কুশল প্লাজার নিচের ইলেকট্রনিক্স শোরুমটার বাইরে প্রায় সবসময়ই মানুষের ছোটখাটো একটা ভিড় লেগে থাকে, তা সেটা বাংলাদেশের কোন ক্রিকেট ম্যাচই হোক অথবা স্টার জলসার ‘কিরণমালা’ সিরিজ-ই হোক। অনেকগুলো চোখ ঔৎসুক্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে কাচের ওপারে চলতে থাকা টিভির পর্দায়। অধিকাংশই বেকার শ্রেণীয় তরুণ। নিয়মিত দেখিয়েদের মধ্যে আসাদ একজন। প্রতিদিন বিকেল ৫টা থেকে সন্ধ্যা হওয়া আগপর্যন্ত আসাদ বাইরে দাঁড়িয়ে টিভি দেখে। আসাদকে অবশ্য বেকার বলা যায় না। একটা কম্পিউটার প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে কাজ করে সে। সামান্য বেতন পায়। সংসারে বাবা-মা, ছোট দুই ভাইবোন। একরকমে চালিয়ে নিচ্ছে আল্লাহ, এমন অবস্থা।
রফিক সাহেব এলাকার স্থানীয়। চাকরী-বাকরি বিশেষ কিছু করেন না। বাড়িভাড়া পর্যাপ্ত পান তাতেই বেশ চলে যায়। ভদ্রলোক প্রতিদিন বিকেলে হাঁটতে বের হন। আসাদকে তিনি গত তিনমাসে প্রায় প্রতিদিন বিকেলের সময়টাতে শোরুমের বাইরে দেখেছেন। বৃষ্টি থাকলে ছাতা মাথায় আসাদ দাঁড়িয়ে থাকে। রফিক সাহেব মিলিয়ে পান না, টিভি দেখাতে একজন মানুষের এতোটা ধৈর্য্য কীভাবে কাজ করে!
একদিন মাগরিবের আযান শেষে আসাদ যখন বাড়ি ফেরার হাঁটা শুরু করে, রফিক সাহেবের সাথে দেখা হয়ে যায়। সত্যি বলতে, রফিক সাহেবই একরকম অপেক্ষা করছিলেন, আসাদের সাথে কথা বলার জন্য।
-তারপর, টিভি দেখা শেষ হলো আজকের মতো? রফিক সাহাবের মুখে হাসি।
‘জি’, রফিক সাহেবকে না চিনলেও সালজ্জ হাসিতে মাথা নাড়ে আসাদ।
-কী দেখলেন আজকে?
‘জি!’ একটু যেন অস্বস্তিতে পড়ে যায় আসাদ।
-জিজ্ঞেস করলাম, টিভিতে কী দেখলেন আজকে। লম্বা সময় বাইরে দাঁড়িয়ে টিভি দেখেন। বিশেষ কিছু তো বটেই।
‘আসলে আমার ঠিক মনে নেই কী দেখেছি। মন দিয়ে দেখা হয় না তো তাই।’
বেশ অবাক হয় রফিক সাহেব। -‘মন দিয়ে দেখেন না! তাহলে কী করেন?’
‘টিভির দিকে তাকিয়ে থাকি ঠিক-ই কিন্তু অন্য কিছু ভাবি।’
-কী ভাবেন? কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে রফিক সাহেব।
‘বাবা মা, ছোট ভাইবোনদের নিয়ে ভাবি। সংসার নিয়ে ভাবি। অনেক কিছু নিয়েই হরেক রকম ভাবনা।’
-ওসব ভাবার জন্যই কি আপনি এখানে প্রতিদিন এসে দাঁড়িয়ে থাকেন?
‘অনেকটা সেরকম-ই। তবে খেলা থাকলে মন দিয়ে খেলাই দেখি। অন্যসময় ভাবি।’
-প্রতিদিন ভাবেন! ভেবে বিশেষ লাভ হয় কী?
‘ক্ষতি তো হয় না। ভাবতে ভালোই লাগে। নিম্নবিত্ত পরিবারের বড় ছেলেদের না ভেবে উপায় থাকে না। যেকোনো সমস্যায় বাবাকে বোঝানো লাগে, মাকে বোঝানো লাগে, ভাই-বোনদের বোঝানো লাগে। আত্মীয়-স্বজনরাও বাদ পড়ে না। কিন্তু সেই ছেলেটিকে বোঝানোর, বোঝার মতো কেবল একজন-ই আছে। তা ঐ ছেলেটি নিজেই! বাসায় লম্বা সময় ভাবার সুযোগ মেলে না। এখানে দাঁড়িয়ে নিজেকে একটু সময় দেই। পরিকল্পনা করি, নিজেকে বোঝাই, ‘ভালো সময় একসময় আসবেই, সেই সময়ের জন্যই টিকে থাকা।’ মাঝেমাঝে ভীষণ কষ্ট হয়, যখন দেখি কাছের মানুষগুলো ভুল বুঝে বসে থাকে। ছেলেদের তো চোখে পানি থাকতে নেই। তাই চোখের পানিগুলো চোখের কোণে আসতে আসতেই শুকিয়ে যায়। নিম্নবিত্ত পরিবারের বড়ছেলেদের চোখের জল স্বয়ং ঈশ্বরেরও বোধয় চোখ এড়িয়ে যায়। ব্যালকনির কোণায় দাঁড়িয়ে, ভিড়ের ফাঁকে কিংবা মাঝরাতে। তারপরও ভালো আছি। ‘ভালো সময় একসময় আসবেই।’ এই ভাবনাটাই ভালো রাখে। আমি আজকে যাই বরং।’ লম্বা পায়ে এগুতে থাকে আসাদ। দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে যায় একসময়।
রফিক সাহেবের চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ে দু’ফোঁটা জল। কিন্তু চোখের জল মোছায় তার কোন ব্যস্ততা নেই…
মধ্যবিত্তিয় মৌনতায় নিম্নবিত্তের গল্প কেন!
ভালো লাগলো।
ভালো পয়েন্ট ধরেছেন আপু! আমার কাছে ‘নিম্নবিত্ত’ শব্দটা শুনতে কেমন যেন লাগে! :/ যদিও এই ক্লাসের সংখ্যাই বেশি। নামটা ‘নিম্নবিত্তিয় মৌনতাই’ করে নিচ্ছি। কারণ লেখাটায় ঐ ব্যাপারটাই স্পেশালি হাইলাইটেড।