আমরা যারা দেশের বাইরে পড়ালেখা অথবা গবেষণার জন্য আসি, তাদের জন্য একটা অন্যতম চ্যালেঞ্জ হল নতুন পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নেয়া। কালচার, খাওয়া-দাওয়া, আবহাওয়া ইত্যাদি। আর যেই সকল দেশের কালচার, খাওয়া-দাওয়া এবং ভাষা সম্পূর্ণ ভিন্ন, সেখানে এই ব্যাপার গুলো আরও জটিল। আমি আমার জাপানের প্রায় দুই বছরের অভিজ্ঞতা থেকেই বলতে পারি। নতুন পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নেয়ার জন্য প্রথম ধাপ হল, কিছু ভালো বন্ধু পাওয়া। কারণে বা অকারণে আমি অনেক বন্ধু পেয়েছি এই স্বল্প সময়ে এবং অনেক বধূ হারিয়েও ফেলেছি। আমি যখন অনেকের সাথে মিশতে শুরু করলাম, আমার তখন একটা অদ্ভুদ অভিজ্ঞতা হল। জাপানিজরা সব ফরেনারদের এক চোখে দেখে না। ব্যাপারটা শুনতে খুব আশ্চর্যজনক মনে হলে হলেও ঘটনাটা সত্য। অনেকে আমার সাথে দ্বিমত পোষণ করবেন। তাদের জন্য আমার একটা কথা, দয়া করে কয়েকজনের সাথে খুব ভালভাবে মিশে দেখুন।
এবার আসি কয় ধরনের ফরেনার দেখা যায়। প্রথম সারির ফরেনার বা উচ্চবিত্ত ফরেনার। এদের প্রধান দুইটি বৈশিষ্ট্য হলঃ এদের গায়ের চামরা সাদা আর এরা নেটিভ ইংলিশ স্পিকার। এরা জাপানে আসে সাধারণত আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা এবং অনেক ইউরোপিয়ান দেশ থেকে। আরও বলে রাখা ভালো, এই সকল ফরেনাররা নিজেদের দেশে কিছু করতে পারে না বলেই জাপানে এসে ইংলিশ ল্যাঙ্গুয়েজ টিচার হয়। আর তারা আরেকটা কাজ সহজেই করতে পারে, কোন জাপানিজ মহিলাকে বিয়ে করে এখানে নাগরিকত্ব নিশ্চিত করতে। খুব কমই থাকে যারা বেশ কোয়ালিফাইড।
এবার আসি মধ্যবিত্ত ফরেনারদের কোথায়। এরা প্রধানত সাউথ এশিয়া আর আফ্রিকান নাগরিক। এদের প্রধান দুইটি বৈশিষ্ট্য হলঃ এদের গায়ের রঙ ব্রাউন অথবা কালো এবং এরা মূলত ছাত্র অথবা গবেষক। এরা সবাই নিজের দেশের ভালো স্টুডেন্ট ক্যাটাগরিতে থাকে। এখানে ইউনিভার্সিটিতে যারা তাদেরকে চিনে, সবাই জানে যে এরা মানুষ হিসেবে খুবই ভালো এবং মেধাবী। তাই সবাই সন্মান করে। কিন্তু, ইউনিভার্সিটির বাইরে চিত্রটা খুবই ভিন্ন।
আর নিন্ম বিত্ত শ্রেণির ফরেনার হল, যারা দেখতে ব্রাউন অথবা কালো এবং হোটেলে কিংবা অন্য কোথাও কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে। তাদের জীবন খুবই কষ্টের। বাইরের দুনিয়ার সাথে তাদের যোগাযোগ প্রায় শূন্য। অনেকেই এক রান্না ঘরে বছরের পর বছর কাটিয়ে দেয়। তবে তাদের মধ্যে যারা কোন ভাবে নিজের ব্যাবসা শুরু করতে পারে, তারা এই দৈন্য দশা থেকে বের হয়ে আসতে পারে।
স্বাভাবিকভাবেই উচ্চ বিত্ত ফরেনারার জাপানিজদের কাছ থেকে খুব ভালো ট্রিটমেন্ট পেয়ে থাকে যা অন্যরা পায় না। অন্য দুই গ্রুপ তাদের কাছে অনেকটাই অযাচিত এবং ঝামেলা। অনেকে তো এমন আচরণ করে যেন আমি তার দেশ ময়লা করতে অথবা চুরি করতে অথবা নিজের দেশে খাবার পেতাম না বলে এখানে আসছি। আপনি যদি একটু গভীর ভাবে ভেবে দেখেন, যেই দুটি কারণে আপনি তাদেরকে ভালো ট্রিটমেন্ট করতেছেন বা ভালো চোখে দেখতেছেন, তার পিছনে তাদের ব্যাক্তিগত পর্যায়ে কোন ভূমিকা নাই। ঐ সকল দেশে জন্মগ্রহণ করার কারণে তাদের চামড়ার রঙ ফর্সা আর তাদের মাতৃভাষা ইংরেজি হওয়ার কারণে তারা ইংরেজিতে কথা বলেন। পক্ষান্তরে, অন্য দলের ফরেনারার নিজের দেশে সংগ্রাম তো করেই, প্লাস বিদেশে গিয়েও অমানসিক পরিশ্রম করে টিকে থাকার জন্য। যেহেতু, এদের গায়ের চামরা সাদা না আর এরা নেটিভ ইংলিশ স্পিকার না, তাই আপনি তাদেরকে যতটুকু পছন্দও করছেন, তার পুরুটাই তাদের অর্জন, তাদের কাজের জন্য।
ব্যাপার না ভাই, ওইটা নিজের দেশ না। কে কেমনে ট্রিট করলো সেটা ভেবে কষ্ট নিয়েন না, যে উদ্দেশ্যে গেছেন ভালোয় ভালোয় তা সফল করে ফিরে আসেন। দোয়া থাকলো।
এটা সুধু জাপান এ না, সব দেশের জন্যই বাস্তবতা। ইউরোপ এ ঠিক একি ব্যবহার দেখা যায়, অবস্থা ও দেশ ভেদে কখন আরও রুঢ়, আর কষ্টদায়ক।