‘’’ চাঁদপুর কলেজের ফুটবল টিমের গোলকিপার, মিঠাপুকুর গ্রামের সারোয়ার আজ অনেক দূর এগিয়েছে। … তার চোখে গুচ্চির রিমলেস গ্লাস। পায়ে কুমিরের চামড়ার ডিজাইনের শু এবং ম্যাচিং করা বেল্ট। শানেলের টুইডের প্যান্ট আর মার্কস এন স্পেন্সারের ফুল স্লিভ শার্ট।… সারোয়ার হাসল। তার আন্ডারওয়ারটা গুলিস্তানের।”
‘দুর্ঘটনায় কবি’ জিয়া হাসানের প্রথম উপন্যাস। প্রথম হলেও, লেখকের দীর্ঘকাল পোশাক শিল্পে কাজ করার অভিজ্ঞতায় ভর করে আমাদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে সারোয়ার। গার্মেন্টস খাতে শ্রম কেনাবেচার একেবারে বাস্তব ঘটনা প্রত্যক্ষ করা যায় এতে। সাথে সাথে চলে অবিরাম উঠা নামা আর ঝুঁকি নেবার রোমাঞ্চকর সংলাপ। ঢাকার ব্যস্ত রাস্তাঘাটে উচ্চ মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ব্যক্তিগত মানুষের দৈনিক হালচালের খবর অসামান্য সাহিত্যিক ভঙ্গিতে বলে গেছে উপন্যাসটা।
মধ্যবিত্ত জীবন আসলে কেমন? মধ্যবিত্ত মানুষের মনটা কি কেবল ক্যারিয়ার আর সন্তান সন্ততিদের ভবিষ্যৎ আয়েসি জীবনের ভাবনা ভেবেই কাটে? না কি আশপাশের খেটে খাওয়া নিম্নবিত্ত মানুষগুলোর স্বপ্নকেও সে চিনতে পারে? আর যদি চিনতেও বা পারে, সে চেনার সাথে না চেনার ফারাক কতটা? – এই প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে গিয়ে মধ্যবিত্ত বিবেকের ভাষ্য পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে ধরতে পেরেছে উপন্যাসটা।
কাহিনী প্লট ঢাকা শহরের মধ্যেই।প্রতিটা অধ্যায়ের শুরুতে একটা সময় বা স্থান বলে দেওয়া আছে। কাহিনীর মধ্যে ঢুকে যাবার পর, যে থ্রিলার ধরনের অনুভূতি হয়, তাতে ঐ ছোট সময়-বাচক শিরোনাম দেখার ফুরসত থাকে না। পাতায় পাতায় ছোট ছোট দার্শনিক উক্তির স্ফুরণকে নিয়ে চিন্তার সময় না দিয়ে উপন্যাসটা পাঠককে নিয়ে যাবে চরিত্রের ভেতরে, কাহিনীর পর কাহিনীতে। শুরুর দিকের যে গতি, তার কিছুটা ছেদ দেখা যায়, হাসপাতালের করিডোরে। তাছাড়া ১৪বছর ধরে উঁচুতলার সাথে উঠবস করা সারোয়ার কেন একের পর এক বিপদে জড়াল, তার সদুত্তর পাঠককে বুঝে নিতে হয়েছে সারোয়ারের পারিবারিক জীবনের অবস্থা থেকে। তারপরও, শেষের দিকে এসে কাহিনীর চমকে, সেই অল্পবিস্তর দ্বিধা ঝেড়ে এগিয়ে যাওয়া গেছে। সবকিছু বিচার করলে, প্রাথমিক পাঠকদের যে মন্তব্যগুলো বইয়ের মলাটে দেয়া আছে, তার সাথে উপন্যাসের ভেতরকার লেখার বিন্দুমাত্র ব্যত্যয় নেই।
উপন্যাসটাকে কেবল মধ্যবিত্ত মনের দান্দ্বিক বিশ্লেষণ বললে লেখককে ছোট করা হবে। বরং, একটু গভীরভাবে তাকালে পড়ে নিতে পারব, আমাদের ঢাকা শহরের চিরাচরিত নাগরিক জীবনের অসংখ্য অসংগতি। যে মেনে নেওয়া (অথবা কষ্ট করে টিকিয়ে রাখা) সামাজিক সমঝোতা, এই অসংগতিগুলোকে অতি দক্ষ হাতে ‘প্রশ্ন না করে’ যাবার সুযোগ এনে দিয়েছে; যে অর্থনৈতিক বৈষম্য একজন সাধারণ এসআই হাশেম/সালাম কিংবা একজন রিসেপশনিস্ট পারভিনের মানসিক দাসত্ব, কিংবা ড্রাইভার ছটুর প্রাপ্য ছুটিকে তার বসের “দয়ার দান” বলে বারবার সালাম করার উৎসাহ যুগিয়েছে – “দুর্ঘটনার কবি” পড়ার পর আশ্চর্যজনকভাবে সেই বিষয়গুলোকেই পাঠকের কাছে “স্বাভাবিক” মনে হবে। রাষ্ট্রের তৃতীয় শ্রেণীর গরিব নাগরিকদের জীবনকে এত এত সহজে ও সাবলীলভাবে সস্তা-তুচ্ছ করে দেখানোর এমন সাহিত্যিক প্রয়াস খুব কমই চোখে পড়েছে।
লেখক একটুও চেষ্টা করে নাই, পাঠকের বিবেককে খোঁচা দিতে। এটাই বইয়ের বড় সাফল্য। আমাদের ভেতরকার সাধের মনুষ্যত্ব যে, শহুরে উন্নয়নের চাকচিক্যের চাপে পড়ে, বহু আগেই মরে গেছে, নিজের কাছে সেটা হাতেকলমে প্রমাণ করতে চাইলে এই উপন্যাস নিয়ে বসাটা অতীব জরুরী।