(১)
মেজাজটাই খারাপ হয়ে যাচ্ছে নাঈমার। অনেক্ষন ধরে চেষ্টা করেও শাড়িটা ঠিক মত পড়তে পারছে না। বারবারই ঝামেলা পাকায় শাড়িটা। হঠাৎ ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় চোখ পড়তেই দেখে তার দিকে তাকিয়ে দাঁত কেলিয়ে হাসছে সাদী;- তার স্বামী।
– এই দুষ্টু! কী দেখো?
– তোমার নাভী জানে
নতজানু সৎ প্রেমিকের
নজরটা কোনখানে!!
– যাহ্! পলাশের রক্তিম আভা ছড়িয়ে পড়ে নাঈমার গালে। ফর্সা বলে একটু বেশীই সুন্দর লাগে তাতে।
– মে অ্যাই হেল্প ইয়্যু?
– কুচিঁটা ঠিক করে দাও একটু।
– কাছে এসে শাড়িটা ঠিক করে দেয় সাদী।
ভাবনার জগতে হারিয়ে যায় নাঈমা। সাদী তাকে বিশ্বাস করেছে, নিজে ভেঙ্গে গুড়ো গুড়ো হলেও সব সয়ে ভালবেসে গেছে। নাঈমা তাকে অবহেলা করেছে, আঘাত করেছে, তুলনায় নামিয়েছে।
আর সাদী??
অপেক্ষা করেছে। যখন নাঈমার আসার কথা না তখনও। গত ১৫টা বছর। প্রতিটা দিন, প্রতিটা মুহূর্ত অপেক্ষা করেছে। একলা ভালবেসে গেছে, প্রতিদানহীন ভাবে। এত অন্ধভাবে কেও কেমনে ভালবাসে?
(২)
মাঝ রাতে ঘুম ভেঙ্গে গেলে রেডিও অন করে সাদী। জেমস গেয়ে চলেছেন,
কত ভালবাসা তোমার জন্য রাখা,
সে কথা তুমি যদি জানতে
বুক চিড়ে দেখাতে পারলে
লুকিয়ে চোখ তুমিও কাদঁতে।
জানালার পর্দা সরালে সাদী দেখে নীলচে কোমল আলো তার ঘরে ঢুকে পরছে। সুকান্তের রানারের মত আকাশময় ছুটে বেরাচ্ছে মেঘ। বারান্দায় এসে কাদঁছে সাদী। দু চোখ ভেঙ্গে জল আসছে। নাকের পেশী ফুলে গেছে। কান্নার দমকে শরীর কাপঁছে। নাঈমা আজ তাকে বলে দিয়েছে সে অন্য কাওকে চায়। সাদীর স্বপ্নটা অপূর্ণই থেকে যাবে। সাদী নাঈমাকে ভালবাসে যখন থেকে সে ভালবাসার অর্থ জানে, যখন থেকে একটা ছেলে একটা মেয়েকে নিয়ে ভাবতে শুরু করে, তখন থেকে।
কেন নাঈমা? কেন তুমি আমার হবে না? তোমাকে দেবীর আসনে বসিয়েছি, আমার মন্দিরে এমন কী নেই; যার জন্য তুমি আমার হবে না? তোমার অধরের স্পর্শ পেতে কত রাত ঘুমহীন কাটিয়েছি তুমি জানো? বিরবির করে বলে সাদী।
(৩)
সাদী নাঈমাকে প্রথম যেদিন দেখে সেদিনই সাদীর মনে আকাঁ হয়ে যায় নাঈমা। অবশ্য যেভাবে দেখাটা হয়েছিল তা মনে রাখার মতো বিশেষ কোন ঘটনা না। সাদী তখন স্কুল ছাত্র। দিনটা ছিলো শুক্রবার। সেন্ট প্লাসিড স্কুলে এসেছিলো আন্তঃস্কুল বিতর্ক প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে। সাদা মোজা স্কুল সু ইউনিফর্মে দেখে নাঈমাকে। স্কলাস্টিকা স্কুলের নাঈমাও একই প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে এসেছিলো।
– এক্সকিউজ মি! অডিটোরিয়ামটা কোনদিকে বলতে পারেন? –সাদীর প্রশ্ন
– সামনে গিয়ে ডানে। ওখানে স্টাফ আছে, দেখিয়ে দিবে। জবাব দেয় নাঈমা।
হাস্যজ্জ্বল নাঈমার রিনিঝিনি কন্ঠ শুনেই নাঈমার প্রেমে কুপোকাত বালক সাদী। একেবারে প্লেটনিক লাভ। ঐ বয়সে ফ্রয়েডিয় লাভ তত্ত্বটা খাটে না। সাদী তার অনুভূতিগুলো সবসময় বাক্স বন্দি করে রাখে। আর বলা হয় না ভালবাসি।
(৪)
ফোন বাজছে নাঈমার। নাম্বার দেখেই সে চিনতে পারে।
নাঈমা- হ্যালো!
সাদী- হ্যালো নাঈমা? কেমন আছো?
– এসবের মানে কী? এভাবে আর কত জ্বালাবে?
– কেমন আছো, শুধু সেটাই জানতে চেয়েছি।
– তুমি কী চাওনা আমি সুখু হই? কতবার বলবো তোমাকে পছন্দ করি না। তোমাকে দেবার জন্য আমার কিছুই নেই।
– কিছুই তো চাইনি আমি।
– হ্যাংলামো করো না তো। এসব মোটেই ভাল লাগে না।
ফোনটা নিজেই কেটে দেয় নাঈমা। প্রচন্ড রেগে যায় সে। এই ছেলে জোঁকের মত পিছে লেগেই আছে। নাঈমা তাকে যতই বোঝাক, সে মানতেই রাজী না। আজ আর পড়া হবে না, কাল বাদে পরশু ফরেনসিক আইটেম। আর…………
(৫)
সেজুঁতী খেয়াল করেছে সাদী আর আগের মত নেই। খাওয়া-দাওয়া ঘুম কিছুই ঠিক মত করে না। সাদী অবশ্য রাত জেগে পড়ে। অর্থনীতিতে পড়া ছেলেরা বুকিশ হয় তবে সাদী আজকাল নিজেকে আড়ালে রাখতেই এসব বেশী করছে। গভীর রাতে ব্যাথাতুর কন্ঠে চিত্রা সিং গেয়ে চলেছেন,
Kya kya na socha tha maine
Kya kya na sapne sajaaye
Kya kya na chaaha tha dil ne
Kya kya na armaan jagaaye
সেজুঁতীঃ এখনো ঘুমাসনি ভাইয়া?
সাদীঃ আপু? ভিতরে আসো।
-তুই কী ডিপ্রেসড?
-না আপু, আমার অনুভূতি কমে গেছে।
– তোর চোখ সে কথা বলে না।
– আমাকে দেখে তোমার দুঃখী মনে হয়?
– আমি জানি তুই ভাল নেই, কেন নেই তাও জানি। এই কষ্টগুলো খুব কাজে আসবে। নাঈমার কষ্ট তুই ভুলতে পারবি না, ভুলতে বলবোও না। কিন্তু তুই নিজেকে সামলে নিবি, শিখে যাবি। জীবনটা এমনই।
– আপু, একটা কষ্ট করবে প্লিজ?
– কী কষ্ট?
– আম্মুকে বলে আমাকে বাইরে পাঠানোর ব্যাবস্থা করে দাও। MBAটা বিদেশ থেকেই করে আসি।
– পালাতে চাস? পৃথিবীতে অনেক ভালবাসা থাকে। বাবা, মা, ভাই, বোন, বন্ধু সবার জন্য । একেকজন রি-এ্যাক্ট করে একেক ভাবে। একজনের শাস্তি অন্যকে দেয়া ঠিক না।
– আপু, দেশে থাকলে আমি পাগল হয়ে যাবো। নিষ্টুর নিয়তির কাছে আমার বিন্দু বিন্দু করে জমানো ভালবাসাও অসহায় হয়ে গেলো।
– Be Practical! হুমায়ুন আহমেদ স্যারের একটা উক্তি আছে, “যখন মানুষের প্রিয় কেও তাকে অপছন্দ, অবহেলা করে তখন প্রথম প্রথম মানুষ খুব কষ্ট পায় এবং চায় সব ঠিক হয়ে যাক। কিছুদিন পর সে সেই ব্যাক্তি ছাড়া থাকতে শিখে যায়। আরো কিছুদিন পর সে আরো বেশী খুশী থাকে। কারন কারো ভালবাসায় জীবনে অনেক কিছুই আসে যায়, কিন্তু কারো অবহেলায় সত্যিই কিছু আসে যায় না।”
– নীতিবাক্য বলো না তো। ভাললাগে না। হেল্প করবা কিনা বলো।
– ঠিক আছে, আমি বলবো। এখন ঘুমাতে যা। অনেক রাত হয়েছে।
মনে মনে ভাবে সেজুঁতী তার আদরের ছোট ভাইটার কষ্টের পাহাড়টা যদি সে গুরিয়ে দিতে পারতো।
(৬)
আজ ২৪জানুয়ারী। নাঈমার জন্মদিন। সারাদিন অনেক মজা করেছে। ফ্রেন্ডরা পার্টি এ্যারেঞ্জ করেছে । টাইমলাইন ভর্তি শুভেচ্ছাবানী। হোমপেজ স্ক্রল করতে করতে চোখ আটঁকে গেল এক পোষ্টে।
– ভাইয়া রক্ত দিবো।
– ভাল কথা, সন্ধানীতে গিয়ে দিয়ে আসেন।
– হুমম ভাইয়া, তবে আপনাকে লাগবে যে।
– আমাকে? কেনো? ওখানে অনেকেই থাকে দিয়ে আসেন।
– না ভাইয়া, আপনি কবে থাকবেন সেটা বলেন। আপনি থাকা অবস্থায় দিবো।
– আচ্ছা কাল দুপুরে আসেন।
– ক্লাস শেষে সন্ধানীতে বসে পেপার পড়ছি। বানিয়ে লেখার প্রতিভা দেখে মুগ্ধ হচ্ছি।
– আপনি ডা. আদনান না?
– পেপার থেকে চোখ উঠালাম। লিকলিকে এক যুবক ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। গলার শব্দ শুনে আরেকটু মোটা কাওকে আশা করেছিলাম।
– হুম, আপনি?
– আমি? ঐ যে আপনাকে বলেছিলাম রক্ত দেবার কথা। মনে নেই?
– ও হ্যাঁ। কিন্তু আপনি তো বেশী চিকনা। চিকন শব্দটা বলার পর থেকে মাথায় ঘুরঘুর করতে লাগলো, নাহ, এভাবে বলা ঠিক হয় নি।
– আপনার ওজন কতো?
– ৪৭ কেজি।
– আপনাকে খুব দুর্বল দেখচ্ছে, আপনি ব্লাড দিয়েন না।
– উহু, আমি ব্লাড দিবোই। এবং সেতা আজকেই।
– রক্ত না দেবার জন্য ছুতো দেখিয়ে পালানো লোক অনেক দেখেছি। কিন্তু ডোনেট করার জনযেমন নাছোড় বান্দা খুব কম দেখেছি। কৌতহলের বসে জিজ্ঞেস করলাম কিন্তু কেন?
– জবাবে যা শুনলাম, তাতে নিজেকে কেন জানি খুব ছোট মনে হতে লাগলো।
– হাংলা পাতলা ছেলেটার নাম সাদ (ছদ্মনাম)। পড়েন দেশের প্রথম সারীর এক বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে। ইন্টার দিয়েছেন আমার বছর খানেক আগে। তবে বর্তমানে কিছুটা পিছিঁয়ে পরেছেন। তার পিছিঁয়ে পড়ার কারন তার পারিবারিক দুরঃবস্থা। যাহোক, সেই ক্লাস নাইন থেকে এক মেয়েকে ভাল লাগে তার। ভাললাগে ঠিক না ভালবাসে। কিন্তু বখে যাওয়া ছেলেদের মত পথ আগলে নয় বরং পথের পাশে বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে চোরের মত লুকিয়ে প্রেয়সীকে দেখাতেই তার সন্তুষ্টি। বছর তিনেক পরে সাহস হলো কথা বলার। যখন ভাবলেন এবার মনের কথা বলা দরকার তখনই নামে বিপর্যয়। প্রেয়সী তার মেডিক্যালে চান্স পেয়ে গেলো। আর সে সংসারের যুদ্ধ সামলাচ্ছে অবিরত। মেঘে মেঘে হলো অনেক বেলা। আরো তিনবছর পর জানানো হল, “ভালবাসি”। তখন প্রেয়সীর জবাব মিথ্যে সব। আমাকে নয় ভালবাসো আমার ক্যারিয়ারকে। আমাকে ভালবাসলে অনেক আগেই বলতে।
বোকা ছেলেটা তখন হাসে। হেসে ফিরে আসে। আজ মেয়েটার জন্মদিন। প্রতিবছর রোজা রেখে, রক্ত দিয়ে প্রেয়সীর জন্মদিন পালন করে ছেলেটি। আর এবছর অসুস্থতার কারনে শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেলেও রক্ত সে দিবেই।
বিধাতার কী লীলা, হথাৎ থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত পেশেন্টের রিকুইজিশান নিয়ে আসলেন এক মা।
সাদ রক্ত দিচ্ছে………।
আমি ভাবছি, অমর প্রেমের সৌধ তাজমহল শুধু সম্রাট শাহজাহান একাই নন, প্রতিদিনই কেউ না কেউ গড়ে যান। পার্থক্য শুধু চাকচিক্যময় এক দৃশ্যমান ইমারতের।
স্ট্যাটাসটা পড়ে নাঈমা বুঝতে পারে কাজটা কার। মেজাজ আবার খারাপ হয়ে যায়। এই ছেলেটা ছ্যাচড়ার মত লেগেই আছে। ধর্ষকের সাথে তার মূল সূত্রে কোন পার্থক্য নেই। ধর্ষক যেমন জোর করে আদায় করে তেমনি এই ছেলেও। হাযারবার মানা করার পরেও বিরক্ত করে যাচ্ছে। অপমান সহ্য করেও বলছে নাঈমাকে চাইই।
(৭)
কাজটা কী তুই ঠিক করছিস? একটা ছেলেকে এতো কষ্ট দেবার মানে হয়? নাঈমাকে প্রশ্ন করে মনিষা। নাঈমার বান্ধবী।
নাঈমা- কী করলাম আমি?
মনিষা- তুই ভাল করেই জানিস কী বলছি আমি।
– দেখ, এসব নিয়ে কথা বলার সময় আমার নেই।
– পৃথিবীতে নিজের সবচে প্রিয় মানুষটার সাথে জীবন কাটানোয় সার্থকতা নেই। সার্থকতা সেখানেই যখন একই অনুভূতি দুজনের মধ্যে সমান ভাবে বয়ে যায়। জগতের বারোয়ারি মানুষের সাথে ঘুরে রাতে ঘরে আসার পর তোর কানে একটা কথাই বাজবে, ‘এই মানুষটা আমার, শুধুই আমার। সারাদিন পরেও আমি একা নই’
– এসব কথা সুধু গল্পেই ভাললাগে। বাস্তবে না।
– তোরা যদি একসাথে থেকে নিজদের সেরা মূহুর্তগুলো শেয়ার করিস তবে তা অনেক বড় হয়ে ধরা দেবে। সাদী তোকে অনেক ভালবাসে, খেয়াল রাখবে।
– পারি আর পারবো, এই দুইয়ের মধ্যে অনেক পার্থক্য। ফ্যান্টাসী আমার ভাললাগে না।
– সাদীর ভালবাসায়, চোখের জলে, মমতায় যদি এক বিন্দুও সত্যতা থাকে তাহলে ঐ ভালবাসার মর্ম তুই বুঝবি।
(৮)
সেজুঁতী অসুস্থ। এ্যাপোলোতে ভর্তি। সাদীকে দেখেই হেসে দেয় সে।
– সাদীঃ কেমন আছো আপু?
– সেজুঁতীঃ ভাই পাশে থাকলে কোন বোন খারাপ থাকে? তুই কেমন আছিস?
– তোমার মতো বোন যার থাকে সে কী খারাপ থাকতে পারে?
সেজুঁতীর হার্টে ব্লক। আবার প্রেগন্যান্ট। ডাক্তার বলেছেন এ্যাবরশান না করালে ঝুঁকি আছে। মাতৃত্বলাভের প্রবল ইচ্ছা তাকে সেটি করতে দেয় নি। ডেলিভারির সময়ে সে শকে চলে যায়। জেগে ওঠেনি আর কখনই।
আপু,
তুমি শুয়ে আছো আর ছবির মতো ভেসে উঠছে কত স্মৃতি। প্রিয় মানুষ গুলোর সাথে কাটানো প্রিয় সব মুহূর্ত গুলো কেন বারবার স্মৃতির অ্যালবাম থেকে খুজে বেড়াতে হয় তা আমার জানা নাই। হয়তো এটাই জীবন। তুমি কী আমাকে আর আদর করবে না? জড়িয়ে ধরবে না? তোমার চাবি দেওয়া ছোট্ট পুতুলটা ভেঙ্গে ফেলেছিলাম না বুঝেই। কেউ গায়ে হাত দিলে রেগে অস্থির হয়ে যেতে। সেই আমি কি জানতাম? বল? আমি কি জানতাম, মনে মনে এতটা রাগ করবে তুমি?? রাগ করলে আপু? এতটাই রাগ যে ভাইটাকে একা ফেলেই চলে গেলে? তুমি এভাবে রাগ করে চলে যাবে জানলে ভাঙ্গতাম না। সত্যিই কিছু ভাঙ্গতাম না। অনেক কিছু লিখতে ইচ্ছে করে, বলতে ইচ্ছে করে । অনেক গুছিয়ে সুন্দর করে। পারি না। তোমার কথা মনে পড়লেই আমার পৃথিবী থমকে যায়। সবকিছু এলোমেলো লাগে। ইচ্ছে করে, নিজের সব সামর্থ্য এক করে সময়টাকে পিছিয়ে দেই। সেই অতীতে ফিরে যাই। ছোট্ট বোনের সেই ছোট্ট ভাইটি হয়ে যাই আবার।
সেজুঁতীর কবরের পাশে দাঁড়িয়ে বিরবির করে সাদী।
(৯)
নাঈমার মন খারাপ। নীরবের সাথে ঝগড়া হয়েছে তার। নীরব চলে যাচ্ছে Oncologyতে উচ্চতর ডিগ্রী নিতে। কখন ফিরবে তার নিশ্চয়তা নেই। নাঈমাকে ছেড়ে যেতে তার এতটুকুও দ্বিধা নেই। নীরব বলেই দিয়েছে তার কাছে ক্যারীয়ারই সব, তারপর প্রেম-ভালবাসা। মন খারাপ নিয়েই সাদীর টাইমলাইনে সাদীর টাইমলাইনে ঢুঁ মারে নাঈমা। চোখ আঁটকে গেল সাদীর এক পোষ্টে।
প্রিয়তমা ‘শ’,
স্বপ্নটা খুব বড় ছিলো না, খুব ছোট আর সাধারণ। তোমার সাথে ছোট একটা সাজানো সংসার…. যেখানে শুধু অভাবেরই অভাব থাকবে। তোমার হাত ধরে বৃষ্টিতে ভেজা, হাতে হাত রেখে রেল লাইন ধরে হাঁঠা, চোখে চোখ রেখে নির্জনে গল্প করা, আর জোৎস্না রাতে মরিসাসে জোছনা বিলাস……..
মান-অভিমান খুনসুটি.
তারপর…………………
তোমার কোলে মাথা রেখে, তোমাকে দেখতে দেখতে শান্তিতে মরে যাওয়া।
কিন্তু হলো না, স্বপ্নটা পূরন হলো না আর আমার লাভ স্টোরীও পূর্ণতা পেলো না। থাক না কিছু লাভ স্টোরী না হয় অপূর্ণই রয়ে গেলো। মধ্যবিত্ত পরিবারের কেওই ভালোবেসে কিছু করতে পারে নি, সবাই হেরে গেছে……. আমিও হেরে গেছি। আমি এক পরাজিত সৈনিক, পরাজিত প্রেমিক।
আমি জানতাম তুমি যদি আমার হাত ধরে পাশে থাকো, তবে আমার অন্য হাতটি দিয়ে আমি পুরো পৃথিবী জয় করতে পারবো। পৃথিবীর সমগ্র সুখ তোমার পায়ের নীচে আনতে পারবো। কিন্তু, আমার সাথে জড়িয়ে আমার ঘর-সংসার সাজাতে সাজাতে তোমার জীবন থেকে হারিয়ে যাবে অনেক গুলো দিন। মলিন হয়ে যাবে তোমার ঐ খুনে হাসিটা। তাই স্বার্থপর এই আমি এবার স্বার্থপর হতে পারলাম না।
তুমি ভালো আছো, সুখেই আছো। আমিও চাই তুমি ভালো থাকো, সুখের পৃথিবী হওক তোমার সারাটা জীবনময়। আমি না হয় আমার অশ্রুর বিনিময়ে হলেও আমার ভালোবাসার মানুষটির হাসি দেখলাম।
কোন এক রূপালী রাতে লাল বেনারসী গায়ে জড়িয়ে তুমি চলে যাবে অন্যের ঘরে। তোমাকে দেখবো অন্যের আলিঙ্গনে, তখনো তোমাকে ভালোবাসবো। তোমার সুখেই যে আমার সুখ।
I envy the wind that runs through your hair
that touches your lips
I long to touch you to hold you in my arms but I
cannot for your heart belongs to another
so,
I can only love you from a far
যদি কোনদিন মন চায় তুমি চলে এসো, কথা দিলাম তোমার কোন অমর্যাদা হবে না, তোমার স্থানটা শুধুই তোমার, সেটা কোনদিনও আর কারো হবে না।
আমি মহান স্রষ্টাকে ধন্যবাদ দেই যে তোমার প্রেমে পড়েছি আমি। আমার হৃদয় চিড়ে দেখানো গেলে তুমি বিশ্বাস করতে কতোটা ভালোবাসি। কত ভালোবাসা তোমার জন্য, যদি তুমি জানতে আড়ালে লুকিয়ে চোখ তুমিও কাঁদতে। তোমাকে না পাওয়াতে অবশ্য ভালোই হলো……. তোমার চোখের পানিটা দেখতে হলো না। তোমাকে ভালোবাসতে পেরেছি এটাইবা কম কি??
পুনর্জন্মে আমি বিশ্বাস করি না, তবে নতুন হয়ে আবার আসবো সেদিন তোমায় কে আটঁকাবে?
এই জন্মের দূরত্বটা পরের জন্মে চুকিয়ে দিবো।
আমি গুছিয়ে লিখতে পারিনা, তাই লিখে গেলাম যা মনে ছিলো।
শেষ করছি….. এবারের মত, আজকের মত, হয়তোবা এই জীবনকাল চলার পথে এটাই শেষ লেখা তোমার কাছে।
তুমি ভালো থেকো, ভালোবাসায় থেকো, আর নিজের অনেক খেয়াল রেখো।
ইতি
খুব অবহেলার একজন।
দূরে কোথাও হেমন্ত নিজ সুরে গেয়ে চলেছেন,
কত রাগিনীর ঘুম ভাঙ্গাতে, বাশী ভরে গেছে আঘাতে
প্রজাপতি পেল যে ব্যাথা, কাটাঁবনে ফুল জাগাতে।
দীপের গর্ভ বাড়িয়ে, কত শিখা গেছে হারিয়ে,
কত মেঘ ঝড়ে গেছে গো আকাশে নীলাভা লাগাতে।
নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলো না নাঈমা। চলে যাওয়া দিনগুলো তার মনে পরছে। সাদী অকৃত্তিম ছিলো বলেই এভাবে সব সহ্য করে তাকে ভালবেসে গেছে। আর নাঈমা? অবজজ্ঞা, অবহেলা, অপমান ছাড়া আর কিছুই দেয়নি। শুধু লাভ ক্ষতির হিসেব কষে পায়ে মারিয়ে গেছে সাদীর ভালোবাসা। সাদী সব উপেক্ষা করেও ভালবেসে গেছে।
(১০)
নগরীর এক অভিজাত রেস্টুরেন্টে বসে আছে সাদী আর নাঈমা। জন ড্যানভার মৃদু গলায় গেয়ে চলেছেন,
Come let me love You
Let me give my life to You
Let me drown in Your laughter
Let me die in Your arms
Come let me love You
Come love me again.
নীরবতা ভেঙ্গে সাদী বললো, আমাদের মনে হয় কথা বলা দরকার। আর কতক্ষন বসে থাকবো?
নাঈমাঃ এতোটা বছর অপেক্ষা করলে, করলে না হয় আরো কিছুক্ষন।
সাদীঃ আচ্ছা।
– তখন বুঝিনি, জীবনে সবকিছু হিসেব করে চলে না। লাভ-ক্ষতির বাইরেও সুন্দর জীবন আছে। আলো ভেবে আলেয়ার পেছনেই ছুটলাম জীবনভর।
– হুমম।
– আর তুমিই বা কী? এতো কষ্ট দিলাম, কাদাঁলাম। সব সয়ে গেলে!! প্রতিশোধ নিলে না?! প্রতিবাদটুকুও না!!
– ভালবাসি তো তাই।
– এমন অন্ধের মত কেউ ভালবাসতে পারে?
– তোমার ভালবাসাই আমাকে এমন করেছে।
– আজ থেকে আর ভালবাসবে না। একদম না।
– আচ্ছা বাবা, বাসবো না। মোটেই না।
– অ্যাই লাভ ইয়্যু, সাদীকে জড়িয়ে ধরে কাদঁতে কাদঁতে বলে নাঈমা।
– অ্যাই লাভ ইয়্যু টু পাগলী।
উৎসর্গঃ একটা ছোট্ট চড়ুই, যে তার সঙ্গী পাখিটাকে ভালবেসে মুক্ত আকাশে কখনোই একলা উড়তে চায় নি। সে চেয়েছিলো সঙ্গী পাখিটাকে নিয়ে উড়ে যাবে দূর অজানায়। কিন্তু পাখিটা আজ একা। ১০ বছর পরেও একা।
আমার জীবন থেকে তুমি হারিয়ে গেছো অন্য কারো আশার প্রদীপ জ্বেলে দিতে। মানুষ যা চায় সবসময় তা পায় না। আমিও পাইনি। তোমাকে এতো ভালোবেসেছি যে নিজের জন্যেও কিছু অবশিষ্ট নেই। আমার কষ্টের কথাগুলো তোমাকে বলতে গিয়েও বলা হয় নি। চাইলেই পারতাম। জোর করে শোনাতে পারতাম, তোমার সামনে কেদেঁ নিজেকে হালকা করতে পারতাম। কিন্তু, করিনি…. ভেবেছি তুমি কষ্ট পাবে। আমার কষ্টের, অভাবের, অপ্রাপ্তির দীর্ঘ গল্প বলে তোমাকে বিব্রত করতে চাইনি।
মৃত্যুর পর অনন্তকালের এক জীবন আছে, সেদিন নতুন করে আবার আসবো। এই জন্মের দূরত্বটা চুকিয়ে দেবো। তোমার হাতে হাত রেখে বিভোর ভাবে তোমায় দেখবো।
তুমি পাশে নেই, তাই আজ আমার কোন স্বপ্নও নেই। আমি জানি, তোমার অনেক স্বপ্ন। তোমার স্বপ্নগুলো সত্যি হোক। আজ থেকে তুমি মুক্ত। সুখ পাখি দুখ রাজে থাকবে কেন? হৃদয়টা শুন্য করেই চলে যাও। তোমার স্বপ্নের পৃথিবী তোমার মনের মত করেই সাজিয়ে নাও।
তুমি আর তোমার চারপাশের সব ভালো থাকুক।
প্রিয়তমা নাঈমা তোমাকেই।
সেই ছোট্ট চড়ুইটা কিন্তু সোনালী বিকেলে তোমার বারান্দায় আসে, তাকে চিনে নিও।
🙂