হিমছড়ির সূর্যটাকে হঠাৎ মনে পড়ল। মেরিন ড্রাইভ রোড ধরে আমাদের গাড়ি ছুটে চলছিল। দুচোখ ভরে যতখুশি সমুদ্র দেখে নাও। গাড়ির মধ্যে গোটাপাঁচেক মানুষের মুখে কোন কথা নেই। একবার মনে হল, এই পথের কি কোন শেষ আছে! পরমুহূর্তেই মনে হল, কি ভাবছি! পথ শেষ না হলেই তো ভাল। দুচোখ যেমন সমুদ্রের মাঝে ডুবে আছে, তেমনি ডুবে থাকুক। বেশ তো লাগছে। আজ বহুদিন পর কেন জানি খুব মনে পড়ছে ঐ সূর্যটাকে। কেমন যেন মন খারাপ হয়ে গেল।
সেই কোলাহলহীন শান্ত সমুদ্রের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ফিরে আসতে হল ইট কাঠের শহরে। এসেই ইন্টারভিউয়ের প্রস্তুতি নিতে হল। আমার জীবনের প্রথম ইন্টারভিউ। বাসন্তি রঙের গ্লাস পেইন্টিঙের প্রবেশদ্বার, দরজার উপর বাঘের ছোট ছোট থাবা, ডোরাকাটা আচ্ছাদনের কার্পেট, এইচ. আর. ডিভিশনের মেয়েটির মুখে আলতো হাসি, তিনজন অচেনা-অজানা মানুষের সাথে কথোপকথন আর ইন্টারভিউয়ের সমাপ্তিতে শেষ দৃষ্টিক্ষেপণ… কেমন যেন আটকে যাই এই মুহূর্তগুলোতে। নাহ! চাকরি আমার হয়নি। কিন্তু কেন জানি খুব মায়া পড়ে গেল অফিসটার উপর, ঐ বাসন্তি রঙের গ্লাস পেইন্টগুলোর উপর আর দরজার উপর বাঘের ছোট ছোট পদচিহ্নের উপর। ঘুরে ফিরে ফ্ল্যাশব্যাকের মত তাড়া করতে থাকে সবকিছু। খুব মনে আছে, গ্লাস পেইন্টগুলোর পাশে লেখা ছিল যে কোন কারণে আগুনজনিত দুর্ঘটনা ঘটলে এই গ্লাস গুলোকে যেন সাথে সাথে ভেঙ্গে ফেলা হয়। লেখাটা পড়ার পর গ্লাস পেইন্টগুলোর জন্য খুব মন খারাপ হল। কি অদ্ভুত! তাই না?
এখন বিডি জবসের পাতায় চোখ বুলাতেই দিনরাত কেটে যায়। চাকরি চাই, ভাল অঙ্কের বেতন চাই, অর্থনৈতিক নিরাপত্তা চাই, একটি নিশ্চিন্ত জীবন চাই- এই তো জীবনের প্রথম ও প্রধান উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমার ছোটবেলার এক সহপাঠী কিছুদিন আগেই অ্যাডভোকেট হিসেবে জয়েন করল বাংলাদেশ বার কাউন্সিলে। খবরটা শোনার পর আমাদের সে কি আনন্দ! সেদিন হঠাৎ শুনলাম, সেই মানুষটা আর নেই। ইন্টারনাল ব্রেইন হ্যামারেজ, এরপর কোমা… সহসাই যেন চিরবিদায়ের দেশে চলে যেতে হল মানুষটাকে। কি অদ্ভুত আমাদের জীবন! ক্ষণিকের জীবনটাকে সাজাতে আমাদের কত আয়োজন! কত প্রচেষ্টা! কত প্রতিযোগিতা! কত অভিযোগ! কত অভিমান! কত সাফল্য-ব্যর্থতার হিসেব-নিকেশ! আশেপাশের মানুষগুলোকে মাঝে মাঝে খুব আঁকরে ধরে রাখতে ইচ্ছে হয়। ভয় হয়, কখন যেন সুতোর বাঁধন ছিঁড়ে যায়!
হিমছড়ির একলা সূর্যটা বারবার মনের মধ্যে ভেসে উঠছে। অস্তমান সূর্য। কিছুক্ষণ পর টুপ করে সমুদ্রে ডুব দিবে। মায়া খুব কঠিন জিনিস। বাসন্তি রঙের গ্লাস পেইন্টগুলো অথবা সেই তিন অচেনা-অজানা মানুষগুলোর শেষ দৃষ্টিক্ষেপণ অথবা আমার ছোটবেলার সহপাঠী— সবাই হারিয়ে যায় জীবন থেকে কিন্তু মায়া রয়ে যায়। মায়াময় বাস্তবতা মেনে নেয়া খুব কঠিন, খুব খুব কঠিন।
আপনার লেখা পড়েই বুঝা যায় আপনি একজন মায়াবতী মানুষ। সবকিছুতেই মায়া খুঁজে পান। আমিও আপনার মতোই ছিলাম একসময়। আছি ও হয়ত। কিন্তু আর কেন যেন প্রকাশ করা হয়না আজকাল। ভীড়ের মাঝে বারেবারেই আমি যে একাই এভাবে চিন্তা করি, আর সবাই বাস্তববাদী, ভাবতে গেলে নিজেকে দুর্বল লাগে সবার মাঝে। তাই, নিজের মায়া নিজের মাঝেই রেখে দেই। ☺
‘মায়া’কে আমার কখনও দুর্বলতা মনে হয় না। মানুষ মাত্রই তার মাঝে মায়া, আবেগ থাকবেই। হয়তো সবার বহিঃপ্রকাশ একরকম নয়। ‘সরব’ আর হাতের কাছে কিবোর্ড যখন আছেই, আবেগ প্রকাশ করতে আমি কোন দ্বিধাবোধ করি না। অবশ্য ব্যস্ততা আর কাজের চাপে থাকলে মায়া, আবেগ এসব ছুটে যায়। আমার লেখার সারকথা তাহলে দাঁড়ায়, “I badly need a job right now.” 😛 😛