বিবেকহীন মৃত্যুময়তা আর অসহায় কিছু ভবিষ্যৎ জোছনা

আজকে বৃষ্টিটা একটু বেশিই জ্বালাতন করছে। বৃষ্টির জলে কাদামাটি হয়ে গলির সংকীর্ণ রাস্তাটা পুরো এলেবেলে হয়ে আছেছ। তারপরও রাস্তাটাতে মানুষের চলাফেরা কমছে না।

মায়ের জন্য ওষুধ কিনতে বেড়িয়েছে নেহাল। সকালে কিনে নিয়ে আসার কথা ছিল কিন্তু বৃষ্টি ঝাপটাটা সকালে বেশী থাকার কারণে নিয়ে আসা হয়নি। দুপুরের দিকে একটু বৃষ্টি কমে আসার পর এখন ছোট ছাতাটা নিয়ে বের হয়েছে সে।

আজকেই নেহাল নতুন চাকরীতে জয়েন করেছে । শুরুর দিককার সেলারি খারাপ না। আস্তে আস্তে সেটা আরো বাড়বে। মা-ছেলে দুজনের ভালোই কেটে যাবে তাতে। এবার মায়ের স্বপ্ন পূরণ করবে সে। তার মা অনেক কষ্ট করেছেন তার জন্য। নিজে ভালমন্দ না খেয়ে ওকে খাইয়েছেন। এর ঘরে ওর ঘরে কাজ করে যা পেয়েছেন তাই দিয়ে ওকে মানুষ করার চেষ্টা করেছেন। ছেলেটা যাতে ভালো করে পড়াশুনা করতে পারে তার জন্য তিনি কোন কমতি রাখেননি। নেহালও তার মায়ের স্বপ্ন বৃথা যেতে দেয়নি। সদ্য গ্রাজুয়েশনটা শেষ করে এখন নতুন একটা চাকরীও পেয়ে গেছে। তার অনেক স্বপ্ন একটা সুন্দর ঘর হবে সেখানে মা-ছেলে দুজনে আনন্দে থাকবে। সারাজীবন তার যে মা কষ্ট করেছেন সেই কষ্ট কিছুটা হলেও ঘোচানোর সময় এসেছে তার। সময় এসেছে মায়ের মুখে হাসি ফুটানোর। কয়দিন যাবত মায়ের ভীষণ জ্বর। সেদিন মাকে ডাক্তার দেখিয়ে নিয়ে এসেছে সে। ডাক্তার আপাতত কিছু ওষুধ দিয়ে কয়েকটা টেস্ট করতে দিয়েছে। বিকেলের দিকে টেস্টের রিপোর্ট নিয়ে আসবে। গলির মোড়েই ফার্মেসীর দোকানটা। একটু হেঁটে গেলেই হবে।

আনমনে হাঁটার মধ্যে পাশ দিয়ে সাঁই করে খুব দ্রুত ভেগে একটা গাড়ি পাশ কাটল নেহালকে। খুব জোরে সাউন্ড বাজিয়ে যাচ্ছে; বড়লোকের ছেলে হবে হয়তো। বৃষ্টির পানিতে জমে থাকা কাদা ছলাৎ করে পড়লো তার কাপড়ে। কষে একটা গালি দিতে ইচ্ছে করলো। বড়লোকের পাগলা ছেলেরা গাড়ি নিয়ে বেরোলে এরকমই হয়। এতো জোরে এই সরু গলিতে কেউ গাড়ি চালায়। আরেকটু হলেই বড়লোকের ছেলেটা গুঁড়িয়ে দিতো গরীব মায়ের এই সন্তানকে। ছাতাটা বন্ধ করে রাস্তার একপাশে দাঁড়িয়ে কাপড়টা ঝেরে কাদা গুলো পরিষ্কার করার চেষ্টা করলো। কাদা ঝেরে গেলেও কাপড়ের ভেজাটা স্পষ্টই রইলো। তড়িঘড়ি করে আবার হাঁটা শুরু করলো মোড়ের ফার্মেসীটার উদ্দেশ্যে। তাড়াতাড়ি ঘরে যেতে হবে, ও দিকে মা আবার একলা ঘরে। ফার্মেসীর কাছাকাছি আসতেই দেখল দোকানের সাটার লাগানো। কপাল খারাপ তার। এখন বড় রাস্তাটাতে যাওয়া ছাড়া আর কোন উপায় নেই। এই দিকটায় আর কোন ফার্মেসী নেই। বড় রাস্তার ধারে বেশ কয়েকটা ফার্মেসীর দোকান আছে। ওখানেই যেতে হবে এখন। ছাতাটা টাঙ্গিয়ে কাদামাখা রাস্তায় আবার হাঁটা শুরু করলো সে।

বড় রাস্তার কাছাকাছি চলে আসার পর রাস্তাটার মুখেই কিছু মানুষের জটলা দেখা গেল। উৎসুক হয়ে কি ঘটনা হয়েছে দেখার জন্য ঐ দিকটায় এগুলো নেহাল। জটলার ভিড়ে কিছুই দেখা যাচ্ছিল না সামনে। ভিড়টা একটু টেলে সামনে গেল। ৩ টা ছেলেকে কারা যেন বেধড়ক মার মেরেছে। নিস্তর হয়ে বৃষ্টির কাদা মাটিতে পড়ে আছে তাদের দেহ। পাশের একজনকে জিজ্ঞেস করতে সে বলল ছিনতাইয়ের কারণে নাকি এলাকার মানুষ এদের পিটিয়েছে। পুলিশে খবর করা হয়েছে, তারা আসছে এদের নেয়ার জন্য। কার ছিনতাই হয়েছে, কিভাবে হয়েছে নির্দিষ্ট করে কিছুই বলতে পারলো না লোকটি। কেউই ছেলেগুলোর ধারে কাছে ঘেঁষছে না। মরে আছে না বেঁচে আছে তাও দেখার চেষ্টা করছে না। সবাই দূর থেকে দাঁড়িয়ে নিশ্চুপভাবে তামাশা দেখছে। নেহালের কেমন যেন খারাপ লাগলো ছেলেগুলোর জন্য । এক মুহূর্তের জন্য তিনটি নিথর দেহকে নিষ্পাপ মনে হলো তার। সে কাছে গিয়ে দেখার জন্য ভিড়টা টেলে ছেলেগুলোর পাশে চলে এলো। তাদের কাছাকাছি এসে হাঁটুগালা দিয়ে বসল সে। তাদের শরীরে হাত যাবে অমনি পিছন থেকে কে একজন বলে উঠলো এই ব্যাটাও মনে হয় এদের সঙ্গী। একেও পেঠানো দরকার। বলতে দেরি হয়নি শুরু হয়ে গেল নেহালের উপর অমানবিক অত্যাচারের প্রথম দফা কিল-ঘুসি! কিছুক্ষন আগে নিশ্চুপ থাকা মানুষগুলোও যেন এখন একেকটা হিংস্র প্রাণী হয়ে উঠেছে। নেহালকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই একের পর এক লাথি-কিলে বৃষ্টির কর্দমাক্ত জলে ফেলে দিল মানুষরূপী জানোয়ারগুলো। গনহারে মারতে লাগলো তাকে। উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছিল কিন্তু একসাথে শত শত হাত আর পায়ের মধ্যে উঠার শক্তিটুকুও হারিয়ে ফেলেছিল সে। এইসব নর পশুর ভিড়ে নিজেকে অনেক একা আর অসহায় মনে হচ্ছিল নেহালের। হঠাৎ কে যেন নেহালের মাথায় কিছু একটা দিয়ে যেন সজোরে আঘাত করলো। নেহালের কাছে তখন পৃথিবীটা ঝাপসাময় হয়ে এলো। আবছা অন্ধকারের মতো নেহাল বৃষ্টির ফোটাগুলোকেও ঝাপসা দেখছিল। এক মুহূর্তের জন্য অসুস্থ মায়ের চেহারাটা মনে হলো তার । অস্ফুস্ট স্বরে মা মা উচ্চারণ করতে লাগলো সে। আস্তে আস্তে সেই অস্ফুস্ট স্বরও ক্ষীণ হতে লাগলো। একসময় অস্ফুস্ট মা আওয়াজটিও হারিয়ে গেল আবছা অন্ধকারে হৃদয়হীন খুনীদের ভিড়ে। কর্দমাক্ত জলে পড়ে রইলো নিথর দেহ আর নেহালের ছাতাটি।

পুনশ্চঃ গত ২৭ জুলাই নৃশংসভাবে মিলনকে হত্যা করে মানুষরুপী জানোয়াররা। মিলন হত্যার ১০ দিন পূর্বে ডাকাত সন্দেহে হত্যা করা হয় সাভারের আমিন বাজারের ছয় ছাত্রকে। এরই ভিত্তিতে গল্পটির সৃষ্টি।

আইন-আদালতসহ সব পর্যায় এখন চলছে দলীয়করণের মদদে। মৌলিক মানবাধিকার পর্যন্তও লঙ্ঘিত হচ্ছে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় । এই সবকিছু ঠিক না হলে এসব নৃশংস হত্যাযজ্ঞের শেষ কোনদিনই হবে না। 

অচেনা রাজ্যের রাজা সম্পর্কে

রাজা-প্রজা সবাই থাকবে নির্বিশেষে, পাল্টে দেবে দুনিয়ার সব মিথ্যে-কানুন হেসে।
এই লেখাটি পোস্ট করা হয়েছে গল্প-এ। স্থায়ী লিংক বুকমার্ক করুন।

14 Responses to বিবেকহীন মৃত্যুময়তা আর অসহায় কিছু ভবিষ্যৎ জোছনা

  1. বোহেমিয়ান বলেছেনঃ

    🙁

    আসলেই তো! আমরা যেন কেমন হয়ে যাচ্ছি 🙁
    যা ইচ্ছে তাই বলে বেড়াতে পারি, করে বেড়াতে পারি!

    [তবে ভাইয়া বানান এর দিকে একটু নজর দেবে? আছেছ>আছে, লাত্তি> লাথি,কর্দামাক্ত > কর্দমাক্ত ]

  2. অচেনা রাজ্যের রাজা বলেছেনঃ

    জি ভাইয়া বানানগুলো ঠিক করে দিয়েছি। 😀

  3. নিলয় বলেছেনঃ

    মন খারাপ করা নির্মম বাস্তবতা 🙁

  4. মুবিন বলেছেনঃ

    একটা অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ্য করলাম সামু ব্লগে এই লেখাটা আগস্টের প্রথমদিকে পড়ার পর আমার ভেতরে যতটুকু আলোড়ন তৈরি হয়েছিল এখন তার দশভাগও হচ্ছে না। কলেজে থাকতে মানবমনের এই ব্যাপারটা নিয়ে শামসুর রাহমানের ‘একটি ফটোগ্রাফ’ নামে একটি কবিতা পড়েছিলাম। আসলে মানুষ জাতি বোধহয় স্বভাবগত ভাবেই স্বার্থপর ও হুজুগে।

    একটা বানান ভুল এখনো রয়ে গেছে।
    ভেগে<বেগে হবে।

  5. তুসিন বলেছেনঃ

    🙁 🙁 🙁 🙁 🙁 🙁 :crying:

  6. কৃষ্ণচূড়া বলেছেনঃ

    🙁
    একটা মানুষ ছিনতাই করলেই মেরে ফেলব আমরা? অসহ্য বাস্তবতা।

  7. অদ্ভুত ছেলে বলেছেনঃ

    কোনো জনসমাবেশে একজন হাততালি দিলে বাকিরাও হাততালি দিয়ে ওঠে।
    আসলে একজনের উপর ভিত্তি করেই আমাদের সিধান্ত নেয়া উচিত নয়।

    🙁

  8. স্বপ্ন বিলাস বলেছেনঃ

    এমন নির্মম বাস্তবের মুখোমুখি হয়েই স্বপ্ন দেখছি সুন্দর ভবিষ্যৎ এর…..

    লেখা ভালো লেগেছে। 😀

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।