মল সংগ্রহক
লেখা পড়ার আগেই দয়া করে কেউ কাল্পনিক গন্ধ পেতে শুরু করবেন না আশা করি।
তখন সবে মাত্র তৃতীয় বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষা দিয়েছি। হাতে কিছুটা সময় আছে। ক্লাস শুরু হবার আগে প্রায় এক মাস সময় পাবো। বরাবরেই মতো সিনেমা, টিভি সিরিজ, ডকুমেনটারি দেখে আর বই পড়ে সময় পার করছিলাম। এক দিন আব্বু ফোন করে জানালো কোথায় যেন বুফে খেতে যাবে। আমি ও গেলাম আব্বুর সাথে। এবার এই বুফে খেতে গিয়ে দেখা হল আমার বিভাগের এক স্যারের সাথে। আব্বু পরিচয় করিয়ে দিলো।
-কোন ইয়ার তুমি?
-স্যার, থার্ড ইয়ার ফাইনাল দিলাম।
-কি করতেছো বন্ধে?
-এইতো স্যার টুকটাক পড়ালেখা করছি বেসিক ক্লিয়ার করার জন্য।
-আরে তুমি তো আমার ভাইগ্না! তুমি আমার রুমে আসো না কেন?
-আসবো, স্যার।
-আমার অনেক রিসার্চ প্রোজেক্ট আছে। তুমি এসো একদিন। রিসার্চ করতেছো?
-এখনো না স্যার।
-আসো একদিন। বিস্তারিত কথা বলবো।
-জি, স্যার।
বন্ধের মাঝেই একদিন স্যারের কাছে গেলাম। অনেক আলাপ হল। উনি আমাকে একটা রিসার্চ প্রোজেক্ট এর কাজে ট্যাগ করে দিলেন। বাচ্চাদের কৃমি সংক্রান্ত কাজ। কোন ধরনের কৃমির প্রাদুর্ভাব বেশি, কোন এলাকায় কোন ধরনের কৃমি বেশি পাওয়া যায় ইত্যাদি ইত্যাদি। এই কাজের জন্য স্যাম্পল হিসেবে লাগবেঃ মল! হুম। বাচ্চাদের মল। আমাদের ল্যাবে এই কাজ করা কঠিন হবে। মল সংগ্রহ করা, প্রসেস করা, কৃমি শনাক্তকরণ সহ অনেক কাজ। তাই স্যার ঠিক করলেন আমরা এই কাজ কোন হাসপাতালে করবো। কারণ, হাসপাতালে অনেক রোগী আসে, স্যাম্পল নিয়ে সমস্যা হবে না এবং টেস্ট করার সুবিধা ও আছে।
প্রথমে স্যার কলেরা হাসপাতালের সাথে যোগাযোগ করলে তারা কোন ধরনের ডাটা দিতে পারবে না বলে জানিয়ে দেয়। আর পরে ঢাকা মেডিক্যালে গিয়ে জানতে পারলাম তারা এই ধরনের টেস্ট করে না। পরবর্তীতে গেলাম বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল কলেজে। সেখানে স্যারের এক বন্ধু ছিল। স্যার কাগজ পত্র দিয়ে আমাকে উনার কাছে পাঠাতেন। আমি গিয়ে ঐ ডাক্তারের রুমের বাইরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাড়ায় থাকতাম। সে আসতো, তার সাথে আলাপ করতাম কিভাবে কিভাবে আমরা শুরু করতে পারি। উনি আমাকে সময় দিতে পারছিল না বলে উনার এক ছাত্রের সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলো। ডাক্তার কুদ্দুস। তার নামের সাথে কাজের অনেক মিল ছিল! কোন কাজই সে ঠিক মতো করতে পারতো না। একদিন সে উপায় না দেখে আমাকে নিয়ে যায় পেথোলজিক্যাল সেকশনে। মানে যেখানে স্যাম্পল সংগ্রহ করা হয়। পেথোলজিক্যাল সেকশনের হেড রাসেল ভাই এর সাথে পরিচয় হল। দিন যায়, আমি দৌড়াই, কাজ আর হয় না কিছুই। পরে রাসেল ভাই উপায় না দেখে আমাকে নিয়ে গিয়ে বসায় দিলেন আসল টেবিলে। যেই জায়গায় রোগী এসে মল জমা দেয়। আমি খুবই বিব্রতবোধ করতে থাকলাম। এত্ত মানুষ, লাইন ধরে আসতেছে, মূত্র এবং মল জমা দিচ্ছে। সেখানে যেই ভাইয়াটা বসতেন, তার সাথে আমার অনেক দ্রুত খাতির হয়ে যায়। লিটন ভাই। আমার থেকে কয়েক বছরের বড় হবেন। আমি মনে মনে ভাবলাম, এই বার কয়েক সপ্তাহে আমি কাজ শেষ করে ফেলতে পারবো। ১০০ এর উপর স্যাম্পল পেয়ে গেলেই শেষ। কিন্তু, সেই চিন্তার বাস্তবিক রূপ আলাদা। অনেক রোগী আসে ঠিকই। তার মাঝে ৮০% জমা দেয় মূত্র স্যাম্পল। বাকি যেই ২০% মল স্যাম্পল জমা দেয়, তার মাঝে বাচ্চাদের স্যাম্পল হবে ২-৩%! আর যখন বাচ্চাদের মল স্যাম্পল জমা দেয়, তখন আমি তাদের ব্যাপারে ডাটা সংগ্রহ করি। যেমনঃ বাচ্চার বয়স, স্কুল যায় কিনা, কোথায় থাকে, বাবা-মা কি করেন, অর্থনৈতিক অবস্থা কেমন, কৃমির ট্যাবলেট খেয়েছে কিনা এর মাঝে। কিন্তু, মুশকিল হল কিছু প্রশ্ন জিজ্ঞেস করা যায় না। বাবা-মা এর পড়ালেখা কতো দূর, অর্থনৈতিক অবস্থা কেমন! ধীরে ধীরে ডাটা সংগ্রহ চলতে থাকলো। আর এই সকল স্যাম্পল এর রিপোর্ট আনা লাগতো অন্য জায়গা থেকে। সেখানে গেলে আমাকে পাত্তা দিত না। একদিন এক লোক পেলাম যার গ্রামের বাড়ি কুমিল্লা। নুরুল ইসলাম ভাই। সে নিজের এলাকার লোক পেয়ে খুবই খুশি। আমি গেলেই খালি পলিটিক্যাল আলাপ করতো। আর আমি উনার সাথে তাল দিতে দিতে উনাদের কম্পিউটার থেকে সব রিপোর্ট ধাপাধাপ প্রিন্ট দিয়ে নিয়ে আসতাম।
এমন করেই প্রায় ৫-৬ মাসের পরিশ্রমের পর ১৪৫ টা স্যাম্পলের ডাটা আর রিপোর্ট সংগ্রহ করলাম। এবার অ্যানালাইসিস করার পালা। বলতে বাধা নেই, ডাটা অ্যানালাইসিসের ফলাফল ছিল শূন্য। কারণ, ঢাকা শহরের মতো জায়গায় অভিবাবকরা অনেক সচেতন এই সব ব্যাপারে। আর, এই ধরনের গবেষণা করতে গেলে কমপক্ষে কয়েক হাজার স্যাম্পল দরকার, যদি কোন ধারনা পাওয়ার চিন্তা করে কেউ। যাই হোক, অবশেষে আমি আমার অন্য কাজ নিয়ে ব্যাস্ত হয়ে গেলাম, আর আমার এই কয়েক মাসের ডাটা কোন দেশি জার্নালেও প্রকাশ করতে পারলাম না। জীবনে অনেক অনেক জার্নাল পাবলিশ করলে ও প্রথম রিসার্চ পাবলিশ না করার একটা আক্ষেপ থেকে যাবে।
আর এটা বলার অপেক্ষা থাকে না, আমার এই রিসার্চ বা গবেষণা, গো+এষনার একটা উদাহরণ মাত্র। এতে আমার কোন আক্ষেপ নাই। কারণ, এই মল সংগ্রহ করতে গিয়ে আমার পরিচয় হয় লিটন ভাইয়ের সাথে। উনি বসতেন মল-মূত্র সংগ্রহ করার সেকশনে। উনার মতো সাহায্য আমাকে করে নাই। উনি প্রায় আমাকে চা খাওয়াতেন, এক সাথে নামাজ পড়তে যেতাম, নাস্তা করতাম, কয়েক দিন না গেলে উনি ফোন করে খবর নিতেন।
-লিটন ভাই, আপনি যে আমাকে এতো সাহায্য করেন, আপনার লাভ কি?
-কোন লাভ নাই। আপনাকে আমার ভালো লাগে, তাই করি।
-শুধু তাই?
-আরেকটা কারণ আছে। আপনার প্রচুর ধৈর্য। এক দিন অনে বড় হবে আপনি। আমি বলতে পারবো, এই লোকের সাথে আমি কাজ করেছি।
ঐ গবেষণা নিয়ে কোন আফসুস নাই, আফসুস শুধু একটাই। লিটন ভাইয়ের মতো একজন ভালো মানুষের সাথে এখন আর কোন যোগাযোগ নাই।
ভাল্লাগছে ভাই।
গবেষণা বলতে আমরা যা ছোট বেলায় ভাবতাম, বড় হবার সাথে সাথে আমাদের ধারনা বদলাতে থাকে। আর এর সাথে সাথে অনেক মজার ঘটনা ও খেয়াল করা যায়। আমি “গো+এষনা” এর পর্ব গুলোতে আমার দেখা এবং জানা এমন ঘটনা শেয়ার করবো সামনের দিন গুলোতে ও।
মজা পেলুম 😀
আমারও ধৈর্য কম 🙁
সামনে আরও এমন মজার ঘটনা পড়তে চাই 😀
আমি দুঃখের সাথে জানাচ্ছি যে, গবেষণার কাজের ফাকে ফাকে যেই সময় টুকু পাই, ঐ সময় সকল মজার ঘটনা নিয়ে লেখা চালিয়ে যাবো।