেয়া যায় কিন্তু প্রয়াস, প্রচেষ্টার কমতি ছিলনা। কিছু নতুন প্রশ্ন মাথায় নিয়ে বাড়ি ফিরেছে সবাই। তরুণরা প্রশ্ন করতে শিখবে, উত্তর খুঁজতে শিখবে, সর্বোপরি চিন্তার ক্ষেত্র বৃদ্ধি পাবে- সরব-স্বর এই স্বপ্ন নিয়েই একটু-একটু করে আগানোর স্বপ্ন দেখে। আমরা এগুচ্ছি…
আস্থাহীনতা অনুভব করা, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান গুলোতে আস্থাহীনতা অনুভব করা!
খুব জরুরি একটা পয়েন্ট। অনেকে অনেক কথা বলে দেশে তরুণরা ফিরে আসলেই হবে, কিন্তু আসার পরিবেশ তো আমাদেরই তৈরি করতে হবে — নাকি?
এই জাতীয় টকগুলো আমাদের অনেক এসাম্পশনকে প্রশ্ন করে।
এইটা ভালো একটা বিষয়।
ভাল একটা উদ্যোগ নেয়ার জন্য সরব স্বরকে অভিনন্দন। আর আলাউদ্দিনকে অভিনন্দন তার বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ও সবার মধ্যা টা ছড়িয়ে দেয়ার জন্য ! 🙂