১৯৭০ সাল। তখন প্রযুক্তি আজকের মত এতটা অগ্রসর ছিল না। তখন টাইপরাইটারেই লেখালেখির কাজ চলতো। কোনো লেখা কপি করতে হলে ব্যবহার করা হতো কার্বন পেপারের।
সেই সময় পল ও বিল নামের দুই বন্ধু কম্পিউটার প্রোগ্রামিং নিয়ে কিছু করার চিন্তা করতেন। দুইজনেরই ছিল প্রযুক্তি নিয়ে ব্যবসায় নামার ইচ্ছে। সেজন্য নিজেদের প্রোগ্রামিং দক্ষতা কাজে লাগিয়ে তারা এটা-ওটা উদ্ভাবনের চেষ্টা করতে থাকেন।
তাদের অব্যাহত চেষ্টার ফলে ১৯৭৫ সালের ৪ এপ্রিল মাইক্রোসফট নামে এক প্রতিষ্ঠান যাত্রা শুরু করে। আজ এই প্রতিষ্ঠানই প্রযুক্তি বিশ্বে রাজত্ব করে যাচ্ছে। ব্যক্তিগত কম্পিউটারের ক্ষেত্রে বিপ্লব সৃষ্টি করেছে বিল গেটস ও পল অ্যালেনের তৈরি সেই প্রতিষ্ঠান। আর এর মূলে রয়েছে উইন্ডোজ নামের এক যাদুকরি সফটওয়্যারের ছোঁয়া।
মাইক্রোসফট কর্পোরেশনকে মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে দিয়েছে এই উইন্ডোজ। আকাশ ছোঁয়া জনপ্রিয় এ অপারেটিং সিস্টেম দিয়ে বাজিমাত করেছে টেক জায়ান্টটি। বুধবার আসছে এ সিস্টেমের ১৪তম সংস্করণ, যা উইন্ডোজ ১০ নামে পরিচিত। এরপর আর সংস্করণ না আনার কথাও বলছে মাইক্রোসফট।
চলতি বছরের জুন মাসের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ডেস্কটপ বা ল্যাপটপে অপারেটিং সিস্টেম হিসেবে বিশ্বে এখনও শীর্ষস্থানে রয়েছে উইন্ডোজ। এর মধ্যে জনপ্রিয়তার দৌড়ে সবচেয়ে এগিয়ে উইন্ডোজ ৭। বিশ্বের ৬১.০ শতাংশ ব্যবহারকারীর কম্পিউটারে ইন্সটল রয়েছে উইন্ডোজ ৭। উইন্ডোজ ৮.১ ও ৮ অপারেটিং সিস্টেমের ব্যবহারকারীর ১৬ শতাংশ।
বহুল জনপ্রিয় উইন্ডোজ এক্সপি ও কম জনপ্রিয় উইন্ডোজ ভিস্তার ব্যবহারকারী যথাক্রমে ১১.৯৮ ও ১.৬২ শতাংশ। অ্যাপলের ম্যাক ওএস ব্যবহারকারী ৭.৫ শতাংশ ও লিনাক্স ব্যবহারকারী ১.৬ শতাংশ। উইন্ডোজ অন্য আপারেটিং সিস্টেমগুলো ১৩.৮ শতাংশ দখলে আছে। এই পরিসংখ্যানই বলে দেয়, উইন্ডোজ অপারেটিং সিস্টেম ব্যবহারকারীদের মন কতটা দখল করে আছে।
১৯৮৩ সালে মাইক্রোসফট উইন্ডোজ ১.০ নামের প্রথম অপারেটিং সিস্টেম বাজারে আনে। সেটা ছিল বেটা পর্যায়ের। এরপর গ্রাফিক্যাল অপারেটিং সিস্টেমের প্রতি মানুষের ক্রমবর্ধমান আগ্রহের প্রেক্ষিতে ১৯৮৫ সালের নভেম্বরে ডস বা ডিস্ক অপারেটিং সিস্টেমের বাড়তি সুবিধা হিসেবে পরিপূর্ণ উইন্ডোজ বাজারে আসে।
এই প্রতিবেদনে উইন্ডোজ অপারেটিং সিস্টেমের যাদুকরি পথচলার আদ্যোপান্ত তুলে ধরা হলো।
উইন্ডোজ ২.০
এটি উইন্ডোজ ১.০ এর পরবর্তী সংস্করণ। উইন্ডোজ ২.০ মাইক্রোসফটের গ্রাফিক্যাল ইউজার ইন্টারফেইস ভিত্তিক অপারেটিং সিস্টেম। এতে অ্যাপ্লিকেশন উইন্ডোগুলিকে একটির উপর আরেকটি রাখার ব্যবস্থা করা হয়।
উইন্ডোজ ২.০ -তে উন্নততর কিবোর্ড শর্টকাটের ব্যবস্থা ছিল। এতে ম্যাক্সিমাইজ ও মিনিমাইজ শব্দগুলো প্রথম ব্যবহার করা হয়। এর আগে তা উইন্ডোজ ১.০-তে আইকনাইজ ও জুম নামে পরিচিত ছিল।
উইন্ডোজ ৩.০
এই অপারেটিং সিস্টেম এককভাবে কাজ করতো না। এটি এমএস-ডসের গ্রাফিক্যাল ইন্টারফেইস হিসেবে ব্যবহৃত হতো। এতে গ্রাফিক্যাল ইন্টারফেইসটি ঢেলে সাজানো হয়। এটি ইন্টেলের ৮০২৮৬ ও ৮০৩৮৬ প্রসেসরের মেমোরি ম্যানেজমেন্ট সুবিধাগুলো কাজে লাগায়।
এতে ডসের জন্য লেখা টেক্সট মোডের প্রোগ্রামগুলো উইন্ডোর মধ্যে চালানো যেতো। এটি এক সাথে একাধিক প্রোগ্রাম চালাতে সক্ষম ছিলো।
উইন্ডোজ ৩ –এ বিভিন্ন রকমের অ্যাপ্লিকেশন জুড়ে দেয়া হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলো লেখালেখির জন্য নোটপ্যাড, ওয়ার্ড প্রসেসিংয়ের জন্য রাইট, আঁকাআঁকির জন্য পেইন্ট এবং হিসাব করার জন্য একটি ক্যালকুলেটর। এছাড়া রিভার্সি খেলাটির সাথে এখানে যোগ করা হয় বহুল জনপ্রিয় সলিটেয়ার গেইমটি।
উইন্ডোজ ৩.১
৬ এপ্রিল ১৯৯২ সালে প্রিন্টযোগ্য ফ্রন্ট যোগ করে উইন্ডোজ ৩.১ উন্মুক্ত করা হয়। ১৯৯২ সালের নভেম্বর মাসে মাল্টিমিডিয়া সংস্করণ বের হয়, এতে ভিডিও দেখার সুবিধা যোগ করা হয়। এর লক্ষ্য ছিল সিডি-রমের মধ্যমে শব্দ ও ভিডিও চালু করা।
উইন্ডোজ ৯৫
গ্রাফিক্যাল ইউজার ইন্টারফেস সম্বলিত এই অপারেটিং সিস্টেম ১৯৯৫ সালের ২৪ আগস্ট মুক্তি পায়। মাইক্রোসফটের আগের অপারেটিং সিস্টেম থেকে উইন্ডোজ ৯৫ অনেক ব্যতিক্রমী ছিল এবং বাজারে আসার পর বেশ জনপ্রিয়তা পায়।
অপারেটিং সিস্টেমটি নির্মাণের সময় এর নাম দেয়া হয় উইন্ডোজ ৪.০ বা “শিকাগো”। এতেই প্রথম ফাইলের নাম ২৫৫ অক্ষরে রাখার সুবিধা দেয়া হয়।
উইন্ডোজ ৯৮
উইন্ডোজ ৯৮ গ্রাফিক্যাল ইউজার ইন্টারফেস অপারেটিং সিস্টেম। এটি বাজারে ছাড়া হয় ১৫ মে, ১৯৯৮ সালে। উইন্ডোজ ৯৫ এর পরবর্তী সংস্করণ উইন্ডোজ ৯৮। এটি ১৬ বিট ও ৩২ বিটের হাইব্রিড সংস্করণ।
উইন্ডোজ মিলিনিয়াম বা উইন্ডোজ এমই
এই অপারেটি সিস্টেমের সঙ্গে ছিল ইন্টারনেট এক্সপ্লোরার ৫.৫ ও নতুন মুভি মেকার সফটওয়্যার উইন্ডোজ মিডিয়া প্লেয়ার। এতে গ্রাফিক্যাল ইউজার ইন্টারফেইস আরও উন্নত করে জুড়ে দেয়া হয়। উইন্ডোজ এমই-তে ইন্টারনেট এক্সপ্লোরার ৬ ও ৭, আউটলুক এক্সপ্রেস, মিডিয়া প্লেয়ার ৯ -এ আপডেট করা যেত।
উইন্ডোজ ২০০০
উইন্ডোজ ২০০০ এমন এক অপারেটিং সিস্টেম যা ব্যবহারকারী ও সার্ভার উভয় কম্পিউটারে ব্যবহার করা যেত। এটির চারটি সংস্করণ ছাড়া হয়। এগুলো হলো প্রফেশনাল, সার্ভার, অ্যাডভান্সড সার্ভার এবং ডেটাসেন্টার সার্ভার। উইন্ডোজ ২০০০ সার্ভারের বাড়তি বৈশিষ্ট্য হলো অ্যাক্টিভ ডিরেক্টরি সেবা, বন্টিত ফাইল ব্যবস্থা এবং অনাবশ্যক স্টোরেজ ভলিউমের ভুল ধরা ইত্যাদি।
উইন্ডোজ এক্সপি
এই অপারেটিং সিস্টেম বিপুল জনপ্রিয়তা পায়। উইন্ডোজ এক্সপির পর উইন্ডোজ ভিস্তা এবং উইন্ডোজ ৭ বাজারে আসে। কিন্তু উইন্ডোজ এক্সপির ব্যবহারকারী খুব একটা কমেনি। এমনকি, উইন্ডোজ ৭ ছাড়া উইন্ডোজের পরবর্তী সংস্করণগুলো এতো জনপ্রিয়তা পায়নি।
উইন্ডোজ ভিস্তা
২০০৫ সালের ২২ জুলাই যখন ভিস্তার কাজ শুরু হয় তখন তা “লংহর্ন” নামে পরিচিত ছিল। ২০০৬ সালের ৮ নভেম্বর ভিস্তার নির্মাণ শেষ হয়। এর পরের তিনমাসে অপারেটিং সিস্টেমটি পর্যায়ক্রমে হার্ডওয়ার ও সফটওয়ার নির্মাতা প্রতিষ্ঠান, ব্যবসায়িক ক্রেতা এবং সাধারণ গ্রাহকদের জন্য বাজারে আনা হয়।
২০০৭ সালের ৩০ জানুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে ভিস্তার বাজারজাতকরণ শুরু হয় এবং সাধারণের হাতে চলে আসে। কিন্তু নিত্য নতুন ফিচার যুক্ত করা হলেও ধীরগতি বা নানা বাগ থাকার কারণে জনপ্রিয়তা পায়নি এই অপারেটিং সিস্টেম।
উইন্ডোজ ৭
ভিস্তার পর নানা সমালোচনার মুখে পড়তে হয় মাইক্রোসফটকে। তাই ২০০৯ সালে এটি বাজারে আনে উইন্ডোজ ৭। ৩২ বিট ও ৬৪ বিটের দুই রকমের সংস্করণে এটি বাজারে আনা হয়। এটি ২০০৯ এর ২২ অক্টোবর সারাবিশ্বের জন্য উন্মুক্ত করা হয়।
উইন্ডোজ ৭ -এ নানা নতুন বৈশিষ্ট্য যোগ করা হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো স্পর্শ সুবিধা যু্ক্ত করা, হস্তরেখা পরিচিতি, ভার্চুয়াল হার্ডডিস্ক সমর্থন, মাল্টি-কোর প্রসেসরের উন্নতি, বুট সুবিধার উন্নতকরণ, রিমোট এক্সেসের ক্ষমতা এবং কার্ণেলের উন্নত সংস্করণ।
উইন্ডোজ ৮ ও ৮.১
উইন্ডোজ ৮ সংস্করণে আগের সংস্করণগুলো থেকে অনেক পরিবর্তন আনা হয়। বিশেষ করে, এতে টাচ স্ক্রিন ইনপুটের জন্য ডিজাইনকৃত নতুন একটি স্টার্ট স্ক্রিন যোগ করা হয় যা গতানুগতিক স্টার্ট মেনু থেকে আলাদা। তবে তা গ্রাহকপ্রিয়তা পায়নি। পরবর্তীতে উইন্ডোজ ৮.১ উন্মুক্ত করা হয়। তবে এটিও জনপ্রিয়তা পায়নি।
উইন্ডোজ ১০
এতে মাইক্রোসফটের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় সব পরিবর্তন আনা হয়েছে। এই অপারেটিং সিস্টেম একই সাথে কম্পিউটার, ট্যাব ও স্মার্টফোনে কাজ করবে। পুরনো ব্যবহারকারীরা যাতে ঝামেলায় না পড়েন সে জন্য এতে থাকছে চিরচেনা স্টার্ট মেন্যু।
এছাড়া এতে থাকছে মেট্রো মুড, ভার্চুয়াল ডেস্কটপ, নতুন নোটিফিকেশন অপশন, টাচ স্ক্রিনের মতো চমৎকার সব ফিচার।
এতে উইন্ডোজ ৭ ও ৮ এর অভিজ্ঞতা কাজে লাগানো হয়েছে। এটি ২৯ জুলাই বাজারে আসতে যাচ্ছে। প্রযুক্তি বিশ্বের নজর এখন উইন্ডোজ ১০ অপারেটিং সিস্টেমে দিকে।
ইতিমধ্যে ব্যবহারকারীদের জন্য উইন্ডোজ ১০ এর বেশ কয়েকটি বেটা সংস্করণ উন্মুক্ত করা হয়েছে। বেটা সংস্করণগুলোও গ্রাহকদের কাছে জনপ্রিয়তা পেয়েছে।
লেখাটি পূর্বে প্রকাশ টেকশহর ডটকমে
long live windows.