এই সময়

রফিক সাহেব যেন আমাকে দেখে ভূত দেখার মত চমকে উঠলেন। “কেমন আছেন ভাই?”, আমি জিজ্ঞেস করলাম। তিনি উত্তর দিলেন না। হালকা করে মাথা নেড়ে চায়ের কাপে জোড়ে জোড়ে চুমুক দেয়া শুরু করলেন। যেন, এই অপ্রস্তুত মুহুর্তটাও চায়ের সাথে গিলে ফেলতে চান। আমিও চায়ের ফরমাশ দিলাম, একটা সিগারেট ধরিয়ে তার পাশেই গিয়ে বসলাম। “তো আপনার একমাত্র ভাতিজি কেমন আছে? নাতি-পুতির মুখ দেখেছেন?” তিনি আবারও চমকে গিয়ে তাকালেন। গলা যথাসম্ভব স্বাভাবিক করে বললেন তখনই “জি ভাই, এইতো সেদিন স্বামী সন্তান নিয়ে ঘুরে গেলো। পিচ্চি মেয়েটা যা ফুটফুটে দেখতে !”। আমি মনে মনে হাসলাম। তাকে আরেকটু বাজিয়ে দেখার ইচ্ছা থাকলেও তা বাদ দিয়ে দিলাম। এবার তিনিই মুখ খুললেন, “শহীদ সাহেব এর খবর শুনেছেন ভাই?”। আমি পাল্টা জিজ্ঞেস করলাম “কোন শহীদ? লজিস্টিক্স এর শহীদ হাওলাদার?” তিনি মাথা নাড়লেন “নাহ, কর্মচারী সমিতির সভাপতি ছিলেন, শহীদ আখন্দ। গত বছর রিটায়ার্ড করলেন যে… ভুলে গেছেন?”। এবার চিনতে পারলাম। রোগা লোকটা একসময় আমার পাশের ডেস্কেই বসতেন। ভাবছি শালা মরে টরে গেলো নাকি। রফিক সাহেব তেলতেলে মুখটা মুহুর্তেই থমথমে করে ব্জানালেন “তার ছেলেটাকে কারা যেন ছুরি মেরেছে, আর বাঁচেনি।” শুনে ভেতরটা তেতো হয়ে গেলো। আহা, এ কি শুনলাম! টগবগে জোয়ান ছেলেটা মরে গেছে। ছেলেটার সাথে আমার কি দেখা হয়েছে?। হ্যা, ছোটবেলায় সে প্রায়ই বাপের সাথে অফিসে আসতো। ওয়েস্ট পেপার বাস্কেট থেকে কাগজ কুড়িয়ে এনে বলত, কাকু প্লেন বানিয়ে দাও, শাপলা বানিয়ে দাও। ইসস, সেই ছেলেটা এখন নাই! আমি বললাম, “শেষ বয়সে এই ধাক্কা কিভাবে সামলাবেন উনি! কারা মেরেছে? থানা পুলিশ কি বলে কিছু জানেন?” “আমি ওদিকে যাওয়ার সময় পাইনি” রফিক সাহেব বললেন,”তবে ছেলেটাতো কলেজে পড়তো। বন্ধুদের সাথে নাকি ক্রিকেট খেলতে গিয়েছিলো অন্য পাড়ায়। কি নিয়ে যেন কথা কাটাকাটি, আর তাতেই হারামজাদাগুলো ওকে মেরে বসলো”। তিনি বলেই চলেছেন, “দেশটার যে কি হলো, জোয়ান জোয়ান ছেলে গুলো সব মরছে। মারামারি করে মরছে, নেশা করে মরছে, সুইসাইড করে মরছে। কদিন পরে রাস্তায় শুধু আপনার আমার মত বুড়ো ছাড়া আর কাউকে দেখা যাবেনা…”

অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিলাম। এই ফাঁকে রফিক সাহেব কেটে পড়েছেন। ধ্যাত, তার কাছে যে টাকা পাই সেই বিষয়ে আর ধরতে পারলামনা। বেটা জোচ্চোর কোথাকার। জোচ্চোর এবং স্টুপিড। ৬ মাস আগে ভাতিজির বিয়ের কথা বলে টাকা ধার নিয়ে এরই মধ্যে নানাগিরি প্রচার করছে, হুহ!। প্রচন্ড রাগ লাগলেও তা নেমে গেলো। লোকটার জন্য করুনা-ই হয়। সারা জীবন একমাত্র ছেলেটার পিছনে টাকা ঢেলেছেন। ভালো স্কুল, দামী কোচিং, সেই সাথে নানা সাধ আহ্লাদ পুরন করে মাথায় তুলে রেখেছেন। আর এখন কিনা সেই নবাবের বাচ্চা রিহ্যাবে পঁচে মরছে। মান সম্মানের জন্য বাপটা কাউকে বলেওনা। কিন্তু মিথ্যা কথা বলে এর ওর থেকে ধার নিয়ে ঠিকই প্রেস্টিজের বারোটা বাজাচ্ছে।

মন খারাপ নিয়ে ক্যান্টিন থেকে ফিরে কাজ নিয়ে বসলাম। একটু পর পিওন এসে বলে গেলো বড় সাহেব ডেকেছেন, জরুরী বিষয়। তাকে জিজ্ঞেস করলাম “স্যারের মেজাজ কেমন?” “হেহে, দেইখা তো মনে হইলো বেশ রংগে আছেন”। মনে মনে একটু আশাবাদী হয়ে উঠলাম। সেই কবে কোম্পানী থেকে একটা লোনের এপ্লিকেশন করেছিলাম। ওটারই কিছু হলো কিনা… তরিঘরি করে ছুটতে গিয়ে রিসিপশনের মেয়েরটার সাথে ধাক্কা লেগে একটু হলেই বেইজ্জতি হয়ে যেত।

দরজা খোলাই ছিলো নক করে মাথা ঢুকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম “স্যার আসবো?”, উনাকে দেখলাম সেলফ থেকে ফাইলপত্র নাড়ছিলেন। আমার প্রশ্নে সাড়া দিলেন “আরে, হ্যা আসুন আসুন”। উনি কয়েকটা ফাইল হাতে নিয়ে সাইড টেবিলে রেখে চেয়ারে আয়েশ করে বসলেন, আমাকেও বসতে বললেন। “আচ্ছা আপনার গ্রাজুয়েশন কোন ডিসিপ্লিন থেকে?” উনি জিজ্ঞেস করলেন। “স্যার ইকোনোমিক্স”, উনি আবার বলা শুরু করলেন “আচ্ছা বলেন তো অর্থনীতি কত প্রকার?” আমি অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম “জি স্যার?…”, “আচ্ছা আমি বলছি শুনুন”। আমি নড়েচড়ে বসলাম “অর্থনীতি প্রধানত তিন প্রকার, ভালো অর্থনীতি- যাতে ঘুষ ছাড়াই কাজ হয়, মন্দ অর্থনীতি-যেখানে ঘুষ দিলে কাজ হয়, আর শুয়োরের বাচ্চাদের অর্থনীতি- এখানে ঘুষ দিলেও কাজ হয়না। বুঝলেন।” কথাটা আমার কেমন যেন লাগলো। “শ্যালককে নিয়ে গিয়েছিলাম পাসপোর্ট অফিসে। সে বাইরে যাবে। ডাবল মাসটার্স করার পর জ্ঞানের নানান শাখায় বিচরন করে হয়ে গেছেন নানান শাখার শাখামৃগ, হাহাহা! দালাল টালালের সাথে কথাবার্তা বলে ওটাই মনে হলো, আপনার কি ধারনা?” আমি মুখটা তেলতেলে করে বললাম”না স্যার, ওসবে তো কখনো যাওয়া হয়নি। তবে সরকারী কাজ তো বুঝেনই”, উনি এবার একটু নিচু গলায় বলা শুরু করলেন “হুম(দীর্ঘশ্বাস)।আপনার এপ্লিকেশনটা নিয়ে আমি উপরে কথা বলেছি, উনারা শুয়োরের বাচ্চা না হলেও, মন্দলোক। বুঝতে পারছেন ব্যাপারটা?” আমি শুনে পাথর হয়ে গেলাম। “জি স্যার, বুঝেছি” কিছুক্ষন নীরবতা বিনিময়ের পরে উনি আমাকে বিদায় করে দিলেন”আপাতত আসতে পারেন। এখনি আবার বেরোব তো। মনে হয়না খুব বেশি হেল্প করতে পারবো” আমি উঠে দাড়ালাম, “জি আচ্ছা স্যার” বলে চলে আসলাম।

এরপর আর কাজে মন বসেনি। এক অদ্ভুত শূন্যতার হাহাকার পেয়ে বসে। চেয়ারে ঠায় বসে পেপারওয়েটটা ঘুরাতে ঘুরাতে মন খারাপ করা গুমোট বিকেলটা কেটে গেলো। ফেরার সময় হাটাপথে যার দিকেই চোখ পড়ে তার প্রতি কেমন মমতা জেগে ওঠে আমার মনে। ভাবতে ইচ্ছে হয় সবাই যেন অসহায়ত্বের শিকার। পড়ে থাকা একটা নাম না জানা ফুল রাস্তা থেকে কুড়িয়ে নিলাম, সাথে জড়ানো রঙ্গিন কাগজ দেখে বুঝলাম যে এখন মানুষ নিরীহ ফুলটাকেও প্রয়োজনের বেশি সময় ধারন করেনা। ফেলে দেয় দলিত-মথিত হবার জন্য। এ আর নতুন কি? এনট্রপি বাড়ার মত করে সভ্যতাও ক্রমাগত বিশৃংখলায় জড়িয়ে যাচ্ছে। আমার এই ক্ষুদ্র জীবনের পাওয়া-না-পাওয়ায় কারো কিছু আসে যায়না। আনমনে এসব ভাবতে ভাবতে কখন যেন রিকশায় উঠে পড়েছি। রিকশাওয়ালা ডাকছে “স্যার, কয়টা বাজে?”। ঘড়িটা একবার দেখে জবাব দিলাম “পৌনে বারোটা”। সে বিস্মিত “কি কন স্যার? এই সইন্ধাকালে বারোটা কেমনে অয়? ঘড়ি কি নষ্ট?” আমি জানালাম “ঘড়ি ঠিকই আছে, সময়টাই নষ্ট হয়ে গেছে রে…”

রুহশান আহমেদ সম্পর্কে

ছোটবেলা থেকেই টুকটাক লিখতাম, পত্রিকায় পাঠাতাম। ছাপা হতোনা, ভাবতাম দেশে এত লেখক কেন! তারা না থাকলে হয়তো আমার লেখা ছাপাত। যেদিন ব্লগের সাথে প্রথম পরিচয় হয়, আমি যেন আকাশের চাঁদ না, আস্ত একটা গ্যালাক্সী পেয়ে গেলাম। সেই গ্যালাক্সীতেই অবিরত বিচরন, বিট বাইটের প্রহেলিকায় একটু একটু অস্তিত্ব রেখে যাওয়া... পাথর কুঁচি, পাতা বাহার, রঙ্গনে- ভীড় জমালো শৈশবেরা-  রৌদ্রহীন এই বিষন্নতার প্রাঙ্গনে।
এই লেখাটি পোস্ট করা হয়েছে গল্প, সাহিত্য-এ। স্থায়ী লিংক বুকমার্ক করুন।

6 Responses to এই সময়

  1. বোহেমিয়ান বলেছেনঃ

    গল্পটা খুব সুন্দর হইছে।

    ফরম্যাটটা কি ঠিক করা যায়?
    কথোপকথনগুলো ধরো আরেকটু ঠিকভাবে তুলে ধরলা।

  2. সামিরা বলেছেনঃ

    কী দারুণ গল্পের ফ্লো! আমি পড়তে পড়তে কয়েকবার স্ক্রল আপ করে দেখে আসছি যে লেখক কি ব্লগের কেউ নাকি সংগৃহিত লেখা। এত সাধারণ ঘটনাই এত সুন্দর করে লিখেছো, প্লটটা অন্যরকম কিছু হলে তো মাস্টারপীস হয়ে যেতো। 😀

  3. অনিকেত প্রান্তর বলেছেনঃ

    উপরের মন্তব্য দুইটা পড়ে মনে হচ্ছে, ভালো পাঠক হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে অনেক পড়তে হবে। সত্যিই, আমি ফিল করছি ব্যাপারটা। লেখাটাতো আগেই পড়েছি। ভাল্লাগেছে।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।