ব্লাগার থাবাবাবাকে গলা কেটে হত্যা করেছিল দুর্বৃত্তরা। আইনী লোকজন তখন বেশ তৎপর হয়ে কিছু ধরপাকড় চালিয়েছিল। এই হত্যাকান্ড নিয়ে তৈরী হয়েছিল, এমন কি, অপরাধ বিষয়ক ডকুমেন্টারীও। তথ্যসূত্রে জানা যায়, বিচারকাজও শুরু হয়েছে, মাত্র (!) দু’ বছর পর।
এই ভয়ংকর হত্যার বিপরীতে বিচারিক প্রতিষ্ঠানগুলোর এই গড়িমসির কোন সমালোচনায় না গেলেও বলা যায়, বাংলাদেশের জন্য এই হত্যাকান্ড এই মুহূর্তে কোন গুরুত্ব বহন করে না। ঢাবি ক্যাম্পাসে অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদের আক্রান্ত হওয়ার পর যতটা উচ্চবাচ্য শোনা গিয়েছিল, কিছু সুস্পষ্ট কারণে, ব্লগার রাজিব হত্যার বিচারে সেরকম আগ্রহ, আদতে কোন পক্ষই দেখান নি।
বাংলাদেশে এমনিতেও কত হত্যাকান্ডের বিচার নিরবে বাকি থেকে যায়, কেউ কেউ হয়তো এই বিচার ব্যবস্থার অকার্যকরতার ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে নিজের পিঠ বাঁচাতে চান। কিন্তু, এখন মনে হচ্ছে, এই ব্যপারটা – বিচার না পাওয়ার চেয়ে বেশী ক্ষতিকর। কারণ, সকলের এই পিঠ বাঁচানো কৌশলে, অভিজিৎ রায়ের মত একজন মেধাবী মানুষকে খুন হতে হল ভরা রাস্তায়। তাকে হারানোর চল্লিশ দিনের মধ্যে (ধর্মীয় পরিসরে মনে করা হয়, মৃতের আত্মা চল্লিশ দিন এই জগতেই থাকে) আরেক প্রথাবিরোধী ব্লগারের প্রকাশ্য নৃশংস খুন, একটা কথাই বলে দেয়, ‘এটাই শেষ নয়’। তারও চেয়ে ভয়ংকর যে সত্য, আমাদের দেশের সকল ব্লগার লেখকদের কাঁচাঘুম খোঁচা দিয়ে ভাঙ্গাতে যথেষ্ট সেটা হলো, দুজন বাচ্চা মতন মাদ্রাসা ছাত্র ধরা পড়েছে আজকের ব্লগার ওয়াশিকুর বাবু খুনের ঘটনায়। এবং, তারা নাকি, ধর্মীয় দায়িত্ব মনে করে এ জঘন্য কাজটি করেছে।
এ পর্যায়ে, অনেকে সংহিসতায় ধর্মের ঐতিহাসিক অবদান ব্যাখ্যা করে হতাশার দীর্ঘশ্বাস ফেলবেন হয়তো। যত দোষ মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থার উপর চাপিয়ে দেশ ছাড়ার বন্দোবস্ত করতেও অনেকে দুই পা এগিয়ে যাবেন। কিন্তু, আমার মনে হয় না, বর্তমান দেশীয় রাজনীতির মত একে অপরের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে কোন সুস্পষ্ট সমাধানে পৌঁছানো সম্ভব।
বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক পরিবেশে সাধারণ মানুষের মাঝে যদি এই অতর্কিত হত্যার বিপরীতে জনসচেতনতা তৈরী করা না যায়, তাহলে কিন্তু, সমস্তই ভেস্তে যাবে, এবং পরিস্থিতি আরো ঘোলা হবে। এজন্য আমার মনে হয় নিচের তিনটা পয়েন্টকে অনুসরণ করা সকল মত ও বিশ্বাসের ব্লগারদের খুবই জরুরী:

ছবিটি দেখুন। আশেপাশের মানুষগুলোকেও দেখুন। কে কেমন?
১. সর্বপ্রথম আমাদের তাদেরকেই সচেতন করে তুলতে হবে, যারা সন্ত্রাসের জন্য সবচেয়ে বেশী ঝুঁকির মধ্যে আছেন। আমি মুক্তমনা বা নাস্তিক লেখকদের কথা বোঝাচ্ছি না। আমি ভাবছি মাদ্রাসার বাচ্চাদের কথা।
আজ ধরা পড়া মাদ্রাসার ছেলে দুটোর কথা থেকে একটা কথা স্পষ্ট যে, তারা নিজেরা এই ব্লগারের কোন লেখা পড়ে নি।
আমার মনে হয়, মাদ্রাসার ছাত্র শিক্ষকদের মাঝে, এবং, মোটামোটি ধার্মিক বলয়ের ছাত্রদের মাঝে এ বিষয়ে একটা অসহনশীলতা এমনিতেই তৈরী হয়ে যায়, কেবল ব্লগের আসল চরিত্র ধরতে না পারার কারণে। ব্লগ যে একটা মুক্ত মঞ্চ, এটা পাড়ার চায়ের দোকান নয়, কিংবা স্কুলের কমন রুম নয়, সেটা বোঝাতে পারাটা অতিব জরুরী।
স্বাভাবিকভাবেই, এই ব্যাপারে সফল হওয়াটার সম্ভাবনা কম, যদি আমরা সরলরৈখিক ভাবে চিন্তা করি। কিন্তু, ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে তাকালে, একজন হিন্দু প্রতিবেশীকে কেন, ‘মালাXX’ বা একজন মুসলমান পরিচিতকে “কাটুX” বলে কেন ডাকা যাবে না, সেটা বোঝানো এমন কি মাদ্রাসা ঘরানার লোকদেরকেও সহজ। আমার মনে হয়, বিশ বছর আগে এই শব্দগুলো যে ভাবে মুড়িভাজার মত বাজারে চলতো, এখন তেমনটা আর নয়। এর পেছনে কারণ কি?
এর পেছনে কারণ হলো, পারস্পরিক আলোচনার পরিবেশ ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। আস্তিক নাস্তিক আলোচনার যুক্তিতর্ক, কিংবা, আবাহনী মোহামেডান খেলার যুক্তিতর্ক যে যথাক্রমে ব্লগ আর মাঠে রেখে একসাথে চা খাওয়া যায়, এবং বাজারে একসাথে সদাই করা যায়, এমনকি সামাজিক আচার পালন করা যায়, সেটা শেখানোয়, পারস্পরিক বোঝাপোড়াটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। গণসচেতনা বাড়ানোয়, সবচেয়ে বড় ভূমিকাটা রাখতে পারেন, যারা মূলত অ-নাস্তিক ব্লাগার তারা।
আমি এমন কি বেশ ধার্মিক ব্লগারও পেয়েছি, যারা এ ব্যাপারটা নিয়ে বেশ চিন্তিত। আমার বিশ্বাস, চিন্তিত না হয়ে, একটু সময় দিলেই এ ব্যপারটা সম্ভব।
২.
জন সচেতনতার পর যে ব্যাপারটা আমার কাছে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে, সেটা হল, সবচেয়ে অসচতেন অংশটা হতে হবে সচেতন।

তন্ময়ের কার্টুন
ব্লগাররা নিজেরাই। ঘটে যাওয়া ঘটনা গুলোর আইনী বিচারে স্বাভাবিক ছিল লেখকমহলের ঐক্যবদ্ধতা। কষ্ট হলেও সত্য, হতাশার কারণে হউক আর সামাজিক প্রতিক্রিয়ার ভয়ে হউক, বর্তমান ব্লগদুনিয়ার অধিকাংশ ব্লগার পারস্পরিক অনৈক্যের মধ্যে রয়েছেন।
ধর্ম-সমালোচক ব্লগাররা (আমি ধর্ম-বিরোধী শব্দটা বড় ভুল মনে করি) মধ্যম ধাঁচের ব্লগাদেরকে বেশ তাচ্ছিল্য এবং অবিশ্বাসের চোখে দেখেন এজন্য যে, তারা এ ধরনের সন্ত্রাস বন্ধে মত প্রকাশে যথেষ্ট আন্তরিক নন। রকমারি যখন অভিজিৎ এর বই সরিয়ে নিয়েছিল, তখন রকমারিকে মৌলবাদী ট্যাগ দিতে অনেককেই অতিআগ্রহী দেখেছি। তেমনি এবারের বইমেলাতেই একটা বইঘর বন্ধ করে দেবার পরও “সুশীল” নামক ট্যাগে অনেককে পড়তে দেখেছি।
আবার অন্যদিকে দেখি, যারা ধর্ম-সমালোচক নন, তারাও দেখেছি, এই ধরনের মত প্রকাশকে বৃহত্তর জনগোষ্ঠির কাছে নিজের গ্রহণযোগ্যতা, ও অতিস্বাভাবিক নিজের নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে, স্রেফ কিছু বিবৃতি দিয়েই ক্ষান্ত হয়েছেন।
অথচ, আমরা নিজেরাই দেখেছি, রানা প্লাজা ধ্বসের পর কিভাবে সকল গোষ্ঠির অনলাইন কর্মীরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ভাইবোনের মত কাজ করেছেন। আসলে, কোন একটা পক্ষের একার প্রচেষ্টায় এই ধীরে বেড়ে ওঠা দানবকে ঠেকানো সম্ভব নয়। যদি, এই তথাকথিক “নিও অ্যাথেইস্ট” ও “সুশীল”-রা মিলে এক টেবিলে বসে কার্যকর প্ল্যান করতে পারেন, তবেই সম্ভব কিছু একটা ফলাফল পাওয়া।
৩.
তৃতীয় ক্ষেত্রে প্রথাবিরোধী ঘরানার যারা তারা কি করতে পারে, একেবারে নিজেদের মাঝে? আসলে, এই লেখা নিয়ে চিন্তা করতে গিয়ে আমার কেবল মাথায় আসছিল সেলফ সেন্সরশিপের কথা। মানে, বাবারা ধৈর্য্য ধরে ওসব মুক্তকথা বলা বন্ধ রাখো। অন্তত কৌতুক করিও না।
কিন্তু, আমি মন থেকে এ কথায় সায় দিতে পারছি না যে, এ দেশের মত চরম গতানুগতিক পরিবেশে ৫৭ ধারা তো আছেই।
এত নজরদারির পরও কোনক্রমে এদিক ওদিক করে ধরলে, একমাত্র কথা বলার মাধ্যম, ব্লগ আর অনলাইন। এবার সরকারের রাঙা চোখের পাশাপাশি যদি, আমরা নিজেরাই সেলফ সেন্সরশীপের কথা বলি, তাহলে আর বাকি থাকলো কি? তাই অবশ্যই অবশ্যই সেলফ সেনসরশীপের কথা ভাবা যাবে না। যেটা ভাবতে হবে, সেটা হলো কমন গ্রাউন্ডের কথা। এ ক্ষেত্রে একটা বিষয় মনে রাখতে হবে যে, “উপহাস” কখনোই সঠিক বাণীটাকে পৌছে দেয় না। বরং, এটা বিপরীত পক্ষের উগ্রতার পাশাপাশি, যে পক্ষ সহনশীল কিংবা সহমর্মী তাদের কর্মক্ষেত্রকে সংকুচিত করে দেয়।
একটা বিষয় কি আমাদের বুঝতে কষ্ট যে, ভল্তেয়ার যুগের কৌতুকের সফলতার পেছনে প্রধান কারণ ছিল এর সহজবোধ্যতা আর সত্যনিষ্ঠতা। এখন কোন কৌতুক করার পেছনে যে ‘শরম দেওয়াটা’ আছে, সেটা দারূণভাবে ব্যর্থ হয়, যখন সেটা ঠিক, অপ্রত্যাশিতভাবে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর প্রতি “বেহিসাবী” অপমানের দিকে চলে যায়। ফলশ্রুতিতে, সেটা উগ্রতা বৃদ্ধি, সহমর্মিতা হ্রাসের পাশাপাশি আরেকটা ক্ষতি করে, তা হলো এই ‘কৌতুক’ সংস্কৃতিটাকেই ধ্বংস করে দেয়। (স্যাটায়ারের উদ্দেশ্য নিয়ে একটি সুন্দর বিশ্লেষণ)
একটা ছোট্ট উদাহরন না দিয়ে পারছি না। প্রয়াত হুমায়ূন আহমেদ কৌতুক করতে জানতেন না, তা তার শত্রুও বলবে না। অথচ, তিনি অপর এক স্পষ্টভাষী লেখকের সমালোচনায় বলেছিলেন, “(তাঁকে মরতে হয়েছে) কারণ যে বইটা তিনি লিখেছিলেন, তা এতই কুৎসিত যে, যে কেউ বইটা পড়লে আহত হবে। তার জন্য মৌলবাদী হতে হয় না”। যদিও একজন মানুষের মৃত্যুর পর এভাবে লেখা একজন বড় মাপের লেখকসুলভ আচরণ নয়, তারপরও এ কথার মাঝে যে বাস্তবতা লুকিয়ে আছে, তা ধারন করতে হবে। প্রশ্ন হচ্ছে সেটা কিভাবে? কৌতুক লেখা বন্ধ করে? আমার মতে তা নয়, বরং, কৌতুকের উদ্দেশ্য যারা তাদের সাথে যোগাযোগ রেখে।

শার্লি হেবদোর ঘটনার পর আঁকা এক চমৎকার কার্টুন। এক দু’ধারী তলোয়ার।
এসব ক্ষেত্রে আমার মতামত, কিছুমাত্র হলেও ধর্মে ধর্মে অসহিঞ্চুতা কমানোর যেমন উপায় আন্তধর্মীয় সম্মেলন বা এই টাইপ কিছু, ঠিক তেমনি, পারস্পরিক আলোচনা করার মত একটা সত্যিকার “ভালবাসা”যুক্ত একটা উপায় বের করতে হবে। সেটা ছোটখাটো সহজ কিছু বিষয়ে ডিবেট হতে পারে, যেখানে বাজে ভাষা ব্যবহার করা যাবে না, এবং উভয় পক্ষই কোন না কোন ভাবে, অপরকে কষ্ট না দিয়ে কিংবা ভয় না দেখিয়ে নিজের মতের পক্ষে শক্ত অবস্থান নিতে পারে।
কৌতুকের ক্ষেত্রেও স্বল্প ডোজের কিছু কৌতুক কিন্তু আমরা প্রচলিত, “পিকে” ছবিতে দেখেছি। এবং, ধর্মীয় পরিসরেও অবিশ্বাসীদের বিপরীতে শুধুই যে ধর-মার করার কথা হয়, তা কিন্তু নয়। বেশ কিছু কৌতুকময় পরিবেশও দেখেছি পরিচিত বন্ধুমহলের মাঝে। তাই, কৌতুকের জন্যও একটা কমন স্পেস তৈরী করতে পারাটা হবে একটা বড় সফলতা। যদি দেখা যায়, উভয় পক্ষই মজা করছে ও মজা পাচ্ছে, তাহলেই আসবে মানুষ মানুষে চিন-পরিচয়।
এত সবকিছুর পেছনে একটা উদ্দেশ্য থাকবে তা হলো, মানুষ হিসেবে অপরের বিশ্বাসটা মানবিক ভুলের উর্ধে নয়, এটা ধরে নিয়ে সহমর্মিতার একটা পরিবেশ আমরা পেতে পারি কি না, তা বের করতেই হবে আমাদেরকে। মনে রাখতে হবে, এক একজন ব্লগার হারানো মানে, বাংলাদেশের এক একজন ভবিষ্যৎকে হারানো। যতই বলি না কেন, “এক অভিজিৎ লক্ষ অভিজিৎ নিয়ে আসবে”, এই এক অভিজিৎ হারানোর বেদনা আরো দশক দশক বইতে হবে আমাদেরকে।
পরিশেষ, ভাষার মাস আর স্বাধীনতার মাস দুটো মাসে দুটো জলজ্যান্ত মানুষ চলে গেল। কিন্তু, সেই একাত্তরের বাঙ্গালীদের সহমর্মিতা পাওয়া গেল কই? একটি একাত্তর এসেছিল, শত শত বুদ্ধিজীবির সম্ভাবনাগুলো আমাদের হাত থেকে ছিনিয়ে নিতে। মুনীর চৌধুরীর অভাব কি আজো পূরণ হয়েছে নাট্যমঞ্চে? সিনেমা জগতে কি এসেছে কোন শহীদুল্লাহ কায়সার বা জহির? আমাদের আলতাফের মত সুরস্রষ্টা আর কি পেয়েছি একটাও? আর বিজ্ঞান নিয়ে চিন্তা করার মানুষতো বরাবরই অপ্রতুল ছিল, তার মাঝে না জানি কত প্রফেসরকে হারিয়েছি আমরা কেবল হিন্দু হবার দোষে।
ধরে নিন, এটা আরেকটা ১৪ই ডিসেম্বর। ধরে নিন হানাদাররা পরিকল্পনা এঁটেছে। লিস্ট করেছে তাদের দোসরেরা। আপনি একটা প্লাটুনে যুদ্ধ করছেন। আপনার ধর্ম কি? কি আপনার বিশ্বাস? এটা নিয়ে পড়ে থাকবেন কি এখন?
একজন মহান মুক্তিযোদ্ধা কি করতেন এই পরিস্থিতিতে? নিজেদের মাঝে অবিশ্বাস না কি কার্যকর পরিকল্পনা? সাধারণ মানুষের মাঝে বিদ্বেষ তৈরী, না কি তাদের ছোট্ট ছোট্ট অবদানের স্মীকৃতি? সিদ্বান্ত আপনার।
বেশ জরুরি একটা পোষ্ট।
সবটুকুর সাথে একমত না হলেও বলব দারুণ চিন্তাজাগানিয়া কিছু পয়েন্ট বলেছেন।
বোহেমিয়ান এর সাথে একমত
সময়ের সাথে চিন্তা করার মতো একটা লেখা। নতুন করে ভাবতে শেখা :love: