সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র ‘লালসালু’ পড়েছেন? এটার ইংরেজি অনুবাদের টাইটেলটা আমার বেশ পছন্দ – Tree without Roots. বেশিরভাগ লেখকের কাছে গল্প মানে ঘটনার আড়ম্বর, কিন্তু ওয়ালীউল্লাহ্ লিখেছেন ঘটনাহীন জীবনের কাহিনী। ভীষণ ভাবে বাস্তব তার উপন্যাস। চোখ থাকতেও আমরা যেমন দেখি না, ভয় আমাদের হৃদয়কে আচ্ছন্ন করে রাখে। বাস্তবতা ক্রমশ অবাস্তব হয়ে ওঠে, আর অবাস্তবতা বাস্তব।
‘লালসালু’ উপন্যাসে যেভাবে ভণ্ড পীর মজিদের নষ্ট হৃদয় খুলে দেখানো হয়েছে, এভাবে যদি বাঙালি মুসলমানের সবগুলো কুসংস্কারের পর্দা একে একে খুলে ফেলা হয়, বাঙালি মুসলমান ভিখারিতে পরিণত হবে। ভণ্ডামি আর অন্ধ অনুকরণ ছাড়া বাঙালি মুসলমানের নিজস্ব পুঁজি যে খুব কম! নিজের এবং অন্যদের চোখের সামনে তারা পর্দা দেখতে পছন্দ করে আর ভয় দিয়ে জিইয়ে রাখে এই পর্দাগুলো। এই রকম সময়ে ভীষণ ধার্মিক বাঙালি মুসলমানের কথা মনে হলেই মনে পড়ে ওয়ালীউল্লাহ্র ন্যায্য কথা ক’টা- “শস্যের চেয়ে টুপি বেশি, ধর্মের আগাছা বেশি।” কিংবা “খোদার এলেমে বুক ভরে না তলায় পেট শূন্য বলে।” ধর্মই অধর্ম এখানে, তাই তো মহব্বতনগর গ্রামে মজিদ যখন প্রথম আসে, এসেই গ্রাম থেকে একটু বাইরে বাঁশঝাড়ের কাছে পরিত্যক্ত পুকুরের পাশে টালখাওয়া ভাঙ্গা এক প্রাচীন কবরকে কোনো এক মোদাচ্ছের পীরের মাজার বলে দাবি করে, তখন গ্রামের একেবারে পুরনো বাসিন্দাটাও ভয়ের চোটে রা কাঁড়ে না। স্বপ্নে ডাক পেয়ে পীরের কবরের সম্মান রক্ষা করতে ছুটে এসে মজিদ সেদিন টের পেয়েছিলো- “দুনিয়ায় স্বচ্ছলভাবে দু-বেলা খেয়ে বাঁচবার জন্যে যে-খেলা খেলতে যাচ্ছে সে-খেলা সাংঘাতিক। মনে সন্দেহ ছিল, ভয়ও ছিল। কিন্তু জমায়েতের অধোবদন চেহারা দেখে পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল অন্তর। হাঁপানি-রোগগ্রস্ত অশীতিপর বৃদ্ধের চোখের পানে চেয়েও তাতে লজ্জা ছাড়া কিছু দেখেনি।” এই লজ্জা আসলে কিসের? অজ্ঞানতার ও অন্ধত্বের। অজানাকে ভয় করে আর কিছু ভাবতে না পারার লজ্জা এটা। এই লজ্জা আর ভয়কে পুজি করেই মজিদরা সাধারণ মানুষকে শোষণ করে টিকে থাকে বছরের পর বছর।
মজিদের এই পীরের কবর পীরের দেশ বাংলাদেশের অন্যতম সাধারণ এক চরিত্র। ধর্ম আর ভয় যেখানে একসাথে হাতে হাত ধরে কাজ করছে, মনে প্রশ্ন আসাটা সেখানে অবশ্বাসী কাফেরের কাজ। ভয় কী না করতে পারে! জঙ্গল সাফ হয়ে গেলো, প্রাচীন কবর সদ্য মৃত মানুষের কবরের মতো নতুন হয়ে উঠলো। লাল রঙের ঝালরওয়ালা চাদরে মজিদ ঢেকে দিল মাছের পিঠের মতো সে-কবর, তার অফুরন্ত পুঁজি। ক্রমেই মজিদ হয়ে উঠলো গ্রামের সবচেয়ে প্রভাবশালী মানুষ। খোদা বেচে খাওয়া মজিদও ভাবে, “খোদার বান্দা সে, নির্বোধ ও জীবনের জন্য অন্ধ। তার ভুলভ্রান্তি তিনি মাফ করে দেবেন। তার করুণা অপার, সীমাহীন।” সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ প্রয়োজনীয় শক্তিশালী সব বিশেষণ ব্যবহার করে বুঝিয়ে দিয়েছেন মজিদের শক্তি। শীর্ণ মানুষ মজিদের পেছনে মাছের পিঠের মতো মাজারের বিশাল ছায়া পুরো উপন্যাস জুড়ে বিস্তৃত। ওয়ালীউল্লাহ্ এখানে পুরদস্তুর কথাশিল্পী।
শক্তির শেকড় মজিদ গেড়েছে ঠিকই অন্যদের ধোঁকা দিয়ে, কিন্তু সন্দেহ তাকে কুড়ে কুড়ে খেয়েছে। “অন্যের আত্মার শক্তিতে অবশ্য মজিদের খাঁটি বিশ্বাস নেই। আপন হাতে সৃষ্ট মাজারের পাশে বসে দুনিয়ার অনেক কিছুতেই তার বিশ্বাস হয় না।” তার খোদাভীতি মহীরুহে পরিণত হয়ে ঠিকই, কিন্তু একটা শেকড় ছাড়া মহীরুহ। তাই পাশের গ্রামে এক পীরের আগমন ঘটলে, সে ভয় পেয়ে যায়। গ্রামের মানুষ নতুন পীরের দরবারে ভিড় জমাতে থাকলে, তাদের বোকামি আর অকৃতজ্ঞতায় ক্রোধে ফেটে পড়ে মজিদ। মজিদ যেন বাঙালি মুসলমানেরই সত্যিকার প্রতিরূপ। তার কাছে দুনিয়াটা বড় বিচিত্র জায়গা। সময়ে-অসময়ে মিথ্যা কথা না বললে নয়। ক্ষমতার প্রভাব যে শুরুই হয় ধর্ম আর রাজনীতি দিয়ে সেটা ওয়ালীউল্লাহ্ বুঝিয়ে দিয়েছেন খালেক ব্যাপারি আর মজিদের চরিত্র খাপে খাপে মিলিয়ে দিয়ে। “একজনের আছে মাজার, আরেকজনের জমি-জোতের প্রতিপত্তি। সজ্ঞানে না হলেও তারা একাট্টা, পথ তাদের এক।” তবে ধর্মের শক্তি আরও বেশিই বলে কিনা মজিদ খালেক ব্যাপারিকে কৌশলে বাধ্য করে আমেনা বিবিকে তালাক দিতে। কারণ “মানুষ মজিদের কথা না হয় অবিশ্বাস করা যেত, কিন্তু যে-কথা জেনেছে মজিদ তা তার নিজের বুদ্ধির জোরে জানে নি।” মজিদ তবু থামে না। মানুষ বরং তার সামনে “বিশ্বাসের পাথরে খোদাই করা চোখ” নিয়ে নত হয়ে রয়। বাঙালি মুসলমানের বিশ্বাসের চিরাচরিত বিভ্রান্তিতে শেষ হয় উপন্যাস। লাল সালুর রঙিন আবরণে ঢাকা পড়ে থাকে বঞ্চনার রঙহীন কাহিনী। ছাব্বিশ বছরের এক যুবকের প্রথম উপন্যাস হিসেবে “লালসালু” দুর্লভ। বাঙালি লেখকের প্রথম উপন্যাসে এমন কাণ্ডজ্ঞান দুর্লভ।