বাংলাদেশের সমাজ সবসময় অপরাধীদের পক্ষে। আর অপরাধী সরকারী ছত্রছায়াধীন কিংবা প্রভাবশালী হয় তাহলে তো সোনায় সোহাগা। তখন সে চলে যায় ধরাছোয়ার বাইরে।
টিএসসিতে মেয়েদের অপমান করার সাথে সংশ্লিষ্ট সবাই অপরাধী। তারা যে অপরাধ সংঘটিত করেছে তার জন্য তাদের বিচার হতে হবে। যেহেতু অপরাধী সবাইকে সহজেই সিসিটিভি ফুটেজ দেখে সহজেই খুজে বের করা যাওয়ার কথা, সে বিবেচনায় ঘটনার ঘটার সাথে সাথেই পুলিশ তৎপর হয়ে তাদের খুজে বের করে আইনের আওতায় নিয়ে আসবে এটাই স্বাভাবিকতা।
কিন্তু স্বাভাবিকতা হচ্ছে এই যে আমাদের সমাজে যা কিছু স্বাভাবিক তার কিছুই ঘটে না- এক্ষেত্রেও ঘটে নি।
এটা একটা ক্রিমিনাল অফেন্স- একটা অন্যায়- বর্বর অপরাধ। অপরাধী কয়েকজন মানুষ- আরো ক্লিয়ারলি বললে তারা পুরুষ মানুষ। অন্য সবার মত তাদেরও ব্যাকগ্রাউন্ড আছে, ফ্যামিলি আছে। তারা হতে পারে হিন্দু-মুসলিম কিংবা অন্য কিছু, তারা হয়তো ছাত্ররাজনীতির সাথে জড়িত থাকতে পারে কিংবা নাও থাকতে পারে। তারা ছাত্রলীগ- শিবির বা দল হতে পারে। তারা হয়তো ঢাকা ইউনিভার্সিটির শিক্ষিত পশু হতে পারে আবার রাস্তার ধারের অশিক্ষিত কোন বর্বর বস্তির মাস্তান হতে পারে। কিন্তু সব কিছুর উর্ধে যেটা তা হলো- ব্যাকগ্রাউন্ড যাই হোক না কেন তারা অপরাধী, তাদের বিচার হওয়া উচিত। আর তার জন্যে সবার আগে দরকার হলো তাদের আটক করা- আইনের বলয়ে আনা।
যেহেতু সেটা হচ্ছে না, সেহেতু আমাদের তাদের বিচারের দাবিতে সোচ্চার হওয়া উচিত।
কিন্তু আমরা সেটা করছি না। গত কয়েকদিনের ফেসবুকে এটা ছিল হট টপিক। সবাই এই ঘটনার নিয়ে সোচ্চার। কিন্তু কেউ যদি মানুষ জনের প্রতিক্রিয়া দেখেন তাহলে দেখবেন এই মুল ব্যাপারে চিন্তিত খুব অল্প সংখ্যক মানুষ। বরঞ্চ মানুষজন এটাকে সাইডে রেখে এসোসিয়েটেড অন্য সব ব্যাপার নিয়ে কথা বলতে কিংবা তর্ক করতে অত্যন্ত বেশি পরিমানে আগ্রহী। এই ব্যাপারগুলো কয়েকটা ভাগে বিভক্তঃ
১।ঘটনার পর প্রথমেই যেটা শুরু হলো সেটা হলো ভিক্টিম ব্লেমিং। ফেসবুকের বিভিন্ন পোষ্ট এবং পত্রিকার নিউজের নীচে কমেন্ট আসতে লাগলো মেয়েদের পোষাক নিয়ে, পহেলা বৈশাখে বাইরে যাওয়া নিয়ে। তাদের ধারনা মেয়েরা বাইরে উগ্র পোষাকে ঘুরে বেরায় বলেই এ জাতীয় ঘটনা ঘটে, অন্যভাবে বললে মেয়েরা অশালীন(!) পোষাকে বাইরে ঘুরলে তাদের উপর আক্রমন করায় দোষের কিছু নেই।
প্রথম কথা হলো পহেলা বৈশাখে মেয়েরা শাড়ি পড়ে ঘোরাফেরা করে। শাড়ি কোন অর্থেই একটা উগ্র পোষাক নয়। আমাদের সমাজে একটা প্রচন্ড ভুল ধারনা ঘোরাফেরা করে- সেটা হলো মেয়েরা তাদের পোষাকের কারনে আক্রমনের স্বীকার হয়। যদি তাই হতো তাহলে পাচ বছরের শিশু কিংবা হিজাব পড়া মেয়েরা এইসব ঘটনার স্বীকার হতো না। কিন্তু বাস্তবিক পক্ষে এমন ঘটনা প্রচুর পরিমানে ঘটে। হিজাবী-অহিজাবী, বাচ্চা-ব্রদ্ধা, সাদা-কালো নির্বিশেষে মেয়েদেরকে এরকম আক্রমনের স্বীকার হতে হয়।
একটা মেয়ে যদি অশালীন পোষাক পরেও তাহলেও তাকে ধর্ষন করা কিংবা তার শরীরে হাত দেয়ার অধিকার কারো নাই। যারা কথায় কথায় ইসলামের কথা টানে তারা জানে না যে ইসলাম যেমন মেয়েদের শালীন পোষাকের কথা বলেছে তেমনি ছেলেদের দৃষ্টিও নত রাখতে বলেছে। মহানবী কোন মেয়ের দিকে দ্বিতীয়বার তাকাতে নিষেধ করেছেন। বলেছেন তোমার নজর সংযত করো। কারন প্রথম দৃষ্টি তোমার, দ্বীতিয় দৃষ্টি শয়তানের। কিন্তু আমাদের বিশ্বাস, আমাদের নীতিবোধ, আমাদের চেতনা যেমন একচোখা- আমাদের ধর্মবোধও তাই। আমরা ততটুকুই গ্রহন করি যা আমাদের স্বার্থে যায়। আমরা আমাদেরকে সংযত করি না, আমাদের নিজেদের পশুবৃত্তি নিয়ন্ত্রন করতে না পেরে মেয়েদের পোষাকের দোষ দেই।
২। এরপরে ঘটনা প্রবাহে আবির্ভূত হলেন অন্য পক্ষ। তারা ঘটনার অপরাধীদের বিচারের দাবির চেয়েও বড় করে তুলে ধরলেন নারী পুরুষের দ্বন্দ। ঘটনা স্থলে মেয়েদের যারা উদ্ধার করতে গিয়েছিল তারাও পুরুষই ছিলেন। একজন পুরুষের হাতও ভেংগেছে। এটা নারী বনাম পুরুষের যুদ্ধ না। এটা কয়েকটা বখাটের অপকর্ম। বখাটেরা খুন করতে পারে, ছিনতাই করতে পারে- তারা মেয়েদের উপর আক্রমনও করতে পারে। তাতে দুনিয়ার সকল পুরুষেরা আক্রমনকারী হয়ে যায় না। যা ঘটেছে তার জন্যে বখাটেরাই দায়ী। কিন্তু এই ব্যাপারে নজর দেয়ার চেয়ে, প্রকৃত অপরাধীদের বিচার দাবির চেয়ে নারী-পুরুষ ইস্যু তুলে, পুরুষবাদী মানসিকতাকে একচোট আক্রমন করে গরম গরম বক্তৃতা দেয়াতেই অনেকের বেশি আগ্রহ দেখেছি। সমাজের ক্ষুদ্র একটা অংশ সব স্থানেই অপরাধ প্রবন থাকে। তাদের ঠেকিয়ে রাখতে কঠোর সব শাস্তির ব্যবস্থা থাকে। সবাইকে আপনি উপদেশ দিয়ে ঠিক করতে পারবেন না। তাদের জন্যে লাঠির ব্যবস্থা থাকে। ডান্ডা দিয়ে তাদের ঠান্ডা রাখতে হয়।
৩। অনেকের অভিমত দেখলাম মেয়েদের আত্মরক্ষার ব্যাপার নিয়ে। পিপার স্প্রে, চাকু, পেপার কাটার সহ নানা ধরনের পরামর্শ দেখলাম। অনেকে কারাতে বা আত্মরক্ষামুলক শিক্ষার প্রস্তাব রাখছেন। এসবই অত্যন্ত সুন্দর প্রস্তাব। মেয়েরা যদি আত্মরক্ষার ব্যাপারে সচেতন হয় তাহলে সেটা পজিটিভই হবে। কিন্তু যেখানে বখাটেরা দলবেধে আক্রমন করে, তাদের হাত থেকে বাচাতে গিয়ে ইউনিভার্সিটির ছাত্রনেতার হাত পর্যন্ত ভেংগে যায় সেক্ষেত্রে সামান্য পিপার স্প্রে কতটুকু ভুমিকা রাখতে পারে সেটা নিয়ে সন্দিহান হওয়ার যথেষ্ট কারন আছে। উইপন কেরি করার প্রবাব্লিটি বা সক্ষমতা অপরাধিদের অনেক বেশি থাকে এবং ক্ষেত্রবিশেষে এই ধরনের জিনিস তাদেরকে আরো অনেক বেশি হোস্টাইল করে তুলতে পারে।
বস্তুত পক্ষে কোন ঘটনার বিচার না হলে অপরাধীরা আস্কারা পায়। বিচারহীনতার সংস্কৃতি আরো বড় অবিচারের জন্ম দেয়। তারা তখন নিজেদের আইনের উর্ধে ভাবতে শুরু করে- আরো বড় সব ঘটনার জন্ম দেয়। আপনি একা বা কয়েকজন তাদের সাথে পারবেন না। পারার কথাও না- সে প্রশ্নও আসার কথা না। আপনি ভোট দিয়ে সরকার নির্বাচন করেন, ট্যাক্স দিয়ে পুলিশ প্রতিপালন করেন নিজে গিয়ে অপরাধীদের সাথে মারামারি করার জন্যে না। রাষ্ট্র এবং প্রশাসনের দায়িত্ব আপনার নিরাপত্তা দেয়া, আপনার সাথে সংঘটিত অন্যায়ের প্রতিবিধান করা। যদি তা করতে তারা ব্যর্থ হয় তাহলে রাষ্ট্র আর জংগলের মধ্যে কোন পার্থক্য থাকে না। আমরা আমাদের প্রিয় বাংলাদেশকে- লাখো প্রান আর সম্ভ্রমের বিনিময়ে পাওয়া স্বাধীন বাংলাকে জংগল দেখতে চাই না।
তাই আপনি দাবি তুলুন- আমি জানতে চাই না অপরাধী কোন ধর্মের বর্নের বা গোত্রের, সে কি বিশ্বাস করে বা কি করে না, সে কি হিন্দু না মুসলিম, সে কি শিক্ষিত না অশিক্ষিত, সে কি শাহবাগে যায় না শাপলায় যায়- আমি শুধু তার কৃতকর্মের বিচার চাই। আমি আমার জীবন ও সম্পদের নিরাপত্ত চাই, আমি আমাদের উপর সংঘটিত অন্যায়ের বিচার চাই।
মনে রাখবেন এই ঘটনা হঠাৎ করে ঘটেনি। অনেক দিন ধরেই রেগুলার এরকম ঘটনা ঘটে আসছে। সেগুলোর যথাযথ বিচার হয় নি বলে আজকে ঘটনার ব্যাপ্তি এত বেড়েছে। আজ এই ঘটনা যদি ওভারলুকড থেকে যায় কালকে যে এরা টিএসসি থেকে আপনার ঘরে এসে টোকা মারবে না- কেউ কিন্তু সে নিশ্চয়তা দিতে পারবে না।
অতএব নিজের স্বার্থেই দল-মতের উর্ধে উঠে প্রতিবাদ করুন।