গো+এষনাঃ পর্ব-০৫

সায়েন্স ম্যাগাজিন নাকি চটি

গবেষণা মানে শুধুই ল্যাবে কাজ করা না। লেখালেখি, উপস্থাপন, কনফারেন্স সব কিছুই করা লাগে। তবে আজকের গল্পটা একটু ভিন্ন। দুই জন লাইফ সায়েন্স স্টুডেন্টের ম্যাগাজিন বের করা নিয়ে।

তখন তৃতীয় বর্ষে পড়ি। বায়োকেমিস্ট্রি, জেনেটিক্স, মলিকিউলার বায়োলজির অনেক বিষয় নিয়েই নিজেরা নিজেরা আলোচনা করি। কিন্তু, সব সময় একটা সমস্যায় আমরা পড়তাম। যখন সাধারন মানুষকে বুঝাতে যেতাম ব্যাপার গুলো, তা খুবই কঠিন মনে হতো তাদের কাছে। সত্যিকার অর্থে এই সকল পড়ালেখার অথবা গবেষণার মূলেই হল মানুষের জীবনের পরিবর্তন। আর তা যদি মানুষ বুঝতে না পারে, অনুধাবন করতে না পারে, তাহলে পুরো ব্যাপারটাই মাঠে মারা যাবে। এসব চিন্তা করে করেই, আমি আর আমার এক বন্ধু মিলে একটা সায়েন্স ম্যাগাজিন বের করবো বলে সিদ্ধান্ত নেই।

যেই কথা সেই কাজ। লেগে গেলাম। লেখা সংগ্রহ করতে থাকলাম। নিজেরা ও লিখলাম কিছুটা। একটা পর্যায়ে গিয়ে বুঝে গেলাম যে পর্যাপ্ত পরিমানে লেখা পেয়ে গেছি আমরা। এবার ভাবতে শুরু করলাম ডিজাইন নিয়ে। আমাদের এক পরিচিত বন্ধু ছিল, যে অসম্ভব ভালো কার্টুন আঁকে। সে আমাদেরকে কাভারের জন্য কিছু চমৎকার কার্টুন এঁকে দিলো। নিজেদের দিক থেকে শুরু করার জন্য যা যা দরকার ছিল, তা হয়ে গেলো। নাম ঠিক করলামঃ “হেলথ কর্নার”।

Cover

ছাপানোর জন্য প্রেস লাগবে। তার আগে প্রেসে পাঠানোর মত করে ডিজাইন করা লাগবে পৃষ্ঠা গুলো। এবার ও এক বন্ধুর দূর সম্পর্কের আত্মীয় খুজে বের করলাম। তিনি কাটাবনে কাজ করেন। নিজের প্রেস আছে। জাহাঙ্গীর ভাই। মুশকিল হল যেই সকল লোক ডিজাইনের কাজ করে তাদের বিজ্ঞানের কোন জ্ঞান নাই। তাই পুরো সময় তাদের সাথে বসে থেকে দেখানো লাগতো কিভাবে কি করা লাগবে। খুবই কষ্ট সাধ্য কাজ। তবে কাজের ফাকে ফাকে তারা আমাদের কাজ থেকে অনেক কিছু শিখেছে। কোন রোগ কেন হয়, কেন আমরা কোন ওষুধ খাই এই সব আর কি।

যুগটা আধুনিক। যাই করেন না কেন, একটা ওয়েব সাইট লাগে। আইটির বন্ধুদের ধরলাম। সামান্য পয়সা দিয়ে ১ জিবি জায়গা খরিদ করে ওয়েব সাইট বানানো হল। নিজেদের ওয়েব সাইট দেখতে ভালই লাগতো। ইচ্ছা মত কনটেন্ট অ্যাড করতাম। ফেসবুক পেজ ছিল। সব কিছুই বেশ গুছানো।

বাস্তবতা সামনে চলে আসলো। ছাপানোর জন্য টাকা লাগবে। এক এক জনের কাছে ঘুরতে লাগলাম। আমার পার্টনার, মিরাজের একটা বাইক ছিল। সেটাতে করে আমরা কাকরাইল, মতিঝিল, গুলশান, বাড়িধারা ঘুরতে থাকলাম স্পন্সরের জন্য। দুই একটা অভিজ্ঞতা না বললেই না। এক সফটওয়্যার ফার্মে গেলাম। ঐ ফার্মের মালিক খুবই বিখ্যাত মানুষ। নাম বলছি না। নাম বললে সবাই চিনবে উনাকে। অনেক ক্ষণ বসিয়ে রেখে, ইনিয়ে বিনিয়ে অনেক কথা বলে বিদায় করে দিলেন। অপেক্ষা করার এক পর্যায়ে উনার কর্মচারী বললঃ “আপনারা টাকার জন্য উনার কাছে আসছেন। অফিসের অবস্থা দেখে বুঝেন না, উনার নিজেরই চলে না, আপনাদের টাকা দিবে কিভাবে!” আর একজন এর কাছে গেলাম, যিনি আমাদের বিভাগ থেকে অনেক আগে পাশ করে গেছেন। তখন একটা মাল্টি ন্যাশনালে কাজ করতেন। গিয়ে জানতে পারলাম, উনি এখানে থেকে মাস ছয়েক আগে বদলি হয়ে আমেরিকা চলে গেছেন। একই সাথে আনন্দের এবং দুঃখের। আনন্দের কারণ হল ভবিষ্যতে আমরা ও এমন জব পাবো, দুঃখের হল স্পন্সর পাওয়ার আশা নাই। কিছু বাজে অভিজ্ঞতা ও আছে। এক জনের কাছে স্পন্সরের জন্য গিয়েছিলাম। তো উনার সাথে উনার গাড়িতেই সব কথা হল। উনি আমাকে নিয়ে আসলেন আই বি এ তে। নামাজের সময় হয়ে গিয়েছিলো।  দুপুরের নামাজ পড়লাম, উনার সাথে খেলাম। উনি আমাকে বললেনঃ “তোমাকে এখানে নিয়ে আসার কারণ হল আমি তোমাকে দেখা চাচ্ছিলাম যে মানুষ কত টা স্মার্ট হয়। এভাবে স্যানডাল পড়ে আসলে কেউ স্পন্সর করবে না।” উনি হয়তো জানেন না যে, আমি জীবনে কোন দিন স্যুট আর টাই পড়ি নাই। ঐ গুলো দাসদের পোশাক। আর কিছুই না। এমন একটা পর্যায়ে তত দিনে চলে গেছি যে পিছনে ফিরে আসার মত মানসিকতা ছিল না। নিজেদের টাকা দিয়েই ম্যাগাজিন বের করবো বলে সিদ্ধান্ত নেই। মিরাজের টিউশনির টাকা আর আমার স্কলারশিপের টাকা ঢাললাম ম্যাগাজিনের পিছনে।

ছাপা হয়ে গেলো। বিক্রি করা লাগবে। কিভাবে বিক্রি করবো, সাপ্লাই চেইন নাই। নিজেরাই নীলক্ষেত থেকে শুরু করে প্রেস ক্লাব, সব জায়গায় গিয়ে খোজ নিতে শুরু করলাম। বিভিন্ন ইউনিভার্সিটি আর স্কুল কলেজে ও যাওয়া হল। কিন্তু, বুঝে গেলাম। মানুষ এখন আর পড়ে না। আর টাকা দিয়ে কিছু পড়ার অভ্যাস এই প্রজন্মের মধ্যে কমে গেছে। যাই হোক। ছাপানো যেহেতু হয়েছে, বিক্রি করা লাগবে। টাকার ব্যাপার। এক হকার বুদ্ধি দিলোঃ “মামা, এই সব সায়েন্স পোলাপাইন পড়ে না। সেক্স বিষয়ক যদি কিছু ঢুকাইতে পারেন, তাই সেক্স গাইড বানাইয়া চালায় দিতে পারমু। আর ঢাকা শহরে ভ্যানে কইরা যারা মলম বেচে, তারা সেক্স গাইড ও বেচে। আমি চিনি কয়েক জনরে। আমি আপনার টাকা তুলে দিতে পারমু।”

আর যাই করি, টাকার জন্য নিজের স্বপ্নের কিছুকে সেক্স গাইড বানাতে পারি নাই। নিজেদের পরিচিত মানুষদের দিয়েছি অনেক কপি। অনেকে খুশি হয়ে টাকা দিয়েছিলো। কিন্তু, সত্যিকার অর্থে বিশাল লোকসানে ছিলাম। কয়েক মাস লেগেছিল আর্থিক এবং মানসিকভাবে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে।

তবে এই কাজ করতে গিয়ে আমার একটা গভীর অনুভূতি হয়েছে। আমাদের দেশে যদি সব লাইব্রেরী বন্ধ করে দেয়া হয়, সব পাঠ্য বই তুলে নেয়া হয়, এদেশের শিক্ষা ব্যাবস্থায় তেমন কোন পরিবর্তন আসবে না। কারণ, সব কিছুই আজ পাওয়ার পয়েন্ট স্লাইড নির্ভর, সব কিছুর পিডিএফ ভার্সন আছে। আর মানুষ পড়তে ভুলে যাচ্ছে। এমন একটা প্রজম্ন আসবে যারা কখনো নীলক্ষেত থেকে বই কিনে টাকা শেষ করে পায়ে হেটে বাড়ি ফিরার অনুভূতি বুঝতে পারবে না!

আরিফ আশরাফ সম্পর্কে

Work with plants, Read on Kindle, Watch on Netflix, Listen BBC World Service, Follow Real Madrid and Write on Blog
এই লেখাটি পোস্ট করা হয়েছে বিবিধ-এ। স্থায়ী লিংক বুকমার্ক করুন।

1 Response to গো+এষনাঃ পর্ব-০৫

  1. Joy Shome বলেছেনঃ

    আবার এমন অনেকও আছে যারা টাকার অভাবে বই কিনে পড়তে পারে না। তারপরও তারা চালিয়ে যায়।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।