চিরকুটে মায়া-আমন্ত্রণ

ঘরের ভেতর বিকেলের হেলে পড়া ক্লান্ত সূর্যের আলোয় জেগে উঠেছে আলস্যের পাখনা। কী ভীষণ নরম রোদ! গায়ে মেখে দুই হাঁটু ভাঁজ করে চুপটি করে বসে থাকতে ইচ্ছে করে। ছাদে গিয়ে পাখিগুলোকে বেড়িয়ে আনার সময় হয়েছে। দু’জোড়া পাখির একটি মারা গেছে প্রতিপক্ষের রাজার ঠোঁকরে। এতদিন ভাবতাম,কেবল মানুষ হিংসা করতে পারে,পাখিও কি পারে? আচ্ছা,হিংসা তো আবেগেরই অংশ। তাহলে পাখির কি আবেগ আছে? আবেগ থাকতে হলে তো মন থাকতে হয়! পাখির মন আছে?
বিকেলের ছাদে বাতাস থাকাটা স্বাভাবিক,না থাকাটা অস্বাভাবিক। এই মূহুর্তে কিছুটা বাতাস বইছে। মৃদু বলা চলে। সময়টা রবি ঠাকুরের শেষের কবিতা পড়ার জন্য যথোপযুক্ত। কিন্তু হাতে বই নেই। ভালো লাগা মূহুর্তগুলো ভেবে পুলকিত হওয়ার কাজটা মন অবসর সময়ে বেশি করে। একজন জাগ্রত মানুষ প্রতিটি খন্ডায়িত সেকেন্ডেও কিছু না কিছু নিয়ে চিন্তা করে। চিন্তা বাদে থাকা অসম্ভব। চিন্তা করার কিছু না থাকলেও সে চিন্তা করে “চিন্তার কিছু নেই”। তবে সবচেয়ে বেশি যা ঘটে তা হলো,পুরোনো স্মৃতির জাবর কাটা।
পাখিগুলো আমার না,কার আমি তাও জানতাম না। দু’জোড়া পোষ মানানো নীলগলা-বসন্ত,ইংরেজী নাম ব্লু থ্রোটেড বারবেট,বৈজ্ঞানিক নাম ম্যাকালাইমা এশিয়াটিকা। প্রথমে নাম জানতাম না,পরে অনেক খোঁজ করে বের করেছি। পোষ মানানো এই কারণে বললাম,কারণ পাখিগুলো স্বেচ্ছায় আমার কাছে এসেছে,বেলকনি দিয়ে আমার ঘরে নির্ভয়ে ঢুকে এটাসেটা ঠোঁট দিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে। আমি ভাবলাম হয়তো চলে যাবে। চলে গেলোও,কিন্তু পরদিন আবার এলো। তারপরদিন আবার। প্রতিদিনই আসতো বিকেলে সূর্য হেলান দিলে। বুঝলাম এরা প্রতিদিন আসবে। আমি এদের খাবারের ব্যবস্থা করলাম একদিন। বাজারে এই জাতীয় পাখির কেউ নামই শোনেনি। শেষমেষ এক পাখি দোকানদার দু’টা প্যাকেট দিয়ে বললো,”এইগুলান যেই পাখিরেই দ্যান,চাইটাপুইটা খাবে।” পাখিরা চেটেপুটে খেতে পারে না,এ কথা বলতে গিয়েও বললাম না। খাবার পেয়েছি,এটাই যথেষ্ট। ঘরে ফিরে তাদের খাবার পরিবেশন করলাম,সাথে আধ লিটার আইসক্রীম বক্সের আধ বক্স পানি,যদি পিপাসা লাগে পান করবে। এখন দেখার পালা তারা খাবার খায় কিনা।
হুম্ খাচ্ছে। মা এরই মধ্যে আমাকে জংলী মেয়ে উপাধি দিয়ে দিয়েছেন। তা নাহলে আমার আশেপাশে চারটা পাখি প্রতিদিন বিকালে এসে ঘুরঘুর করবে কেন? যেই প্রাণীকে মানুষ হাজার কষ্টেও পোষ মানাতে পারে না,সে কিনা আমার কাছে খাঁচা ছেড়েই নির্ভয়ে থাকছে!
খাবার আনার পর আরেক দফায় মা বকা শুরু করলো-
“এই পাখির নাম কি আল্লাহ্ জানে?”
“নিশ্চয়ই কেউ তাবিজ করেছে পাখিগুলোকে দিয়ে।”
“তুই এক্ষণ এইগুলারে ফ্যাল।”
“এইগুলা গু-মুত আমি সাফ করতে পারবো না,বিলকিসও পারবে না। সে মাটি খেয়ে বাঁচবে,তবুও পাখির গু সাফ করার চাকরি সে করবে না।”
“সারাজীবন তোর বাপ জ্বালালো,এখন তুইও।”

এইখানেই একক সংলাপের সমাপ্তি,আঁচল মুখে চেপে কান্নার শুরু। শেষ পর্যন্ত আমি থাকতে পারিনি। ক্লাস ফোরের একটা ছেলেকে পড়াই সন্ধ্যায়। বের হলাম।
ঘরে ফিরে দেখা গেলো আগের মতই সবকিছু পরিষ্কার পরিপাটি করে রাখা আছে। পাখিগুলোও নেই।
রাতে খাওয়া হয়নি। দশটা বাজতে না বাজতেই ঘুমে চোখ বুজে আসছে। কিন্তু ঘুমানোর জন্য চোখ বন্ধ করলেই আর ঘুম নেই। বিচ্ছিরি এক সমস্যা! কারো মাথায় কাক হেগে দেওয়ার পর কেউ যদি না বুঝতে পেরে মাথায় হাত দিয়ে দেখার চেষ্টা করে যে জিনিসটা কী এবং দেখার আগেই বুঝে ফেলে যে তার মাথায় কাকে হেগেছে আর সে বোকার মত সেই গু কে পরখ করে হাতেও সেই চুনবর্ণ জিনিস স্বেচ্ছায় মাখিয়েছে,তখন যেই ধরনের বিচ্ছিরি এবং বিরক্তিকর অনুভূতি হয়,ঠিক সেরকম অনুভূতি হচ্ছে এখন আমার! মানুষের যখন ঘুম পায়,তখন সবার আগে দুটো ইন্দ্রিয় ক্লান্ত হয়-ব্রেইন এবং চোখ। যেকোনো একটি যদি অমত প্রকাশ করে যে তার বিশ্রামের প্রয়োজন নেই,তখনই এই বিচ্ছিরি সমস্যার উদ্ভব হয়। আমার ব্রেইনের শক্তি এখনো ফুরোয়নি।
জটিল কিছু নিয়ে চিন্তা করা যাক। তাহলে ব্রেইন ক্লান্ত হলেও হতে পারে। আমরা যখন খুব বেশি চিন্তা করি,তখন আমাদের ব্রেইন সিগন্যাল দেয় সে আর নিতে পারছে না,তার ঘুমের দরকার। কারো যদি এর ব্যতিক্রম হয়,বুঝতে হবে সে তখনও অতিরিক্ত টেনশনের মাত্রায় পৌঁছেনি বা অতিক্রম করেনি। অবশ্য যাদের হাইপার টেনশনের প্রব্লেম আছে,তাদের কথা ভিন্ন।
পাখিগুলো কি পোষ মানানো আসলেই? যদি পোষ মানানো না হতো,তাহলে মানুষের পরিবেশের সাথে এতটা স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতো না। পাখিগুলো তবে কার? আমার কাছেই বা কেন আসছে? তাদের মালিক কি জানে যে তারা আমার কাছে আসছে? এরা আমার ঠিকানাই বা জানলো কি করে? আচ্ছা এদের কি কোনো ভাষা আছে? অবশ্যই আছে। সেসব ভাষা কেবল তারা বুঝতে পারে। আচ্ছা আমাদের কথা কি তারা বোঝে? তাদের কথা তো আমরা বুঝি না। আমরা কিএকটু মন দিয়ে বোঝার চেষ্টা করলে বুঝতে পারবো?
এই করতে করতেই ঘুমে তলিয়ে গেছি। কী সব স্বপ্ন জানি দেখলাম! স্বপ্নে সেগুলো স্বাভাবিকই লাগছিলো। পাখিগুলো কথা বলছে আমার সাথে। আমরা পরস্পর পরস্পরের কথা বুঝছি।
কাল যে খাবারগুলো দিয়েছিলে, খুব ভালো ছিলো।
তাই?
হ্যাঁ। আজকে আরো বেশি করে দিও।
আচ্ছা ঠিক আছে। আচ্ছা তোদের নাম কি রে?
নীলগলা বসন্ত। তবে তুমি চাইলে অন্য নাম দিতে পারো।
ঠিক আছে। তোদের মধ্যে যার গলা একটু বেশী নীল তার নাম ম্যাকাও,একটু কম নীল আকাশমণি,যার চোখের ওপর সাদা পালক সে শুভ্রাক্ষি,আর বাকিটা ইচ্ছেরাণী। পছন্দ হয়েছে নাম?
হ্যাঁ হয়েছে।
স্বপ্নের মাঝে দেখা গেলো চারটা পাখি লাজুকলতা হয়ে মুচকি মুচকি হাসছে।
এরপর তারা তারস্বরে আমাকে ডাকছে,কিন্তু মনে হচ্ছে যেন দূর দুরান্ত থেকে কেউ বকছে আমাকে।
এই নীলাঞ্জনা! ওঠ্,ওঠ্ বলছি! কিরে? ক্লাসে যাবি না?
হুমম্,যাবো তো!
যাবো তো কি? ওঠ্! নাম ঠিক করেই শেষ? ওঠ্ , গোসলে ঢোক।
না,এখন গোসল করবো না।
মাথায় পানি ঢেলে দেবো কিন্তু!
এরপর চারটা পাখি একটা নীল হাতলের লাল বালতি ভর্তি পানি উপুড় করে আমার মাথায় ঝপাং করে ঢেলে দিলো!!
সঙ্গে সঙ্গে উঠে বসি দেখি মায়ের হাতে লাল বালতি আর আমি ভিজে চুপচুপে হয়ে আছি। স্বপ্নের রং নাকি সাদাকালো। মিথ্যা কথা। স্বপ্ন রঙিন হয়।
বিকেলে পাখিগুলোর খাবারদাবার সাজিয়ে অপেক্ষা করছি। একটুপরই তারা এলো। আজ কিছুটা অস্থির। আকাশমণির ঠোঁটে একটা কাগজ। চিঠি?! কার চিঠি? এই ইন্টারনেটের যুগে চিঠি কেন লিখবে কেউ? আকাশমণির মুখ থেকে কাগজটা নিলাম।
লেখাগুলো উল্টো করে লেখা। মিরর ইমেজে। আয়নার সামনে ধরলে পড়া যায়। প্রথমে পড়তে খানিকটা কষ্ট হলেও পরে পড়তে পারছিলাম।
চিঠিটি এমন-
“প্রিয় নীলাঞ্জনা,
আমি স্বপ্নের জগতের বাসিন্দা। পাখিগুলোও তাই। এ কারণেই তারা আপনার সাথে এত সহজে মিশতে পারছে। আমাদের জগতে কেউ কারো ক্ষতি করে না,সবাই সবার আপনজন। পানির নিচে ডুব দিয়ে চোখ মেলে দেখলে জগতটা যেমন আবছায়া লাগে,আমাদের জগতটা তেমন। আপনার কাছে হয়তো এই চিঠির কথাগুলো খুবই অসংলগ্ন ঠেঁকছে। আমিও যখন প্রথম প্রথম এ চিঠি পাই,আমারও এমন লেগেছে। সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে গিয়েছি। কিছু ওষুধ দিয়েছে। লাভ হয়নি। যাই হোক,আমাদের জগতে ক্ষুধাতৃষ্ণা নেই। কিন্তু যখন এই জগতের কেউ পৃথিবীর জগতে প্রবেশ করে,তখন ক্ষুধা পায়। পাখিগুলো তাই আপনি খাবার না দেওয়া পর্যন্ত চিঠি দিচ্ছিলো না। পৃথিবীতে যাদের পাপ শূন্যের কৌটায়,আয়নার জগতের বাসিন্দারা তাদের এমন করেই তাদের বাসিন্দা করে নিতে চায়। আমিও ঠিক একইভাবে এই জগতের অন্য একজন বাসিন্দা দ্বারা আমন্ত্রিত হয়েছি। আমার বাবা মা কেউ ছিলো না,কোনো প্রণয়ী ছিলো না। তাই বাঁধাও ছিলো না। চলে এসেছি। আপনাকেও আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। যদি আসতে ইচ্ছে হয়,তাহলে আয়নার সামনে বসে পাখিগুলোকে আপনার কাঁধে বসিয়ে চোখ বন্ধ করে সাত থেকে এক পর্যন্ত উল্টো দিকে গুনবেন। এর মাঝেই আপনি গভীর ঘুমে তলিয়ে যাবেন। ঘুম থেকে জাগলেই আপনি স্বপ্নের জগতে পৌঁছে যাবেন। সপ্তম দিন সকালে পাখিগুলো আপনার সাথে শেষবারের মত দেখা করবে।
যদি আপনি এ জগত ছেড়ে আপনার জগতে যেতে চান তাহলেও কোনো বাঁধা নেই। আপনি মাঝেমাঝেই আপনার জগতে ইচ্ছে করলেই আসতে পারবেন। একই নিয়ম। শুধু সাত থেকে এক পর্যন্ত না গুণে এক থেকে সাত পর্যন্ত গুনতে হবে। আপনার হাতে দু’দিন সময় আছে।
ইতি-
মেঘালয়।”
চিঠিটি পড়ে কেমন যেন ঘোরের মত লাগছিলো। এই চারটা পাখির জন্য এরকম ঘুরে যাচ্ছে কেন সব? দুটো পাখি ইতোমধ্যেই ঝগড়া শুরু করে দিয়েছে খাবার নিয়ে। আমি চোখেমুখে পানি দেওয়ার জন্য ওয়াশরুমে গেলাম। মুখ ধুতে ধুতে মনে হলো,আচ্ছা,মেঘালয় তো বললো,তাদের জগতে পাপ নেই। পাপ না থাকলে পাখিগুলো হিংসেহিংসি করছে কেন? নাকি পৃথিবীতে এলে ক্ষুধাতৃষ্ণার মত পাপও এদের স্পর্শ করে?
মুখহাত ধুয়ে রুমে এসে আমি হতভম্ব। একটা পাখিকে মেরেই ফেলেছে!! আমি ভয়ে দু পা পিছিয়ে এসেছি। পাখিগুলো অপরাধী দৃষ্টিতে আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে উড়ে চলে গেছে। সেই থেকেই তিনটে পাখি।
পরদিন সকালে ঘুম ভাঙলো ব্যাপক শোরগোল এবং কান্নার আওয়াজে। জানতে পারলাম,পাশের বাসার ছন্দাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। হঠাৎ করেই নাকি পুঁচকে মেয়েটা হাওয়া হয়ে গেছে । সকালে নাস্তার সময়ও ছিলো। তাকে ঘর থেকেও বের হতে কেউ দেখেনি। তাহলে গেছে কোথায়?
ভার্সিটি যাওয়ার পথে স্যান্ডেলে গোবর লেগে একাকার অবস্থা! এই ইট পাথরের শহরে গরুই বা আছে কটা? তার মধ্যে আমার পায়েই তাদের বর্জ্য লাগতে গেলো? কোনো মতে একটা টংয়ে গিয়ে পা ধুলাম। হাঁটতে যখন গেছি,তখন বুঝলাম স্যান্ডেলের তলা আলগা হয়ে আছে। ভার্সিটি গিয়ে আর কাজ নেই। বাসায় আসার জন্য রিক্সা ঠিক করলাম। কিছুদূর যাওয়ার পর বেঁদে কিছু মহিলা ধরলো টাকা দেওয়ার জন্য।
আফা লো! আমরার একটা মাইয়ার বিয়া,তর লাহান। ট্যাহা দ্যা।
আপনাদের কয়টা মেয়ের বিয়ে হয় বছরে? কিছুদিন আগেও তো মনে হয় দিলাম।
দিলে দিসস্! তর রাজলইক্কী ভাইগ। দে রে বইন! তর কমতো না।
রাজলক্ষী হই কিংবা প্রজলক্ষী,দিয়ে মুক্ত হলাম।
বাসায় এসে দেখি মা তুমুল আকারে বাবার উপর চ্যাঁচাচ্ছে। কারণ হলো,পুঁইশাক রান্না করার জন্য মাঝারি সাইজের চিংড়ি না এনে ছোটো সাইজের চিংড়ি এনেছে কেন? শীতল শুটকিতে এত বেশি গন্ধ কেন? বাবা এত লেবান্ডিশ মার্কা কেন? পাঞ্জাবির সাথে লুঙ্গি পরেছে কেন? এইসব। বাবা কাঁচুমাচু মুখে সব হজম করছেন। মায়া লাগছে তাঁকে দেখে।
দুপুরে খাওয়া শেষ করে পিসিতে বসলাম স্বপ্ন সংক্রান্ত যদি এক্সেপশনাল কোনো ঘটনা থাকে। কয়েকটা পিডিএফ পেয়েছি। এর মাঝে একটি হলো উইলিয়াম বেনজামিনের “অ্যা সাইন ফ্রম হেইভেন”, প্রকাশিত হয় ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দে। সেখানের একটি ঘটনা এমন যে,এক শিশু স্বপ্নে দেখছে তাকে কোনো এক এইঞ্জেল এসে একটা বিচিত্র রকম ফল খেতে দিয়েছে। মেয়েটা সেই ফল খেয়ে জেগে উঠে দেখলো সে আর তার কামরায় নেই। সে স্বর্গে চলে এসেছে। কিন্তু যেহেতু সে নিতান্তই শিশু ছিলো,তাই সে অপরিচিত পরিবেশের সাথে মানিয়ে নিতে পারছিলো না। সে তার বাবা মায়ের কাছে যাবে বলে কান্নাকাটি শুরু করলো। তখন তাকে আরেকটি ফল খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেওয়া হলো। সে ঘুম থেকে উঠে দেখলো সে তার আগের জায়গাতেই আছে। ঘুম থেকে উঠে সে বাবা মা কে ডেকে পুরো ঘটনা বললো। বাবা মা ভাবলেন মেয়ে স্বপ্নে দেখেছে। কিন্তু পরদিন আবার একই রকম হলো। মেয়ে আবারও তার মা বাবাকে বলার পর মা বাবা সাইকিয়াট্রিস্টের শরণাপন্ন হলেন। মেয়েটির নাম হেলেনা। হেলেনাকে দেখে কিছু প্রশ্ন করার পর ডাক্তার সিটি স্ক্যানের পরামর্শ দেন। সিটি স্ক্যানে সব স্বাভাবিক আসলেও মস্তিষ্কের একটি অংশের ক্রিয়া ডাক্তার ধরতে পারেননি। মানুষের জীবন পদার্থবিদ্যার সূত্র মেনে চলে। কোনো একটি মানুষ স্বপ্নে থেকে স্বর্গে চলে যাচ্ছে জীবিত অবস্থায়-এটা পদার্থবিদ্যার সূত্র অমান্য করে বলেই এটা অস্বাভাবিক। ডাক্তার আপাতত কোনো ওষুধ দেননি। হেলেনার মাকে রাতে হেলেনার সাথে থাকতে বলেছেন। আজ রাতে মেয়ে স্বপ্নে দেখে কিনা,কিংবা স্বপ্নে দেখলেও সে দুটো স্বত্ত্বা হিসেবে দু জায়গায় অবস্থান করছে কিনা তা খেয়াল করতে বলা হয়েছে। যদিও তা বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা অমান্য করে। তবুও এই পথ ছাড়া আর অবলম্বন নেই। যদি হেলেনার দুটো স্বত্ত্বা থেকে থাকে তাহলে সে স্বপ্নের মাঝে স্বর্গে যাওয়ার পরও শ্বাসপ্রশ্বাস স্বাভাবিক থাকবে। আর যদি একটি স্বত্ত্ব থাকে তাহলে সে উধাও হয়ে যাবে যা অনেকটা ব্লাইন্ড স্পট ম্যাজিকের মত কাজ করে। ব্লাইন্ড স্পট ম্যাজিক দেখিয়ে কিছুক্ষণের জন্য হিপনোটাইজড ব্যক্তির চোখে কোনো একটি বস্তু বা প্রাণীকে অদৃশ্য করে ফেলা যায়। রাতে মা হেলেনার সাথে সারা রাত ছিলেন। মেয়ের শ্বাসপ্রশ্বাস গাঢ় ছিলো খুব। স্বপ্ন দেখলে চোখের ভেতর একটা মুভমেন্ট হয়। হেলেনার সে ধরনের কিছু হয়নি। শেষরাতে সে প্রত্যেকবারের মত ঘুম থেকে জেগে উঠে প্রচণ্ড ভয় পেয়ে। যেহেতু তার কোনো রেপিড আই মুভমেন্ট হয়নি এবং সে জেগে উঠেছে,তার মানে দাঁড়ালো তার আসলেই দুটো স্বত্ত্বা,দুটো স্বত্ত্বা ঘুমের মাঝে আলাদা হয়ে ভাগ হয়ে যায়। অন্য সময় একসাথেই থাকে কিন্তু সুপ্ত অবস্থায় থাকে।
ডাক্তার বললেন,এর যেকোনো একটি স্বত্ত্বাকে বিলুপ্ত করতে হবে। যে স্বত্ত্বাটি ঘুমের মাঝে আলাদা হচ্ছে তাকে একেবারে আলাদা করে দিতে পারলে হয়তো এর থেকে মুক্তি মিলবে। এর জন্য প্রয়োজন হবে হাই পাওয়ারের স্লিপিং ইঞ্জেকশান। যেহেতু ঘুম থেকে জেগে উঠলেই স্বত্ত্বাটি সুপ্তাবস্থায় মিলিত হতে বাধ্য হচ্ছে,সুতরাং একে ওই জগত থেকে ফিরতে দেওয়া যাবে না। হেলেনাকে দুদিনের জন্য ঘুমন্ত অবস্থায় রাখা হলো যাতে করে ওই স্বত্ত্বাটি ফিরতে চেয়ে বাঁধাগ্রস্ত হয়। দুদিন পর হেলেনার জ্ঞান ফিরেছে এবং সেদিনের পর থেকেই সে সুস্থ স্বাভাবিক জীবনযাপন করছে। হেলেনার সমস্যাটির সমাধান বৈজ্ঞানিক উপায়ে করা গেলেও সমস্যাটির কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা কেউ দাঁড় করাতে পারেনি। স্থানীয় গির্জার ফাদার হেলেনাকে পবিত্র আত্মা হিসেবে মান্য করে এখন তার নামে প্রতি রোববারে প্রার্থনা করেন। এই হলো ঘটনা।
কিন্তু আমার ব্যাপারটি তো পুরোপুরি ভিন্ন! আজ কি একবার চেষ্টা করবো মেঘালয়ের কথা মত? চাইলেই তো আবার চলে আসতে পারি।
বেলকনি দিয়ে আকাশমণি,শুভ্রাক্ষি আর ইচ্ছেরাণী আসছে ডানা ঝাপটিয়ে। কী যে সুন্দর লাগছে! আসলেই স্বপ্নের জগতের পাখির মত!
খাবার দিলাম। তারা খেলো।
দরজা বন্ধ করে তিনটা পাখিকে ঘাঁড়ের উপর নিয়ে আয়নার সামনে বসেছি। চোখ বন্ধ। সাত থেকে এক পর্যন্ত গুনতে শুরু করেছি। বুঝতে পারছি চোখে ঘুম নেমে আসছে। চারপাশের আওয়াজতে মনে হচ্ছে খুব দূরের কোনো অস্পষ্ট আওয়াজ। ধীরে ধীরে তিন দুই এক।
যখন জেগে উঠলাম তখন চারদিক ঘোলাটে তুলোর মেঘে কিংবা কুয়াশায় ঢাকা। হাত দিয়ে সরিয়ে নিলে খানিকটা দূর দেখা যায়। নিজেকে খুব হাল্কা লাগছে। একটুপরই হাসি হাসি মুখ করা একটা বাচ্চা মেয়ে কোত্থেকে যেন এসে আমার হাত ধরে ভেতরের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। মেয়েটিকে চেনা চেনা লাগছে। কোথাও কি দেখেছি? ও হ্যাঁ! এ তো সেই পাশের বাসার ছন্দা! সেও এই জগতে? ভীতি মাখা শংকা কিছুটা কাটলো। চারপাশ দেখছি! কী যে সুন্দর! আকাশে রঙিন কাপড়ের ফানুস। যাতায়াতের জন্য প্যারাসুট। কোনো ট্র্যাফিকের ঝামেলা নেই। শত শত রং বেরঙের প্যারাসুট উড়ছে। উপর থেকে সবাই আমাকে অভিবাদন জানাচ্ছে। এখানে কি সবাই সবাইকে এমন করে? কী অদ্ভূত রকমের মায়া এ জগতে!!
ছন্দা আমাকে মেঘালয়ের কাছে নিয়ে এসেছে। শ্যামবর্ণের লম্বাটে মুখের লম্বা একজন সুদর্শন যুবক,তার চোখে রাজ্যের মায়া। চোখে পানি টলমল করছে,মনে হচ্ছে এক্ষুনি কান্না করে দিবে! ইংরেজীতে এ ধরনের চোখকে বলে লিকুয়িড আই।
ভালো আছো নীলাঞ্জনা?
জ্বী ভালো। আপনি?
স্বপ্নের জগতে খারাপ কেউ থাকে না। এখানে খারাপ নেই,পাপ নেই। চিঠিতে লিখেছি।
আমি স্বলজ্জে হাসলাম খানিকটা। কী অদ্ভুত মায়া এই যুবকের কথায়,হাসিতে! নাকি এ জগতের সবই মায়া?
কী? চুপ কেন? যাবে নাকি থাকবে?
আজ যাই আপাতত। সবাই চিন্তা করবে।
চিন্তা করলে তাতে কি? ক দিন চিন্তা করে ভুলে যাবে। ছন্দা পর্যন্ত এখানে এসে আর যেতে চাইছে না। আর তুমি পারবে না?
প্লিজ জোর করবেন না। কাল সকালে তো সময় আছেই। তখন নাহয় আসবো।
ঠিক আছে, তোমার ইচ্ছে।
পরদিন সকালে আবার গিয়েছি।
এখন গেলে আর দু তিন দিনে আর আসি না। মন খারাপ হলেই চলে যাই। দরজা বন্ধ থাকে। কেউ বুঝতেও পারে না। যাওয়ার আগে বাবাকে বলে যাই দু তিনদিন দরজা ধাক্কাধাক্কি না করতে। জিজ্ঞেস করলে কিছু না বলে একটা মুচকি হাসি হেসে চলে আসি। মা কান্না করতো আগে আগে। এখন মাও অভ্যস্ত। বাবাও।
কাল সকালে আবার চলে যাবো আকাশমণি,শুভ্রাক্ষি আর ইচ্ছেরাণীকে সাথী করে। রাতে ওরা আমার সাথে ঘুমাবে। সকালের সূর্য উঠলেই আমি স্বপ্নের মেঘ ছোঁব!

মিষ্টি ডানা সম্পর্কে

অসংজ্ঞায়িত!!
এই লেখাটি পোস্ট করা হয়েছে গল্প-এ। স্থায়ী লিংক বুকমার্ক করুন।

3 Responses to চিরকুটে মায়া-আমন্ত্রণ

  1. sr safi বলেছেনঃ

    আমি কী এটা নিজের ব্লগে প্রকাশ করতে পারি।

  2. রুহশান আহমেদ বলেছেনঃ

    অসাধারন! তবে হেলেনার ঘটনাটা পড়তে গিয়ে গল্পের ফ্লোতে একটু ছেদ পড়েছিলো মনে হয়।

    যাই হোক, পড়ে আনন্দ পেয়েছি।

  3. মিষ্টি ডানা বলেছেনঃ

    মজার ব্যাপার হলো, অনেকদিন পর পড়ার কারণে আমি নিজেই ভুলে গিয়েছিলাম যে হেলেনা নামক কোনো মেয়ের কথা আমি লিখেছি!! পরে পড়ে বুঝতে পারলাম :p

    যাই হোক, অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনাকেও, আমাকে উৎসাহিত করার জন্য। 🙂

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।