দিনকাল ভালো যাচ্ছে না মোতাব্বির সাহেবের। একের পর এক ব্যবসায় লস দিয়ে প্রায় সর্বশান্ত হতে বসেছেন। শেয়ার মার্কেটে তার কোম্পানির শেয়ারের দামও কমছে হু হু করে। কোন কিছুর কুল কিনারা খুঁজে পাচ্ছেন না। একদিকে ব্যবসা বাণিজ্য আরেকদিকে নিজের শরীর স্বাস্থ্য, কোনটাই ভালো নেই। এই দুইয়ের প্রভাব গিয়ে পরছে সাংসারিক জীবনে। স্ত্রী বীণাকে সময় দিতে পারছেন না একটুও। মেয়ে বুবলী বড় হয়ে যাচ্ছে, কলেজ পেড়িয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পা দিবে। আজীবন বাবার আদরে বড় হওয়া মেয়েটা হঠাৎ করে বাবাকে পাচ্ছে না ঠিকমত। আজকাল বুবলীও খুব একটা কথা বলে না মোতাব্বির সাহেবের সাথে, মোতাব্বিরের ধারণা মেয়ে বড় হয়েছে, ভার্সিটির হয়তো চাপ, তাই সময় করে উঠতে পারে না, অন্যদিনে বুবলী ভাবে বাবা হয়তো কোন কিছু নিয়ে অনেক বেশি ব্যস্ত তা না হলে কেন সময় দিতে পারছে না?
দিনটা আর দশটা দিনের মতই ছিল। কিন্তু বুবলীর জন্য অন্যরকম দিন। অনেক অনেক দিনের স্বপ্ন চোখে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পা রাখে সে। মুহুর্তের মাঝে যেন চারপাশ হুট করে বদলে যায়। চোখের পলকে বড় হয়ে যাওয়া একটা অনুভূতি, স্কুল কলেজের মত সবাই একই ড্রেস পরে নেই, শিক্ষক কোনজন আর কোনজন ছাত্র সেটা বুঝে ওঠা যাচ্ছে না। সাথের ব্যাগটা সেই স্কুল কলেজের ভারী ব্যাগটা না। ছোট্ট একটা খাতা আর দুটো কলম। স্কুল কলেজের সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের এতটা পার্থক্য হবে সেটা এতটাও চিন্তা করে নি সে। কিন্তু এটাই ছিল বাস্তব। কিন্তু প্রথমদিনই একটা বড়সড় গোলমাল পাকিয়ে ফেললো সে। নিজের ক্লাসরুমটাই খুঁজে পাচ্ছে না। আশপাশে কাউকে জিজ্ঞেস করবে সেই সাহসটাও পাচ্ছে না। শুনেছে এখানকার বড় ভাইয়া আপুরা নাকি ভীষণ রকমের কড়া হয়, তাই কী বলতে কী বলে ফেলে তার তো কোন ঠিক নেই। এই জিজ্ঞেস করে করবে করে অনেকটা সময় পার করে ফেলে সে কিন্তু সাহস করে কাউকে বলে উঠতে পারে না “সমাজ বিজ্ঞানের প্রথম বর্ষের ক্লাস্টা কোনদিকে বলতে পারবেন?” আস্তে আস্তে করিডোর ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে, এখন কী করবে সে? পাশ থেকে এমন সময় কে যেন কথা বলে ওঠে, “কিছু খুঁজছ তুমি?” বুবলী পেছন ফিরে তাকায়। এরপর যাকে দেখে তাকে সে এখানে আশা করছিল না। মুহুর্তের মাঝে মাথায় আকাশ ভেঙে পরে তার। হঠাৎ করে চারপাশ অন্ধকার হয়ে আসে তার। সে শুধু একটা শব্দই বলতে পারে “তুমি!”
রুম টেম্পারেচার ১৮ তে দেওয়া। তাও দর দর করে ঘামছেন মোতাব্বির সাহেব। হাত পা থর থর করে কাঁপছে তার। না, ব্যবসা বাণিজ্য নিয়ে নতুন কোন দুঃসংবাদ না। তার হাতের মুঠোফোনটির একটি খুদে বার্তার দিকে তাকিয়ে আছে সে। গলা শুকিয়ে যাচ্ছে তার, হাতের সামনে পানির গ্লাসও নেই। এই মুহুর্তে যদি মোতাব্বির সাহেবের ছবি তুলে রাখা যেত তাহলে হয়তোবা বোঝা যেত “ভয়” বলে কিছু একটা পৃথিবীতে আছে। আর সেটাই এখন মোতাব্বির সাহেবের চোখে মুখে ছড়িয়ে পরছে। মুঠোফোনের স্ক্রীণে একটা লেখা জ্বলজ্বল করছে, “কেমন আছো মোতাব্বির? শুনলাম তোমার মেয়ের নাকি ১৮ হয়েছে। আমি রাহনুমা, বলেছিলাম আসবো। এসেছি। তোমার শেষের শুরু দেখতে থাকো।”
২০ বছর আগের কথা। রাহনুমা তখনও কিশোরী। গ্রামের সহজ সরল একটা মেয়ে। সদ্য ১৭ পেরিয়েছে। তখনকার দিনে স্কুল কলেজ তেমন একটা ছিল না। কেউ পড়াশোনাকে খুব একটা গুরুত্ব দিত না, আর মেয়েরা করবে পড়াশোনা? সেটা তো চিন্তা করাই পাপ ছিল। কিন্তু এসবের মাঝ থেকেও রাহনুমার বাবা তাকে উৎসাহ দিয়ে যেতেন পড়াশোনা চালিয়ে নেওয়ার জন্য। স্কুলের গন্ডি রাহনুমা পেরিয়েছিল বাবার হাত ধরেই, নিজ গ্রামে। এরপর জেলা শহরের একটা কলেজেও ভর্তি হয়ে যায় সে। সেই সময়ে খুব বেশি মেয়ে পড়াশোনা করত না, উচ্চমাধ্যমিক সেও তো অনেক বেশি। রাহনুমার বাবারও চিন্তা ছিল মেয়েকে কলেজ পাশ করিয়েই বিয়ে দিয়ে দিবেন। কিন্তু বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় রাহনুমার অসাধারণ ফলাফল। সেইবার পুরো জেলায় ফার্স্ট হয়ে বসে রাহনুমা, শুধু তাই না এরপর সুযোগ পেয়ে যায় দেশের নামকরা এক বিশ্ববিদ্যালয়েও। এতসবের পরেও রাহনুমার বাবা রাজী হতেন না, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা এসে যখন তাকে বারবার অনুরোধ করলো তখন সে আর ফেলতে পারলো না। রাহনুমা ভর্তি হয়ে গেল বিশ্ববিদ্যালয়ে।
ইংরেজি বিভাগের প্রথম বর্ষের প্রথম ক্লাস। রাহনুমা ঠিক প্রথম বেঞ্চটাতেই বসে আছে। কিছুক্ষণ পর একজন সুদর্শন যুবক ঢুকলো ক্লাসরুমে। সবার একরাশ আকাঙ্ক্ষা তার পাশেই নিশ্চয়ই বসবে ছেলেটা। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে ডায়াসে গিয়ে দাঁড়ায় সে। বিস্মিত চোখগুলো এখন বিষ্ফোরিত হওয়ার জোগাড়। “ইনি আমাদের স্যার?” কীভাবে সম্ভব? রাহনুমাও উত্তর খুঁজে পায় না। স্যার ততক্ষণে নিজের পরিচয় দিতে শুরু করেছেন, “আমি মোতাব্বির, তোমাদের লিটারেচার ক্লাসটা আমিই নিব . . .”
রাহনুমা চিৎকার করে ওঠে। এখনও মোতাব্বিরের সেই “আমি মোতাব্বির, তোমাদের লিটারেচার ক্লাসটা আমিই নিব . . .” লাইনটা তার মাথায় বাজতে থাকে, সঙ্গে সঙ্গেই আরেকটা লাইন মাথায় চলে আসে, “রাহনুমা তোমার বয়স তো ১৮, এগুলো কোন ব্যাপারই না, আসো এদিকে আসো . . . ” আবার চিৎকার করতে থাকে রাহনুমা। কিবরিয়া দৌড়ে আসে রাহনুমার কাছে। “কী হয়েছে? কী হয়েছে তোমার?” “মোতাব্বির কিবরিয়া, মোতাব্বির। আমি শান্তি পাচ্ছি না কিবরিয়া।” “আহা! আজকের দিনটার কথা ভুলে গেছ? আজ ১৭ সেপ্টেম্বর! বুবলীর বয়স ১৮ হচ্ছে। তুমি ভুলে গেছ? আজ তো তোমার কান্নার দিন না।”
তাইতো, আজই তো বুবলীর বয়স ১৮ হবে। এত দিনের সাজানো গোছানো প্ল্যান, এতদিনের ধীরে ধীরে গড়ে তোলা প্ল্যানকে আজ মাটি করতে দেওয়া যাবে না। রাহনুমা মোতাব্বিরের নাম্বারটাইয় ডায়াল করে, “নাহ ফোন না। ওকে একটা মেসেজ দিতে হবে। আমি চাইনা ও আমার গলা স্বর শুনেই মারা যাক ! হা হা হা ”
বুবলীর ফোন সুইচড অফ দেখাচ্ছে। মোতাব্বির বার বার ফোন করেও ওকে পাচ্ছে না। এমন সময় আবার একটা মেসেজ। “বুবলীকে খুঁজছ? রোড নাম্বার ৮ বাড়ী নাম্বার ৬ ফ্ল্যাট নাম্বার ২B। চলে আসো।” মোতাব্বিরের মাথা কাজ করছে না, রাহনুমা কী বুবলীকে মেরে ফেলবে? সে কী পুলিশে একটা ফোন দিবে? কিচ্ছু মাথায় ধরছে না। সে গাড়ি নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে রওনা দিল।
একটা বদ্ধ রুম। পাশে কয়েকজনের আলাপের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। বুবলী বুঝতে পারছে না জাফর থাকে এখানে কেন নিয়ে আসলো। জাফরের সাথে তার সম্পর্ক আজ প্রায় ৩ মাস হতে চলেছে, কোন খারাপ ইঙ্গিত দেওয়া তো দূরে থাক জাফর কোনদিন বুবলীর হাত পর্যন্ত ছুয়ে দেখেনি। সেখানে এমন একটা জায়গায় অনেকটা জোর করে ওকে ধরে নিয়ে এসেছে জাফর। কিন্তু কেন? উত্তর পাচ্ছে না বুবলী। একটু পর মধ্যবয়স্ক একজন মহিলা ঘরে ঢুকলো। “বুবলী।” এমন ভাবে মহিলাটা তার নাম ধরে ডাকলো যেন তার খুব আপন কেউ সে, গলায় একটা আদর মাখা ডাক। কিন্তু এই চিন্তা বদলে যেতে তার সময় লাগলো না। এরপরই ঘরে ঢুকলো জাফর।
“কাপড় চোপরগুলো পাল্টে নাও।” জাফর কড়া ধমক দিচ্ছে বুবলীকে। “কিন্তু আমি কেন এই পোষাক পরব?” “আরেকটা কথা বলবি না, আরেকটা কথা হবে না। যা বলছি কর।” বাধ্য হয়ে বুবলী খুব পুরাতন একটা সালোয়ার কামিজ হাতে নিয়ে বাথরুমে ঢুকে গেল, কী বিশেষত্ব এই সালোয়ার কামিজের?
এক কোণায় বুবলী জবুথবু হয়ে বসা। ঘরের মাঝে মাঝে মোতাব্বির চিৎকার করছে, “কী করেছ আমার মেয়ের সাথে? কী করেছ আমার মেয়ের সাথে?”
“আস্তে কথা বলো মোতাব্বির। চিৎকার করা তোমাকে মানায় না!”
“তুই কী করছিস আমার মেয়ের সাথে?”, মোতাব্বির জাফরের কলার ধরে ঝাকুনি দেয়।
জাফর ঝটকা দিয়ে মোতাব্বিরকে দূরে ফেলে দেয়। “চিৎকার করে বলে ওঠে, তুই যা করেছিলি আমার বোনের সাথে ! ”
মোতাব্বির দুই পা পিছিয়ে যায়। সে একবার বুবলীর দিকে তাকায়, আরেকবার রাহনুমার দিকে। রাহনুমা অট্টহাসি দিয়ে ওঠে, “মোতাব্বির তাকিয়ে দেখ তো বুবলীকে ঠিক আমার মত লাগছে না? এটা আমার সেই কামিজটা। আমার বয়স তখন ১৮ বছ্র ছিল। আজ বুবলীর ১৮। দুইজনকে দেখতে একই রকম লাগছে না? বল? লাগছে না? রাহনুমা তোমার বয়স তো ১৮, এগুলো কোন ব্যাপারই না, আসো এদিকে আসো . . ., কীরে মোতাব্বির দেখ না একটু বুবলীর দিকে?”
পুনশ্চঃ বুবলীর সাথে জাফর কোন অনৈতিক কাজ করে নি। বুবলীকে তার বাবার কৃতকর্ম সম্পর্কে জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল, আরও জানিয়ে দেওয়া হয়ে কীভাবে বুবলীর বয়সেই রাহনুমার জীবনটা সে ধ্বংস করে দিয়েছিল। বাবার আসল চেহারা সামনাসামনি দেখার জন্যই বুবলী মুখ খোলেনি। আর কোনদিন বুবলী জানায়ও নি যে আসলে তার সাথে কোন কিছু ঘটে নি, কেননা জেনে গেলে মোতাব্বির সাহেবের ভেতরকার অনুশোচনাবোধটা মরে যেত, মেয়ে বুবলী চাচ্ছিল বাবাকে স্বস্তি দিতে কিন্তু নারী বুবলী সেটা চায়নি, আর জয়টা নারী বুবলীরই হয়েছিল। আর রাহনুমা এই বুবলীর মাঝে নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করে, জাফর আর বুবলীর বিয়ে হয়ে যায়। কিবরিয়ার মত অসাধারণ্ একজন স্বামীর সাথে বাকি জীবনটা পার করে দিতে চায় সে। ঐদিকে সব হারিয়ে মোতাব্বিরের ঠিকানা হয় একটা অন্ধকার ঘর, যার চার দেয়াল শুধু তার কৃতকর্মের স্বাক্ষী দিতে থাকে প্রতিনিয়ত।
অনেকদিন পরে তোর লিখা পড়লাম 😀
ওয়েলকাম ব্যাক 😀
পুরা লিখাটা একবারে পড়েছি
অনেকদিন পরে কোন লিখা একবারে পড়েছি 😀
পরে পর্ব কবে পাচ্ছি???