বাচ্চাবেলার সবচেয়ে অসাধারণ ব্যাপার হলো বাচ্চারা পৃথিবীটাকে দেখে তাদের নিজেদের চোখ দিয়ে। তখনো তারা সবকিছুর নাম জানে না। তারা দেখে আর বিস্মিত হয়। প্রিয় খেলনাটা আঁকড়ে ধরে রাখে, একসময় নিজেই ভেঙে ফেলে, আর ফিরেও তাকায় না। প্রতিটা জিনিসের আলাদা আলাদা নাম জানতে শুরু করলে পৃথিবীটা আর ম্যাজিকেল থাকে না, বড়ো বেশি বাস্তব হয়ে ওঠে। বড়ো হতে হতে তারা অসংখ্য মানুষের দূরবীনে চোখ রেখে পৃথিবীটাকে দেখতে দেখতে একসময় ভুলেই যায় তাদেরও নিজস্ব চোখ ছিলো, তাদেরও নিজস্ব দূরবীন থাকতে পারতো- সে দূরবীনে চোখ রেখে অন্য কেউ হয়তো পৃথিবীটা দেখতে পারতো। অন্যের দূরবীনের প্রশংসা করতে করতে তারা নিজের দূরবীনে চোখ রাখতে ভুলে যায়। আত্মবিশ্বাসের ভীষণ অভাব আর ভয়- একসময় সে নিজেই আর মনে করতে পারে না আদৌ তার কোনও দূরবীন ছিলো কিনা, তাতে চোখ রাখলে অন্যরকম কিছু দেখা যেতো কিনা। দুর্ভাগ্য হচ্ছে বড়ো হতে হতে নিজের ছায়ার চেয়ে ছোটো হয়ে যাওয়া। অথচ এই ছোটো হয়ে যাওয়া নিয়ে গর্ব করা।
কিছু কিছু মানুষকে অবশ্য কখনোই সিস্টেমে বেঁধে ফেলা যায় না। এই মানুষগুলোই নিজস্ব দূরবীন তৈরি করতে পারে যা দিয়ে তারা নিজেদের পৃথিবীটাকে দেখে, ব্যাখ্যা করে এবং অন্যদের দেখতে দেয়। না, আমি শুধু বিখ্যাত ব্যাক্তিদের কথা বলছি না। খ্যাতি কখনো স্পর্শ করে নাই এমন অনেক মানুষও অসাধারণ চোখ দিয়ে পৃথিবীটা দেখে গেছেন কিংবা দেখছেন। তাদের জীবনটা সাধারণ হতে হতেও তাদের এই দৃষ্টিভঙ্গির কারণেই হয়ে গেছে ভীষণ রকম অসাধারণ। আমার মা মাঝে মাঝে অনেক অদ্ভুত গল্প শোনান। একটা গল্প ছিলো বহলুল পাগলকে নিয়ে। বাদশাহ হারুন অর রশিদ যখন ক্ষমতায় ছিলেন তখনকার ঘটনা। (আমরা কখনো জানতে চাই নাই বাদশা হারুন অর রশিদ কোথাকার শাসক ছিলেন কিংবা এটা কতো দিন আগের কথা।) বহলুল পাগল সম্পর্কে আমরা তেমন কিছুই জানি না, আম্মুও না। শুধু জানি সে সারা রাজ্য ঘুরতো আর ‘বেহেস্ত কিনবেন, বেহেস্ত?’ বলে চিৎকার করতো। পাগলের পক্ষে বেহেস্ত বিক্রি করা সম্ভব বলে আমরা কেউ অবাক হই না। আমরা অবাক হই যখন বাদশা হারুন অর রশিদের স্ত্রী জোবেদা তার গা থেকে মহামূল্যবান অলংকার খুলে বেহেস্ত কিনতে চায় তখন। বেহেস্তের নামে বহলুল পাগল তাকে যা দেয় তা মূলত হিজিবিজি লেখা কয়েক তা কাগজ। আমরা ধরে নেই সেটা বেহেস্তের দলিল। মহামূল্যবান অলংকারের বিনিময়ে অর্থহীন কাগজ কেনায় বাদশা তার স্ত্রীর ওপর ক্ষিপ্ত হয়। তারপর কিছুদিনের মধ্যেই জোবেদা মারা গেলে বাদশা প্রায় রাতেই স্বপ্ন দেখতে শুরু করে মরার পরে জোবেদা মহাসুখে আছে (আমরা বুঝতে পারি সে বেহেস্তে আছে)। বাদশা অনেক চেষ্টা করেও জোবেদার কাছে যেতে পারে না। সে আহাজারি করে, অভিযোগ করে। তখন জোবেদা জানায় এই বেহেস্ত সে নিজে কিনেছে, এখানে বাদশা প্রবেশ করতে পারবে না। নিয়মিত একই স্বপ্ন দেখতে দেখতে ক্লান্ত, নিজের যুক্তির কাছেই পরাজিত বাদশা লোক পাঠান বহলুল পাগলের খোঁজে। অনেক চেষ্টার পর তাকে খুঁজে পাওয়া গেলে ভীষণ নাটকীয়ভাবে সব সম্পত্তির বিনিময়ে বাদশা তার কাছ থেকে বেহেস্ত কিনতে চান। ভাবলেশহীন অথচ আরও নাটকীয়ভাবেই বহলুল পাগল জানায় পুরো দুনিয়ার বিনিময়েও বেহেস্ত কেনা সম্ভব না। বাদশা এবার জানতে চান তাহলে কিসের বিনিময়ে বেহেস্ত কেনা সম্ভব। তখন বহলুল পাগল জানায়- বেহেস্ত কেনা যায় সরল বিশ্বাসে। গল্পটা এখানেই শেষ।
দুঃখের ব্যাপার হলো কখনো কখনো কেউ কেউ বড়ো হয় অবিকল তাদের বাবা অথবা মা’র জীবন পুনরায় যাপন করার জন্যে। অবশ্যই তারা সেটা বুঝতে পারে না, কারণ বুঝতে পারলে একই জীবন যাপন করতে তাদের ক্লান্তি লাগতো। শেষটা কী সেটা জানা থাকলে কোনো মুভি দেখতে যে কারণে আগ্রহ জন্মায় না, ঠিক সেই কারণে। এখন অবশ্য সময়টা ভীষণ অবিশ্বাসের। তাই শেষটা কী সেটা জানা থাকলেও মুভিটা অনেকেই দেখবে শুধু বিষয়টার সত্যতা পরীক্ষা করার জন্যে। অবিশ্বাস করা ছাড়া আর কীই বা করার আছে? কেননা “আমরা এমন একটা পৃথিবীতে বাস করছি, যেখানে বাহ্যিক উপাদানগুলো এতো শক্তিশালী যে মানুষের অন্তর্গত উপাদানগুলোর আর কোনো গুরুত্ব থাকছে না। এমন একটা পরিস্থিতিতে ব্যক্তি মানুষের আর কি সম্ভাবনা অবশিষ্ট থাকে?” কথাটা মিলান কুন্দেরার। কথা হছে, মানুষের আচরণের পেছনে কী ধরণের অন্তর্গত তাগিদ কাজ করে সেটা খুঁজে আর লাভ নাই।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কাজ হওয়ার কথা ছিলো প্রত্যেক মানুষকে নিজের জন্যে ভাবতে শেখানো। কিন্তু আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য আমাদের ট্রেইন করা। তুমি কি আধঘণ্টায় একটা ওয়ার্ড ফাইল, একটা পাওয়ার পয়েন্ট ফাইল, আর একটা এক্সেল ফাইল তৈরি করতে পারো? কতো দ্রুত একটা অংক করতে পারো তুমি? তুমি কি ঠিকঠাক হোম ওয়ার্ক, অ্যাসাইনমেন্ট করতে পারো? কতো ভালো মুখস্ত করতে পারো তুমি? (না পারলে তুমি অযোগ্য)। তুমি কি জানো কখন কোথায় কী বলতে হয়? ঠিক মতো ব্যবহার করো, ডিসিপ্লিন বজায় রাখো, হাজার হোক তোমাকে একটা সোসাইটিতে থাকতে হয়… চাইলেই যা খুশি তাই করতে পারো না তুমি। লুকাও, গোপন করো, বিষণ্ণ হও, রাগ করো, অভিমান করো কিংবা ক্ষিপ্ত হও- কিন্তু দয়া করে একাডেমিক বিষয়গুলো মেনে চলো, ভদ্র থাকো। অন্তত ভদ্রতার অভিনয় তো করতে পারো, নাকি?
সমস্যা হলো আমি এসব কিছুই করতে চাই নি। শুধু একটা চিৎকার দিতে চেয়েছিলাম। গলা খুলে। নিজের আওয়াজ নিজে শুনতে চেয়েছিলাম ভালো করে। কিন্তু চারপাশে অনেক মানুষ থাকায় সম্ভব হয় নি। চারপাশে অনেক মানুষ ছিলো, তবু কোথাও কোনো উষ্ণতা ছিলো না। গ্লোবাল ওয়ার্মিং? পৃথিবীটা শীতল থেকে শীতলতর হচ্ছে।
আপনার দূরবীনটা কি আছে না হারিয়ে গেছে?
আছে! 🙂