বেনামী গল্প-১

আমি রোদের মধ্যে রোদ হয়ে যাই, ঘাসের মধ্যে ঘাস। কখনোবা মেঘের সাথেও ভাসি। আজ বৃষ্টিবেলায় একটা চিলের মসৃন পালকের গোড়ায় নরম মাংসের ওম নিয়ে বেশ ঘুমিয়েছি। বৃষ্টি কেটে যেতেই তার চোখের মণিতে উঠে বসলাম। ধীরলয়ে গোত্তা খাওয়া চিলটা এভাবেই সন্ধ্যা পর্যন্ত আকাশের গায়ে লেপ্টে রইবে। তার আগেই আমি হয়তো কোন বাসার অ্যান্টেনা কিংবা পথে পড়ে থাকা পাথরের ভাজে জায়গা করে নেবো। যদি আগে আগে চাঁদ উঠে তবে তার আলো ধরেও ঝুলে পড়তে পারি কয়েক ঘন্টার জন্য। এতকিছু এখন ভেবে লাভ কি? ওইইই দিগন্তের একটু এপাশে কেমন কালো ধোয়ার কুন্ডলী দেখা যাচ্ছে। ঘটনা কি?

নীল সমুদ্র। প্রচন্ড নীল। রোজ জোয়ার ভাটায় পা ভেজানো লোকালয় এবং স্থায়ী-অস্থায়ী দ্বীপগুলো ছাড়িয়ে বহু দূরের এই সমুদ্র। নির্লিপ্ত শুন্যতার সাময়িক নিবাস এখানে। মহাদেশীয় বাতাস এখানে এসে জিরিয়ে নেয়। কখনোবা পথ হারায়, ভুল পথে গিয়ে অন্যের সাথে লাগায় তুমুল মারামারি। সৃষ্টি হয় ঝড়। পানি, হাওয়া, রোদ, মেঘ সবই যখন রয়েছে তখন প্রাণ না থাকে কিভাবে? জলের অতলের বৈচিত্র্য যা-ই থাক। মাঝে মাঝে লাফিয়ে ওঠা ডলফিন, কিংবা তিমির ফোয়ারা এই শুন্যতাকেও নাড়া দেয়। এই মুহুর্তে অবশ্য পানিতে তীব্র আলোড়ন তুলে ভুশ করে ভেসে উঠলো একটা ডুবোজাহাজ। ব্রীজ আর অ্যান্টেনাগুলোর সাথে একটু খানি পিঠ ছাড়া বাকীটা ডুবেই রইলো। কিছুক্ষন স্থির থাকার পর পিঠের একটা ঢাকনা সরে যায়, সেটা দিয়ে বেরিয়ে আসে একটা ব্যালিস্টিক নিউক্লিয়ার ওয়ারহেড। তীর্যক ভঙ্গিতে ছুটতে থাকে আকাশের দিকে। সহস্র মানুষের মৃত্যুর পরোয়ানা নিয়ে উড়তে থাকে। ডুবোজাহাজের ভেতরের যে দুজন মানুষ চাবি আর বোতাম চেপে একে মুক্ত করলো। তাদের হাত একটুও কাঁপেনি বলেই শুনেছি।

দুপুরের ভাতঘুম দিয়েছে এক মা তার ছেলেকে বুকে জড়িয়ে। ছেলেটা বিরক্ত, এই অসময়ে তাকে জোর করে ঘুম পাড়ানো হচ্ছে তাই। ধীরে ধীরে মায়ের নিঃশ্বাস গাঢ় হয়ে আসলে ছেলেটা হাতের বাধন থেকে নিজেকে মুক্ত করে নিলো। অডিও প্লেয়ারে মৃদু ভলিউমে শাহনাজ রহমতুল্লাহর গান ছেড়ে দিয়ে সে বের হয়। এদিক ওদিক ঘুরাঘুরি করে সে চলে এলো পুকুরধারে। কিছুক্ষন ফড়িং এর পিছে ছোটাছুটি করে পানিতে ঢিল ছোড়া শুরু করলো। কার কাছে যেন এক অভিনব উপায়ে ঢিল ছোড়া দেখেছিলো। সেও চেষ্টা করছে কিভাবে ঢিলটা ছুড়লে পানির গায়ে ব্যাঙ্গের মত লাফাবে। অনেক কায়দা কানুন করেও হচ্ছেনা। আমি তখন চিলের চোখে, দিগন্ত ভেদ করে একটা ধোয়ার রেখার ছুটে আসা দেখছি। ঘটনা ভালো নয় বুঝতে পেরে চিলের পিঠ ছুয়ে লেজ হয়ে আবছা রংধনু বেয়ে নেমে এলাম পুকুরধারে জারুল গাছটার মগডালে। সেখান থেকে মাটিতে নেমে একটা চ্যাপ্টা ইটের টুকরা হয়ে পড়ে থাকলাম। ছেলেটা আমায় দেখতে পেলো। হাতে তুলে নিয়ে তিন আঙ্গুলে ধরে পানির প্রায় সমান্তরাল কোনে ছুড়ে দিলো। আমি তুমুলবেগে ঘুরতে ঘুরতে পানিতে আছড়ে পড়লাম, ভরবেগের কারনে ডুবে না গিয়েই আবার লাফিয়ে উঠলাম। আমার দেখাদেখি ছেলেটাও খুশিতে লাফাতে শুরু করলো। সে অভিনব উপায়ে ঢিল ছুড়তে পেরেছে। আমিও লাফাচ্ছি, সেও লাফাচ্ছে। তবে আমি জলে আর সে স্থলে। আমার লাফের দূরত্ব কমে এলো। একসময় টুপ করে ডুবে গেলাম। শেষ মুহুর্তে দেখতে পেলাম নরক নেমে এসেছে।

রুহশান আহমেদ সম্পর্কে

ছোটবেলা থেকেই টুকটাক লিখতাম, পত্রিকায় পাঠাতাম। ছাপা হতোনা, ভাবতাম দেশে এত লেখক কেন! তারা না থাকলে হয়তো আমার লেখা ছাপাত। যেদিন ব্লগের সাথে প্রথম পরিচয় হয়, আমি যেন আকাশের চাঁদ না, আস্ত একটা গ্যালাক্সী পেয়ে গেলাম। সেই গ্যালাক্সীতেই অবিরত বিচরন, বিট বাইটের প্রহেলিকায় একটু একটু অস্তিত্ব রেখে যাওয়া... পাথর কুঁচি, পাতা বাহার, রঙ্গনে- ভীড় জমালো শৈশবেরা-  রৌদ্রহীন এই বিষন্নতার প্রাঙ্গনে।
এই লেখাটি পোস্ট করা হয়েছে গল্প, হাবিজাবি-এ। স্থায়ী লিংক বুকমার্ক করুন।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।