ফুলার রোড, টিএসসি, চারুকলা, সোহরওয়ার্দি উদ্যান, কার্জন হল, শহীদ মিনার…ভার্সিটি লাইফ শেষে এই জায়গাগুলোই সবচেয়ে বেশি মিস করব। আমরা যারা ভার্সিটি ক্যাম্পাস এলাকায় (ঢাকা ভার্সিটি/ বুয়েট/ ঢাকা মেডিকেল কলেজ) ক্লাস করি কিংবা হলে থাকি, তাদের জন্য এই এলাকা অবাধ বিচরণ ক্ষেত্র। বলতে পারেন, ভার্সিটি লাইফের ৪/৫ বছরে এই জায়গাগুলো এতটাই আপন হয়ে যায় যে আপনি এর মায়া কখনই ত্যাগ করতে পারবেন না। ফুলার রোডের অবিরাম মুক্ত প্রান্তরে পড়ন্ত বিকেলের এলোমেলো হাওয়ায় স্বাধীনতার পূর্ণ আস্বাদন পাওয়া যায়। এমন অনেক দিন গিয়েছে যে, বিকালে পরীক্ষা বা ল্যাব শেষে চরম অবসাদগ্রস্ত হয়ে একা একা হেঁটেছি ফুলার রোডের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। এখানকার বাতাস এতটাই মুক্ত এর ছোঁয়ায় যে কারোর মন ভাল হতে বাধ্য। এমন অনেক দিন গিয়েছে, ক্লাসটেস্ট ক্যান্সেল হওয়ার আনন্দে কিংবা কোন ফ্রেন্ডের দেয়া ট্রিট উপলক্ষে সবাই মিলে টিএসসিতে গিয়ে চা-ফুচকা খেয়েছি। এমন দিন গিয়েছে, ফেব্রুয়ারি মাসের বইমেলায় গিয়ে বইয়ের জগতে অবগাহন করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে গিয়েছে। তারপর মেলাতেই বিকালের নাস্তা করে সন্ধ্যায় আপন মনে হাঁটতে হাঁটতে বাসায় যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়েছি। এমনও দিন গিয়েছে যখন বিকালে ফুলার রোড ধরে হাঁটতে হাঁটতে ৪ জন বান্ধবী মিলে সন্ধ্যার দিকে সোহরওয়ার্দি উদ্যানে পৌঁছেছি। তারপর স্বাধীনতা স্তম্ভের সামনে বসে থেকেছি ঘণ্টাখানেক। অপার বিস্ময়ে তাকিয়ে থেকেছি সুউচ্চ ঐ স্তম্ভের দিকে, তার উজ্জ্বল আলোর বিচ্ছুরণে মোহিত হয়েছি। স্বাধীনতা স্তম্ভের কাছাকাছি যাওয়ার জন্য পাথুরে পথটার উপর দিয়ে হেঁটে গেছি আমরা ৪ জন। হাঁটতে গিয়ে অনেক কষ্ট হচ্ছিল আমাদের। কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তেই উপলব্ধি করতে পারলাম পুরো স্থাপনার মূল রহস্য। কতটা ত্যাগ-তিতিক্ষার বিনিময়ে আমাদের স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছিল তার মাহাত্ম লুকায়িত আছে ঐ পাথুরে পথটার মধ্যে। ঐ সন্ধ্যা আমার জীবনে কাটানো সুন্দরতম সন্ধ্যা।
কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, আমরা ৪ জন মেয়ে পুরো সন্ধ্যা হেঁটে বেরিয়েছি পুরো এলাকা জুড়ে। এক মুহূর্তের জন্যও নিরাপত্তাহীনতার কথা চিন্তাও করতে পারিনি। কারণ সোহরওয়ার্দি উদ্যানের ভেতরে প্রতিটি পয়েন্টে আমরা পুলিশদের দেখেছি। এমন জায়গায় অপ্রীতিকর কিছু ঘটতে পারে না- ঐ ইউনিফর্ম পরিহিত পুলিশদের দেখলে এই বিশ্বাসটা আপনা থেকেই মনে বদ্ধমূল হয়ে উঠে। কিন্তু গত কয়েকদিনে এই বিশ্বাসটা মন থেকে উঠে গেছে। ঐ ইউনিফর্ম পরিহিত মানুষগুলোকে দেখলে এখন কোন আশ্বাস পাইনা, বরং মনে হয় কিছু জলজ্যান্ত মূর্তি দাঁড়িয়ে আছে।
এই পহেলা বৈশাখে ক্যাম্পাসে আমার দুই স্কুল ফ্রেন্ডের সাথে দেখা। এই প্রথম ওরা ভার্সিটি ক্যাম্পাসে এসেছে। আমাকে বলল, ‘তোদের উপর ঈর্ষা হয়। এত সুন্দর ক্যাম্পাসে প্রতিদিন আসা, সেটা ক্লাস করার মত পেইনফুল কাজ হলেও অনেক মজা।’ তারপর তারা আমাকে বলল, ‘আচ্ছা বলতো, এরপর কোথায় বেড়াতে যাব? রবীন্দ্র সরোবর নাকি চারুকলা?’ আমি সাথে সাথে বলে উঠলাম, ‘অবশ্যই চারুকলা’।
এই চারুকলার কথা এক বাক্যে বলে শেষ করা যাবে না। আমি শিল্পের মানুষ নই। তারপরও শিল্পের প্রতি অনুরাগ ছোটবেলা থেকেই ছিল। চারুকলার বর্ণিল, উৎসবমুখর পরিবেশ আপনাকে নিঃসন্দেহে শিল্পপ্রেমিক করে তুলবেই। তাই চারুকলার কথাটা আমি প্রায় এক নিঃশ্বাসে বলে দিয়েছিলাম। পরে রাতে ফেসবুকে বিভিন্ন পোস্ট পড়ে বেশ ধাক্কা খেলাম। আমার ঐ ফ্রেন্ডের পোস্টও দেখলাম। সে লিখেছে, ‘সন্ধ্যার পর থেকে একের পর এক আত্মীয়স্বজনের ফোনে আমার কান ঝালাপালা হয়ে যাচ্ছে। সবাই বলছে আমি ঠিকমত বাসায় পৌঁছেছি কিনা। মা বলে দিয়েছে ঐ এলাকার ত্রিসীমানায় কখনো যেন না যাই। আমিও বলি, এরকম বাজে ঘটনা শুনার পর ঐসব জায়গায় যাওয়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা আমার নাই। আমাদের ক্যাম্পাসের দারোয়ানগুলোও ঐ পুলিশগুলোর চেয়ে ঢের ভাল পাহারা দিতে পারে।’ এরকম পোস্ট পড়ে নিজেকে সত্যি সামলাতে পারছিলাম না। যেই টিএসসির অসীম মায়ার জালে আমরা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে থাকি, সেই টিএসসি এখন মানুষের চোখে বিশাল ত্রাস, কখনোবা মৃত্যুকুপ। এরকম ঘটনার পর কি আমরা আর আগের মত স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়াতে সাহস পাব কিংবা ঘুরে বেড়ালেও কি নিরাপত্তাহীনতার ভয় আমাদের কপালের চিন্তারেখাকে স্পর্শ করে যাবে না?
চলুন এবার টিএসসির ঘটনা থেকে বের হয়ে ঢাকা শহরের চিত্রপটে একটু হালকা চোখ বুলিয়ে নিই। সামনে তো মেয়র নির্বাচন। বিভিন্ন প্রার্থীদের কথাবার্তা শুনি, তাদের স্বপ্নের ঢাকা শহরের পরিকল্পনার কথা শুনি। গতকালই টিভিতে দেখলাম জনৈক প্রার্থী রাস্তা ঝাড়ু দিয়ে পরিচ্ছন্ন ঢাকা গড়ার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করছেন। কয়েকদিন আগে টিভিতে দেখেছিলাম আরেক প্রার্থী বলছেন, উনার প্রথম টার্গেট পরিচ্ছন্ন, সবুজ ঢাকা। নিরাপত্তা প্রথমে নাকি পরিচ্ছন্নতা প্রথমে? আর পরিচ্ছন্ন ঢাকা গড়তে চাইলে ঝাড়ু হাতে রাস্তায় নেমে ক্যামেরার সামনে পোজ দেয়ার দরকার নাই। উনারা ব্যক্তিগত জীবনে কয়জন নিজের বাসা ঝাড়ু দিয়েছেন এ নিয়েই তো সংশয় জাগে। আচ্ছা, সে কথা বাদ দেই। আমার মতে, প্রথম টার্গেট হওয়া উচিত নিরাপদ ঢাকা গড়া। উদাহরণস্বরূপ নিজের কথাই বলি। প্রতিদিনই ফার্মগেটের ফুটপাত দিয়ে হাঁটতে গিয়ে দেখি হাঁটার জায়গাটুকুও নাই। ফুটপাত যেন হকারদের নিজস্ব সম্পত্তি। যতটুকু হাঁটার জায়গা থাকে তাতেও দেখি ইট-সুরকি নাই। কখনো বালু, কখনো ইট। এ ধরণের ফুটপাতে হাঁটতে যেখানে আমারই ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা হয়, একজন বয়স্ক মানুষের কি অবস্থা হতে পারে তা বুঝতেই পারছেন। অবশ্য এই অবস্থা কেবল ফার্মগেটে নয়, ধানমণ্ডিতেও দেখেছি। সে যাই হোক, গত পরশু কি তার আগের দিন, ফার্মগেটের বড় ব্রিজটার কাছে দেখলাম একটা মেয়ে আরেকটা ছেলেকে ছাতা দেখিয়ে বলছে, ‘তুই আমার সাথে যা করলি, মনে রাখিস তোর মাকেও কেউ এই কাজটা করসে।’ আমি ঘটনাটা স্পষ্ট বুঝতে পারিনি। কিন্তু এরকম হরহামেশাই দেখি। আমাকে তো আমার মুরুব্বীরা বলেই দিয়েছেন, ‘রাস্তায় চলতে গেলে চোখ খুলে আর কানে তালা দিয়ে চলবা। কেউ পিছন থেকে ডাকলে কান দিবা না। নিজের ব্যাগ সাবধানে রাখবা।’ হ্যাঁ, ব্যাগ, ওড়না আপনাকেই সামলে রাখতে হবে। কেউ যদি এসে আপনার ব্যাগ বা ওড়না ধরে টান দেয় তাহলে সেই দোষ আপনারই। আপনি কেন নিজের জিনিস দেখেশুনে রাখতে পারেন না? নিজে একেকটা বিপদ ঘটাবেন আর দোষ দিবেন আইনের লোকদের? কেউ যদি আপনাকে আজেবাজে কমেন্টও করে, আপনি কেন অভিযোগ করবেন? নিজের সমস্যা নিজে সমাধান করুন। শুনতে কেমন কেমন লাগলেও এটাই আমাদের সমাজের এখনকার বাস্তবতা। একটা ঘটনার কথা শুনেছিলাম, পিছন থেকে আঙ্কেল/ আন্টি বলে ডাক দিয়ে প্রথমে কথা বলার চেষ্টা করে, তারপর আপনিও যদি বোকার মত ঐ কথোপকথনে যোগ দেন তাহলে দেখবেন কিছুক্ষণের মধ্যে আরও কিছু ছেলে এসে আপনাকে ঘিরে ধরে ছিনতাইয়ের সুযোগ নিচ্ছে। আমার এক পরিচিত আত্মীয়ই তো ফার্মগেটে রিকশা করে আসার পথে ছিনতাইয়ের সম্মুখীন হল। দিনদুপুরে বন্দুক ঠেকিয়ে সব টাকা নিয়ে গেল। চারপাশের মানুষ, এমনকি রিকশাওয়ালাও পুরা নিশ্চুপ। কে নিজের জীবন বাজি রেখে এগিয়ে যাবে বলুন? কথায় আছে না, ‘চাচা আপন প্রাণ বাঁচা।’
আমাদের দেশে গুটিকয়েক মানুষ বাদে বাকি সবাই সাধারণ মানুষ যাদের কথা কর্তৃপক্ষের দ্বার পর্যন্ত পৌঁছায় না। আমাদের অভিযোগ, আমাদের দীর্ঘশ্বাস যেন প্রতিধ্বনিত হয়ে আমাদের কাছেই ফিরে আসে। তাই দীর্ঘশ্বাস ছাড়া লেখা শেষ করার আর কোন ভাষা খুঁজে পেলাম না।