মহাকর্ষীয় ঢেউ (গ্র্যাভিটেশনাল ওয়েভ) নিয়ে কেন এই সমারোহ?

মহাকর্ষীয় তরঙ্গ বা ঢেউ (বিজ্ঞানীর কল্পনা)

[ পত্রপত্রিকা আর গণমাধ্যমে হইচই – মহাকর্ষীয় তরঙ্গ নিয়ে। কি এই তরঙ্গ, কিভাবে এল এ আবিষ্কার, আর কেন এটি এত গুরুত্বপূর্ণ? -তা জানতে গিয়ে আমার এই ক্ষুদ্র চেষ্টা ]

 

ইতিহাস থেকে আইনস্টাইন

হাজার বছর ধরে মানুষ ঊর্ধ্বে তাকিয়েছে বিস্ময়ে, রাতের আকাশে। হাজার হাজার আলোক বিন্দু কিভাবে ঝুলে থাকে? সেই হাজার বছরের  কৌতূহলী মন নিয়ে সেখানে এলো নিউটনের মত বিজ্ঞানী। আবিষ্কার করলেন, আপেলকে মাটিতে টানে যে বল ((অভিকর্ষ)) সেই একই বলই আবার বড় বড় গ্রহ নক্ষত্রগুলোকে নিজ নিজ কক্ষপথে ভাসিয়ে রাখে। এই বলটির নাম দিলেন গ্র্যাভিটেশনাল ফোর্স ((আদপে বাংলায় নাম দাঁড়ায় অভিকর্ষীয় বল, কিন্তু, বাংলা পণ্ডিতেরা নাম রাখলেন, মহাকর্ষীয় বল।))।

বিজ্ঞানী নিউটন সেই ১৬৮৭ সালে তার বিখ্যাত বই ‘প্রিন্সিপিয়া ম্যাথম্যাটিকা-তে যাবতীয় মহাকাশীয় বস্তুর চলপথের গাণিতিক সূত্র দিয়ে গেলেন। অদেখা মহাকর্ষীয় বলের জন্য নানান স্থির ((কনস্টেন্ট)) আর চলরাশির প্রবর্তন করে গেলেন, কিন্তু, একটা বিষয় ছাড়া। নিউটন ব্যাখ্যা করতে পারেন নি, কিভাবে, দুটি মহাকাশীয় বস্তু, যেমন পৃথিবী ও সূর্য, লক্ষ লক্ষ মাইল দূর থেকেও নিজেদের অবস্থান বুঝতে পারে? কিভাবে তাদের মাঝে এই অশরীরী যোগাযোগ হয়। ((মনে রাখবেন, তখন এই রেডিও তরঙ্গ বা মোবাইল বেতার প্রযুক্তির কখনো ধারনাই নেই। আরও কমসে কম দুশ বছর বাকি।))

আইনস্টাইন এলেন বিংশ শতকের শুরুতে। তখন তড়িৎ আর চুম্বক বল নিয়ে বেশ অনেক গবেষণা চলেছে। আলোর গতি, বিদ্যুতের ঝলক আর চুম্বকের আকর্ষণের মাঝে গাণিতিক সূত্র তখন প্রতিষ্ঠিত। রেডিও তরঙ্গ দিয়ে যোগাযোগও শুরু হয়েছে। যেন সবকিছুই আবিষ্কার হয়ে গেছে। আজকে যেমন আমরা ভাবি, আর কি আবিষ্কার হবে, সবই তো হল। আইনস্টাইন, পেটেন্ট অফিসের পদার্থবিদ্যায় স্নাতক কিন্তু সামান্য কেরানী, মাথায় নিয়ে বসলেন, নিউটনের সেই অবোধ্য সমস্যা। কোন যন্ত্রপাতি ছাড়াই, স্রেফ নিজের সৃজনশীলতা আর গাণিতিক প্রজ্ঞা দিয়ে, ফেঁদে বসলেন এক অসম্ভব গল্প। গত শতকের সবচেয়ে বড় গল্প, ‘আপেক্ষিকতা তত্ত্ব’।

 

আপেক্ষিকতা ও মহাকর্ষ

বাঘা বাঘা বিজ্ঞানীদের পাশ কাটিয়ে তিনি কলমে অংকে দাবী করে বসলেন, মহাকর্ষীয় শক্তি তড়িৎচুম্বকীয় শক্তি মতই একটা শক্তি ((আলো ও তড়িৎচুম্বকীয় বল তরঙ্গ আকারে খালি স্থানের মধ্য দিয়ে ছড়ায়। কোন মাধ্যম লাগে না। ))। এটা অন্যগুলোর মত আলোর গতিতেই ছুটে যায়। অর্থাৎ, হঠাৎ যদি সূর্য কোন কারণে গুম হয়ে যায়, তাহলে, তার আলোর নিভে যাওয়া যেমন আমাদের চোখে ৮ মিনিট ((সূর্য থেকে পৃথিবীতে আলো প্রতি সেকেন্ডে তিন লক্ষ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে আসতে সময় লাগে ৮ মিনিট ১৯ সেকেন্ড। কারণ, পৃথিবী সূর্যের মধ্যবর্তী দূরত্ব প্রায় ১৫ কোটি কিলোমিটার।)) পরে ধরা দেবে, ঠিক তেমনি, সূর্য দ্বারা সৃষ্ট মহাকর্ষীয় বলের অভাব টের পেতেও আমাদের আট মিনিট সময় লাগবে।

কিন্তু, এখানে আপেক্ষিকতার কি আছে? এখানেই আইনস্টাইন গুরু। বাকিরা শিষ্য। আইনস্টাইন বললেন, এই যে আমরা, আমাদের পৃথিবী সুদ্ধ,  মহাকর্ষীয় বলের কারণে সূর্যের চারপাশে ঘুরে মরছি, এই মহাকর্ষীয় বল আসলে কাজ করে স্থান-কাল-পাত্রের উপর। মানে, আমরা যেমন চাপ/বল দিয়ে একটা রাবারকে কুঁচকিয়ে ফেলতে পারি, মহাকর্ষ মহাশয়, স্থান ও সময়কে কুঁচকিয়ে ফেলে অনায়াসে ((এই তত্ত্বটি মূলত: আইনস্টাইনের আপেক্ষিতার সাধারণ তত্ত্বের অন্তর্গত। আপেক্ষিকতার আরেকটি তত্ত্ব তথা বিশেষ তত্ত্বে মূলত, তুলনামূলক গতিশীল বস্তুর গতির কারণে সৃষ্ট স্থান কাল পরিবর্তনের কথা আছে।))। যত বড় বস্তু, তত বেশী মহাকর্ষীয় বল, তত বেশী স্থানের সংকোচন। মহাশূন্যে যদি, কোন খালি জায়গায়, দুটি বিন্দুর দূরত্ব মাপি ১০ কি.মি., একটা নক্ষত্র এর কাছাকাছি এসে গেলে, তখন ফিতা দিয়ে সেই দূরত্ব মাপলে অনেক কম হয়ে যাবে। তেমনি সময়ও ভিন্ন হবে।

স্থান – সময় দুটোরই আসলে কোন স্থির মান নেই। বরং, আশে পাশের মহাকর্ষীয় বলের উপস্থিতিতে তারা নিয়মিত বাড়ে কমে। এটাই আপেক্ষিকতা ((আপেক্ষিকতায় স্থান সময়ের এই কারসাজির একটা ভাল কল্পকাহিনী দেখানো হয়েছে ‘ইন্টাস্টেলার’ নামক ছায়াছবিটিতে।))।

 

মহাকর্ষীয় বল থেকে মহাকর্ষীয় ঢেউ

আইনস্টাইন তার সূত্র প্রয়োগে দেখালেন, যে কোন বড়সড় বস্তু, গ্রহ-নক্ষত্র, তার চারপাশের স্থান ও সময়ের গাঁথুনিতে একটা সংকোচন তৈরি করে। এর ফলে গতিশীল বস্তু তৈরি করে গতিশীল সংকোচন। এখন, যদি বস্তুটির মহাকর্ষীয় বলের মান ও দিকে যদি কোন বড় ধরনের পরিবর্তন আসে; যেমন, যদি নক্ষত্রটির উপরিতল এবড়ো থেবড়ো হয় এবং নক্ষত্রটি আরেকটি নক্ষত্রের সাথে চলমান সংঘর্ষে (অথবা পারস্পরিক ঘূর্ণনে) লিপ্ত হয়, তাহলে, তার মহাকর্ষীয় বলের ফলে যে সংকোচন – প্রসারণ, তা অনেক দূর পর্যন্ত ঢেউয়ের আকারে ছড়িয়ে পড়ে। এই সেই গ্র্যাভিটেশনাল ওয়েভ।

 

আমাদের পৃথিবীর দিকে যদি এরকম কোন ঢেউ আসে, এবং আমরা তখন স্থান ও কালের মধ্যে কম্পন মাপতে পারি, তাহলে আমরা সেই মহাকর্ষীয় বলের ঢেউ চিহ্নিত করতে পারব। আইনস্টাইন এটা বলে গেছেন ১৯১৫ তে। কিন্তু, পৃথিবীকে স্থান-কালের মাঝে সূক্ষ্ম থেকে ক্ষীণতর পরিবর্তন মাপার মত যন্ত্র তৈরি করতে অপেক্ষা করতে হয়েছে আরও একশো বছর। অবশেষে গত সেপ্টেম্বর ২০১৫ তে দুটি এল-আই-জি-ও (LIGO ((Laser Interferometer Gravitational-Wave Observatory, এই প্রজেক্টটি আজ ১১ ফেব্রুয়ারী সফলভাবে মহাকর্ষীয় তরঙ্গ সনাক্ত করার ঘোষনা দেয়।)) ) গবেষণাগার  কাজ শুরু করে। দুই মাসের কম সময়ে, প্রায় ১ বিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরত্বের দুটি পাশাপাশি কৃষ্ণ-নক্ষত্রের (ব্ল্যাক হোল ((এক প্রকার নক্ষত্র, যা খুব ভারী এবং এত বেশী ঘনত্বের যে, এর মহাকর্ষ বলের কাছে আলোও হার মানে। ফলে আলো পর্যন্ত এর তল থেকে বের হতে পারে না। তাই, নক্ষত্রটি দেখতে কাল গর্তের মত দেখায়))) সংঘর্ষের ফলে একটি কালো-নক্ষত্রে পরিণত হবার ঘটনা ধরা পড়ে। এটা টেলিস্কোপের মত কিছু নয়। বরং, এই সংঘর্ষের ফলে যে মহাকর্ষীয় ঢেউ, বিলিয়ন বছর ধরে আসতে আসতে পৃথিবীতে এসে পৌঁছেছে, তার ফলে সৃষ্ট খুবই কম সময় (প্রায় ২০ মিলি-সেকেন্ড) ধরে চলা এটা খুবই সামান্য স্থানের কম্পন রেকর্ড করা হয় ঐ লিগো মেশিনে। এরপর চরম গোপনীয়তায় কয়েক মাস নিশ্চিতকরণ গবেষণা চালানোর পর তা প্রকাশ করা হয় সবার কাছে।

ভিডিও: ্দুটি ব্ল্যাকহোল চারপাশে ঘুরতে ঘুরতে একিভূত হবার ঘটনা।

 

কেন এত খুশি সবাই?

বিজ্ঞানের যে কোন তত্ত্বের সফলতা হল তার ভবিষ্যৎবাণীর বাস্তব পরিণতিতে। আইনস্টাইন ১০০ বছর আগে বলে গেছেন অনেক কিছুই। তার মধ্যে একটি হলো যথেষ্ট সূক্ষ্ম ধারন যন্ত্রে স্কেল পাতলে (যেহেতু স্থানের কম্পন মাপবো) এরকম কম্পন ধরা দেবেই। ১০০ বছর চলে গেছে। তার ভবিষ্যৎবাণীর প্রত্যেকটার পরীক্ষামূলক প্রমাণ হয়ে গিয়েছে। শুধু এই মহাকর্ষ তরঙ্গ সরাসরি ((ভিন্ন পদ্ধতিতে এর আগেই এর অস্তিত্ব নিশ্চিত করা গিয়েছে।)) ধরার জন্য ১০০ বছর লাগলো আমাদের সভ্যতার এই সূক্ষ্মতা ((৪ কি.মি. দুরত্বের দুটি স্থির বিন্দুর দুরত্ব মাত্র ১ মিলিমিটারের ১কোটিকোটি ভাগের একভাগ পরিবর্তন মাপতে হয়েছে লিগো দিয়ে।)) অর্জন করতে। এটাই এত খুশির প্রথম কারণ।

তাই আমরা সামাজিক মাধ্যমে দেখছি #EinsteinWasRight এর মত হ্যাশ-ট্যাগ

ligo gravity waves

LIGO -র দুটি গবেষণাগারে সনাক্ত করা ২০ মিলি সেকেন্ডের স্থান-কালের কম্পন।

আরও কিছু খুশির ব্যাপার হল:

১. বিখ্যাত বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং সহ বাকি অনেক বিজ্ঞানীর দশকের পর দশক গবেষণা যে ব্ল্যাক-হোল নিয়ে, তার প্রকৃতি ও অবস্থান, সর্বোপরি দুটি ব্ল্যাক-হোলের পাশাপাশি অবস্থান (বাইনারি ব্ল্যাক-হোল) ও পরস্পরকে গলধ:করণের ঘটনার মীমাংসিত প্রমাণ পাওয়া গেল।

২. এই মহাকর্ষীয় ঢেউ ধরা পড়ার ঘটনায়, ভবিষ্যতে বিভিন্ন মহাকাশীয় ঘটনার সঠিক অবস্থান ও কারণ নির্ধারণের গবেষণা বহুদূর এগিয়ে গেল।

৩. বিগ ব্যাং এর ফলে সৃষ্ট সম্প্রসারণশীল মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ হারের ব্যাপারে আরও নিখুঁত হিসাব পাবার সম্ভাবনা দেখা দিল।

৪. থিওরি অব এভরিথিং তথা মহা-একীভূত তত্ত্ব নামে গবেষণায়, স্ট্রিং থিওরি ((এই তত্ত্ব মতে সবকিছু ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণা পর্যন্ত আসলে অতি ছোট ছোট তারের ন্যায় কম্পন দিয়ে তৈরি।)) নামে যে তত্ত্ব আছে, তার প্রমাণ মেলার একটা সুযোগ তৈরি হল। (উল্লেখ্য স্ট্রিং থিওরির সবচে বড় সমালোচনা হল, এর প্রমাণের কোন উপায় না জানা)

৫. সামনে আরও অনেক আরো ভাল মানের গবেষণাগার বসানোর কাজ ইতোমধ্যেই চলছে। এইভাবে দূর মহাকাশের একটা সামগ্রিক বুঝ আমাদের মাঝে তৈরি হবার একটা বিরাট সম্ভাবনা হয়ে থাকবে এই ছোট্ট কম্পনের আবিষ্কার।

 

বিজ্ঞানী এমিলির দেওয়া মহাজাগতিক মহাকর্ষীয় কম্পনের ব্লিপের শব্দ।

 

 

স্বাগতম হে মহাজাগতিক ঢেউ।

 

অন্যান্য একই ধরনের পোস্ট:

জ্ঞানচোর সম্পর্কে

সেই কবে জেগেছিলাম, বিলিয়ন বর্ষী নক্ষত্রের আলোয়, ডিরাকের সমুদ্রের পাড়ে। অবাক কৌতুহল নিয়ে গেলাম বহুদুর। তারপরও সহসা বুঝি, নিজে আমি,নিছক পড়ে থাকা ঝিনুকের খোলসে সোনালী অনুপাত খুঁজে বেড়াই। পড়ে থাকো তুমি, মহা সমুদ্র।
এই লেখাটি পোস্ট করা হয়েছে অনুপ্রেরণা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, বিবিধ-এ এবং ট্যাগ হয়েছে , , , , , , , , , , স্থায়ী লিংক বুকমার্ক করুন।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।