বাঙালির প্রতি বাঙালির আচরণ- এই মর্মে শুরু করিলাম

মানুষটা স্যুট-প্যান্ট-টাই পরিপাটি সাজে নিজের কনফিডেন্ট মুখভঙ্গিটাকে নিয়ে সার্ভিস দিতে বসেছেন। তিনি নিজে এক জাতির, এবং কাজ করছেন (বা সার্ভিস দিচ্ছেন) অন্য জাতির জন্যে, অন্য জাতিদের মধ্যে। এই দিয়ে চলা সার্ভিসের মাঝে হঠাৎ হঠাৎ এমন গ্রাহকও এসে পড়ে যারা কিনা সার্ভিস দেওয়া এই মানুষটিরই স্বজাতি। কথা বলছি বিদেশ বিভূঁইয়ে দেখা বাঙালি কাম ‘মানুষের’ বিচিত্রতার কিছু আশ্চর্য অপূর্ব অভিজ্ঞতার।
সবার মধ্যে সবাই সমান না। আর সমান না হওয়া বাকি এইসব অসমতার রঙই মাঝে মাঝে তির্যকের মতো তীব্র হয়ে থেমে যায় চোখে, মনে।

 

এখন সামনে দাঁড়ানো গ্রাহকটি বাঙালি। তার তরফ থেকে একটা প্রশ্নের জিজ্ঞাসা হলো— আধ-ভাঙা ইংরেজিতে। প্রশ্নের জবাবে সার্ভিস প্রদানকারী (যিনিও বাঙালি এবং তরুণ) তার কণ্ঠে কথনে খাপস্থ করা বিশ্বের দ্বিতীয় জরুরী ভাষার ফুলঝুরি ফোটাতে শুরু করেছেন। কিছুপর সেই ঝুরি আরও ফুটে উঠে, তারপর বিছিয়েই যেতে শুরু করে আশেপাশের সমস্ত গায়েবী উপস্তিতির স্বীকৃতিকরুণা প্রার্থনায়- “আহা কী ভালো ইংরেজি ঝাড়ে, থুক্কু, বলে! নিজেকে ছোটটিই মনে হয় বড্ড- কীইবা আমি তার সামনে! এই দেখো না, লজ্জায় ভুলেই গেছি যে কী যেন সেই প্রশ্নটা করেছিলাম?!”
কিছুক্ষণ আবার ভেবে আধ-ভাঙা ইংরেজি বলা সার্ভিস নিতে আসা এই স্বজাতি বাঙালি প্রশ্নটা আবার করবার আগে কিছুটা বিব্রত হয়- “এবারও কি পুরো বুঝবোনা যা বলবে!? আবার জিজ্ঞাসা করলে আমার জানার কমতি নিয়ে হাসবে না তো মনেমনে!?”
দ্বিধা আর সংকোচ, মাঝে মাঝে আপনের চেয়েও আপন হয়ে পাশে দাঁড়ায়। ওরা বলে-
“এবেলায় তবে তুমি বরং মাথা নেড়েই স্বস্তি নাও।”

হ্যাঁ, ঠিক তাই। তারপর সেই আধ-ভাঙা ইংরেজি বলা বাঙালি মানুষটা সেদিনের জন্য মাথা নেড়ে ‘সব বুঝেছি’ সায় জানিয়ে মুখটা বাঁচিয়েছিলো, এবং অপেক্ষা করেছিলো ‘বিজাতি’ আরেকজন সার্ভিস প্রদানকারীর জন্য- যিনি কিনা ওইই প্রথমদিন অত্যন্ত নমনীয়তা আর শ্রদ্ধার সাথে এই আধ-ভাঙা ইংরেজি বলা বাঙালিকে সেটুকু বোঝাতেই সক্ষম এবং যোগ্য ছিলেন, যেটুকু বাঙালি মানুষটির জিজ্ঞাসা ছিলো। তাকে ‘ইংরেজি বলতে পারার দম্ভ আর ইংরেজি না বলতে পারার সংকোচ’ এই দু’টোর মাঝখানে এতোটুকু হয়ে যেতে হয়নি। বাঙালি মানুষটা সেদিন হাসিমুখে, ভালো এবং বৈষম্যহীন আচরণপ্রাপ্তির প্রশান্তি নিয়ে, নিজের অনুসন্ধানের তথ্যসমেত বাড়ি ফিরেছিলো। মনেমনে আত্মবিশ্বাসও জুগিয়েছিলো, “আরেহ, শুনতে শুনতে বলতে বলতেই হয়ে যাবে ইংরেজিটা (তাতে কী হয়েছে যে, আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন বিবিএ স্তরের শিক্ষার্থী এবং তা-ও সমস্ত বিষয় যেখানে ইংরেজিতেই আমাদেরকে পড়তে হয়েছে)!” বিদেশ-বিভূঁইয়ে এসে নিজের ইংরেজি জানার পটুতায় আর বিদেশিদের ইংরেজি উচ্চারণ বুঝে কথা বলার পটুতায় পার্থক্য এসে যায়, তা সে যে অতিমানবই হোক না কেন।

 

তবে, তুলনার ব্যাপারটা শুধুমাত্র ইংরেজি ভাষার সাথেই নয়। বরং, শুধু ভাষা বলবো। যেকোনো ভাষার সাথে নিজের মায়ের ভাষার। নিজের মাতৃভাষা জানা- বলতে পারাটা যেরকমই স্বাভাবিক, সেরকমই স্বাভাবিক অন্য দেশের মায়ের ভাষা বলতে না পারাটা। এটা লজ্জার বিষয় নয়। বিষয়টা সহজ, সাধারণ জ্ঞানের। এখানে (আমেরিকায়) আরও দেশের মানুষ থাকে। তারা সবাইতো ইংরেজি ঠিকভাবে বলতে পারে না। কিন্তু তাতে তাদের সংকোচ কিংবা খারাপলাগাটাও অনুভূত হয় না। বরং তারা হাসিমুখে তাদের অপারগতাকে এমনভাবে প্রকাশ করে যে, এটাই স্বাভাবিক। ব্যক্তিগত আগ্রহ নিয়ে অন্য ভাষা শেখার বাইরেও কথা বলায় সহায়তার জন্য দোভাষী কিংবা ট্রান্সলেটর-ইন্টারপ্রেটার আছে এখানে। যেমন ধ্যান-ধারণার পোষণ, তেমনই ব্যবস্থার গ্রহণ— এটাই স্বাভাবিক।

ভাষা ছাড়াও নানান ধ্যান-ধারণা পোষণে, জাতি হিসেবে আমাদেরকে আমি সরাসরি নিচু বা ছোটলোক জাতি বলে আখ্যায়িত করতে পারছি না। কারণ কিছু কিছু পর্যায় বা জায়গা আছে যেখানে এমন আরোপ এর পেছেনে থাকা যুক্তিগুলোকে খুব নমনীয়ভাবেই খণ্ডন করা যায়। তবুও মানুষের চিন্তার জটিলতা, জটিল চিন্তামূর্তির বীজধারণ, জটিলতার প্রতি আত্ম-অহমিকার প্রতি অদম্য কৌতূহল জন্মানো ও এই জন্মকে এযুগীয় সফল জন্মশ্রেণী হিসেবে নিরন্তর উৎসাহ ও প্রশ্রয় দেবার মাধ্যমে একে সাবলীল এবং হতে চলা-গতানুগতিক প্রণোদনার স্বরূপ হিসেবে তৈরি হতে দেওয়া কি মোটেই উচিত?
কিন্তু তবু, বাংলা ভাষা নিয়ে আমাদের বাঙালি জাতির মধ্যে একটা উদ্ভট হীনমন্যতা বরাবরই কাজ করছে, বহুকাল থেকে। দামী ভাষা, উৎকৃষ্ট ভাষা, বড়োলোকী ভাষা- এসব কেবল বাংলা ছাড়া আর যেকোনো ভাষারই বিশেষণ হতে পারে, অধিকাংশের মনমতে— “ছ্যাঃ ছ্যাঃ বাংলা! দু’একটা বিলিতি ইংরিজি ছাত্তে পাল্লে নিজেকে যে ‘কী হইনু’ লাগে, আহা!” এমনকি এখানে (আমেরিকাতে), বাঙালিই বাঙালির সামনে বাংলা বলতে শরম পায়, মা!

৩ বছর হয় এইসপ দেখিনু আর হাঁপিয়া উঠিনু, হায়!

কতো দেশ আছে, প্রদেশের সব ভাষা মিলেঝিলে যেসব দেশে  মায়ের ভাষা প্রজন্মের ভাষারূপে ঠাই পায়। আর আমরা, যুদ্ধও করেছি যার জন্যে— একটাই সেই ভাষা, তাও একখানে ঠাই দিতে পারিনি এখনও!

 

সন্তানের বীজ রোপণের কাল থেকেই কিছু বাঙালি বিজাতিপ্রাণ অথবা, অতিজ্ঞানশয় মূর্খ (না জানি নিজকালে কী ছিলে, অথচ) সন্তানের কালে আপনাকে এবং আপন বিচারকে উৎকৃষ্ট উদাহরণের স্বরূপ মানিয়া অনুসরণ করিয়া সন্তানদিগকে খাইতে এবং গিলিতে বলিয়া থাকেন। ইহা কি এক প্রকার হঠতা শঠতা নয়— আপন সন্তানের সাথেই?

সুন্দর মানুষের পরিচয় তো সেখানেই, যেখানে সে তার ভুল এবং তিক্ত অভিজ্ঞতাকে অনায়েসে অপারগতার সাথে বলতে পারে। অতীতের অভিজ্ঞতাস্বরূপ আজ আমাদের ভুলের সহজসত্য স্বীকারোক্তির সাথেই তো আগামীকাল তার নিজ উপলব্ধি মিলিয়ে পরিপূর্ণ করবে প্রজন্ম-প্রজন্মান্তরের শিক্ষণকে— তাই নয় কি?

 

কণ্ঠে কথনে খাপস্থ করা বিশ্বের দ্বিতীয় জরুরী ভাষার ফুলঝুরি ফোটানো ঐ বাঙালি তরুণদের মতো আরও—

কিছু অপদার্থ একই প্রক্রিয়ায় আমার দেশে জন্মায়। তারপর দেশটাকেই অ-পদার্থ ভেবে নিজেকে পদার্থরূপে তৈরি করবার জন্য পাড়ি জমায় বিদেশ-বিভূঁইয়ে। কিন্তু সেখানে গিয়েও, তারা তাদের অপদার্থতাকে পরিপূর্ণ করে বিচিত্ররকম এক হাইব্রিড অ-পদার্থে।

(না পারলে নাই, আর যদি পারো তাহলে পারার মতো পারো)
তুমি যে কাজের ভার তুলে নিতে চাচ্ছো আজ, সমাজ তোমাকে সাদরে সম্মানে তোমার সেই ইচ্ছের পোশাকে রাঙাবে, পড়াবে। তোমার ইচ্ছে, তোমার সেই কাজটিকে যদি কাজের দায়িত্ব হিসেবে নিষ্ঠার সাথে তুমি পালন করতে না পারো, তবে শুধুমাত্র বাইরের ঐ পোশাক-সাজসজ্জা-মুখভঙ্গিমা-কথায় জীবনের কোনো অথবা, বিন্দুমাত্র অর্জন তোমার জন্য সঞ্চিত নেই।

 

 

(ডায়েরি- ৫ই সেপ্টেম্বর, ২০১৫)

পেন আর্নার সম্পর্কে

।। পূর্ণ হতে চাইনি তাই পূর্ণতার খোঁজ করি অপূর্ণতাই থেকেছে পাশে তাই অপূর্ণতার কাছে ঋণী ।। আমি স্বপ্নবিলাসী নই। স্বপ্ন দেখি, দেখতে জানি তাই। কিন্তু তার চেয়ে বাস্তবতা আমার কাছে খুব বেশি প্রাসঙ্গিক। আমার ব্যর্থতা আছে- স্বপ্ন বাস্তবায়নে, ধৈর্য ধারণে! তাই কিছু স্বপ্নকে শুধু শব্দের মাঝে বাঁচিয়ে রেখেছি। স্বাভাবিক, সেগুলোর বাস্তব রুপ নেই! দেশ গঠনে তরুণ সমাজের বিশ্বাসের ওপর আস্থা রাখি। তবুও, প্রত্যেক শ্রেণীর মানুষেরই প্রয়োজন আছে সমাজে। একজন মুচিরও। দেশকে গড়তে গেলে রাজনীতিতে নামতেই হবে, একথা অযৌক্তিক। একজন ঝালমুড়িওয়ালাও ঝালমুড়ি বিক্রি করে দেশ গঠন করতে পারে। শর্ত হল সততা। প্রত্যেক মানুষ নিজ নিজ অবস্থান থেকে কর্মে সৎ থাকলে সত্যিই দেশ গঠিত হবে। নিজের সম্পর্কে কাটখোট্টার মতো বলতে গেলে এটাই বলবো যে, 'জাতে মাতাল তালে ঠিক' গোছের মানুষ আমি। যেখানে যেমনটা হওয়া দরকার। কম কথা এবং যথাযথ কথা বলা পছন্দ করি। সবার কথার কম-বেশি মূল্য আছে, এটা বিশ্বাস করি। ছোট হোক, বড় হোক সব কর্মেই আমি মহা সিরিয়াস হয়ে থাকি (but rather, it's better to be sincere than being damn serious), কিন্তু সিরিয়াসনেসের একটু ওপরে থাকে আমার অলসতা। :) ফেসবুকে ভাড়া আছি যেই ঠিকানায়ঃ সেটা আপাতত গোপন-ই থাক। শুভকামনা, সকল প্রাণীর জন্য।
এই লেখাটি পোস্ট করা হয়েছে অনুপ্রেরণা, ইতিবাচক, উদ্যোগ, চিন্তাভাবনা, সচেতনতা-এ। স্থায়ী লিংক বুকমার্ক করুন।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।