আপনি কি প্রেম করেন?
বন্ধুদের সাথে চায়ের কাপ হাতে তুমুল আড্ডায় মেতে ওঠেন?
কিংবা পড়াশোনা করেন?
পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা লিখতে লিখতে কলমের কালি শেষ করে ফেলেন?
কিংবা স্যার লেকচার দেবার সময় চুপিসারে চোখ মুদে ঘুমিয়ে পড়েন?
আপনি কি খেলাধূলা করেন?
ব্যাটে রানের ফুলঝুরি ছোটাতে খুব ভালোবাসেন? কিংবা বল হাতে ব্যাটসম্যানের স্ট্যাম্প উড়িয়ে দিতে ভালোবাসেন?
প্রতিদিন সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে অফিসে যান?
আপনি কি বেঁচে থাকেন?
আমি জানি, শেষ প্রশ্নটা দেখে অনেকেই একটু ভুরু কুঁচকে তাকিয়েছেন। অবাক হবার কিছুই নেই। বেঁচে থাকাও একটা কাজ। একটা ব্যাপার খেয়াল করেছেন, প্রশ্নগুলো আলাদা আলাদা মনে হলেও এর প্রতিটিই কিন্তু আসলে একটা জায়গায় এক।
আপনার প্রতিদিনকার এই কাজগুলো ঠিকঠাকভাবে চালিয়ে যাবার জন্যে আপনাকে নির্ভর করতে হয় আপনার মস্তিষ্কের উপর। আপনার প্রতিদিনকার কাজগুলো ভালোভাবে চালিয়ে নেবার আপনার মস্তিষ্ক প্রতি মুহুর্তে হাজার হাজার দিকে নজর রাখছে, নিজে সরাসরি অংশ নিয়ে সেগুলো সম্পন্ন করছে। বাবা-মা’র সাথে সময় কাটানো, প্রেমিকার সাথে মিষ্টি-মধুর খুনসুটি করা, বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেয়া ক্লাসের পড়া তৈরি করা, দেশ-দশকে নিয়ে চিন্তা করা, কবিতা লেখা, খেলাধূলা করা – আপনার সব কাজই নিয়ন্ত্রণ করছে আপনার নিউরন কোষগুলো। এমনকি আপনি যে খাওয়া-দাওয়া করছেন, সেগুলো যেন পেটের ভেতর ঠিকমত হজম হয়, আর তারপর কোন ঝামেলা না করেই টয়লেটে চলে যেতে পারে, সেদিকেও নজর রাখতে হয় এদেরকেই। আপনার বেঁচে থাকার জন্যে শ্বাস-প্রশ্বাস চালিয়ে যাওয়া দরকার, কিডনিগুলোর কাজ-কর্ম চালিয়ে যাওয়া দরকার, হার্টটার ঠিকমত রক্ত পাম্প করতে থাকা দরকার- এগুলোও নিয়ন্ত্রণ করছে আপনার মাথার খুলির ভেতর থাকা মাত্র ১৩০০ গ্রাম ওজনের এই মস্তিষ্কটাই!
বোঝাই যাচ্ছে, এই নিউরন কোষগুলোর ব্যস্ততার কোন শেষ নেই। সারাদিন এরা অক্লান্ত পরিশ্রম করে আপনাকে ভালোভাবে টিকিয়ে রাখে, বাঁচিয়ে রাখে।
আপনি খাওয়া-দাওয়া করেন শক্তি পাবার জন্যে। খাবার থেকে আপনার শরীর কাজ করবার জন্যে দরকারী শক্তি পায়। শরীর যখন খাবার থেকে শক্তি তৈরি করে, সেই শক্তি ব্যবহার করে কোন কাজ করে, আমাদের দেহে কিছু বর্জ্য পদার্থ তৈরি হয় (এই বর্জ্য পদার্থ যে শুধুই পায়খানা আর প্রস্রাব, সেটা ভাবার কোন কারণ নেই)। আমাদের কোষগুলোও যখন কোন কাজ করে, তারাও কিছু বর্জ্য পদার্থ তৈরি করে। এই বর্জ্য পদার্থগুলোর মাঝে একটা হল এডিনোসিন। কোষগুলো যত বেশী কাজ করে, তত বেশী এডিনোসিন তৈরি হতে থাকে।
আমাদের নিউরন কোষগুলোর গায়ে একরকমের রিসেপ্টর থাকে, যা এডিনোসিনের সাথে যুক্ত হতে পারে। কোষগুলো থেকে বের হওয়া এডিনোসিন যখনই নিউরনের এই রিসেপ্টরের সাথে এসে লেগে যায়, নিউরন তখন ভাবে, ‘ধুর! ম্যালা কাজ করছি! এখন ঘুম দরকার আমার!’
এভাবে একটা একটা করে যখন যথেষ্ট পরিমাণ নিউরন ক্লান্ত হয়ে যাবে, তাদের ঘুমুতে ইচ্ছে করবে, আপনি নিজেও তখন ক্লান্ত বোধ করতে শুরু করবেন। আপনার সেই মুহুর্তে দরকার হবে ঘুম।
আপনি ঘুমিয়ে গেলে মস্তিষ্কের কোষ স্করিয় হয়ে ওঠে। এই কোষদের কাজটা অনেকটা সুইপারের মত, এরা সারাদিনের কাজকর্মের ফলে তৈরি হওয়া বর্জ্য পদার্থ খুঁজে পেতে ধুঁয়ে-মুছে সাফ করে ফেলে। ঘুম হল মস্তিষ্কের ধোঁয়া-মোছা করার সময়।
ঘুম থেক আপনি যখন ওঠেন, আপনার পুরো মস্তিষ্ক তখন একদম ঝকঝকে-তকতকে পরিষ্কার, সেখানো তেমন কোন এডিনোসিন আর অবশিষ্ট থাকে না। পরিষ্কার জামা পরলে যেমন বেশ সতেজ লাগে, তেমনি পরিষ্কার মগজ নিয়েও আপনার খুবই সতেজ লাগে। ঘুম থেকে ওঠার পর এজন্যেই খুব সতেজ লাগে।
আমি যখন বলছিলাম, ক্লান্ত হলে ঘুম পায়, তখনই আবার একটা প্রশ্ন এসে মাথায় উঁকি দেয়। সেটা হল- চা বা কফি খেলে (পান করলে) কেন তাহলে ক্লান্তি চলে যায়? চা/কফি কি এডিনোসিন পরিষ্কার করতে পারে?
উত্তর হল, না।
আসলে, চা/কফিতে থাকে ক্যাফেইন। ক্যাফেইনের একটা বৈশিষ্ট্য হল, এটা নিউরনের একটা রিসেপ্টরের সাথে যুক্ত হয়ে পারে। এবং দুর্ভাগ্য কিংবা সৌভাগ্য- যাই বলি নাকেন, ক্যাফেইন নিউরনের সেই রিসেপ্টরের সাথেই যুক্ত হতে পারে, যেটার সাথে সাধারণত যুক্ত হতে পারে এডিনোসিন। ক্যাফেইন মশাই যখন নিউরনের এডিনোসিন রিসেপ্টরের সাথে যুক্ত হয়ে যায়, এডিনোসিন আর সেখানে যুক্ত হতে পারে না। তাই আপনার নিউরনও বুঝতে পারে না যে, সে আসলে ক্লান্ত। বোকা নিউরন ভাবে, সে খুবই সতেজ আর খুব ভালোমত কাজ করতে পারছে! ঘুমানোর তো প্রশ্নই আসে না! নিউরনগুলো যেহেতু নিজেদের ক্লান্ত ভাবছে না, তাই আপনারও নিজেকে ক্লান্ত ভাবার কোন কারণ নাই!
কিন্তু তাই বলে কি আপনি ক্লান্ত নন?
না, ব্যাপারটা সেরকম না। আপনি আসলে ক্লান্ত হচ্ছেন। নিউরনগুলো যখন কাজ করছে, তারা এডিনোসিন তৈরি করছে ঠিকই। কিন্তু সেগুলো যেহেতু এডিনোসিন রিসেপ্টরের সাথে এসে যুক্ত হতে পারছে না, তাই আপনি বুঝতে পারছেন না যে আপনি ক্লান্ত। আপনি বুঝতে পারছেন না যে, আপনার মস্তিষ্ক ভরপুর হয়ে আছে বর্জ্য পদার্থে! এই আবর্জনাময় মস্তিষ্ক নিয়ে ভালো কাজ করা যে খুব সম্ভব, সেরমকম নয়। তাই মনোযোগ দিয়ে, ভালোভাবে কাজ করবার জন্যে বিশ্রাম খুবই দরকারী! প্রেম করা, আড্ডা দেয়া, পড়াশোনা করা, অফিসে যাওয়া- সবকিছুর জন্যেই বিশ্রাম খুব প্রয়োজন।
ছেলে বেলায় ভাব-সম্প্রসারণ পড়েছিলাম, ‘বিশ্রাম কাজের অংগ একসাথে গাঁথা, নয়নের অংশ যেমন নয়নের পাতা’। আসলেই কিন্তু ব্যাপারটা এমন, বিশ্রাম নেয়ার মনে হল মস্তিষ্ক যেন নিজেকে পরিষ্কার করার কাজটা সেরে নিতে পারে, সেই সুযোগ দেয়া! মানে আপনি যখন ভাবছেন আপনি বিশ্রাম নিচ্ছেন, আসলে কিন্তু আপনি কাজ করছেন। আপনি তখন আপনার মস্তিষ্কটাকে ধুঁয়ে-মুছে পরিষ্কার করবার কাজটা করছেন। মানে, বিশ্রাম নেয়াটা আসলেও একটা কাজ!
ভালো লাগলো তথ্যসমৃদ্ধ লেখাটি :huzur: