হোয়াইট সেভিওর ন্যারেটিভঃ ইন্ডিয়ানা জোন্স থেকে টারজান

যারা মুভি জগত সম্পর্কে একটু খোঁজ খবর রাখেন তারা দ্যা লেজেন্ড অব টারজান নিয়ে নিশ্চিত আগ্রহী ছিলেন। অনেকে হয়তবা দেখেও ফেলেছেন।

টারজান, এডগার রাইস বারোজ এর লেখা চরিত্র। সেই চরিত্র নিয়ে কত মুভি, কমিক, টিভি শো  এমনকি রেডিও শো পর্যন্ত!
কিন্তু আমাদের মাথায় যে প্রশ্নটি আসে না তা হলোঃ

সাদা চামড়ার একটি লোক  কীভাবে আফ্রিকার জঙ্গলের রাজা হয়?!

এটি কিন্তু একটি ভ্যালিড এবং গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন!
টারজান হতে পারত একজন জাপানিজ কিংবা ভারতীয়! কিন্তু সে একজন হোয়াইট চরিত্র!

আপনার মনে হতে পারে বারোজ যেহেতু আমেরিকান লেখক তাই টারজান হোয়াইট হবে সেটাই স্বাভাবিক! কিন্তু সেটি আর স্বাভাবিক থাকে না যখন সেই আমেরিকান লেখকের গল্প বিশ্বজুড়ে আইকনে পরিণত হয়! সবাই টারজান নামক হলিউড ফিল্ম এর জন্য অপেক্ষা করতে থাকে যে কিনা কালোদের তাদের কলোনিয়াল মাস্টারদের হাত থেকে রক্ষা করে!  আমরা কখনই চিন্তা করি না এই আমেরিকান চরিত্রটি  কীভাবে সবার হয়ে উঠল এত সমস্যার পরও!

 

এই লেখার মূল লক্ষ্য কিন্তু টারজান নয়। আপনি টারজান নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতে গেলে দেখবেন যে টারজান আমেরিকার সেই রেসিস্ট সময়ের অনেক রেসিস্ট আচরণ এর স্বাক্ষর বহন করে আছে। কিন্তু বিশ্বজুড়ে পাঠক এবং মুভির দর্শকদের কোন আইডিয়াই নেই এই সব রেসিজম এর ব্যাপারে!

দ্যা লেজেন্ড অব টারজান

দ্যা লেজেন্ড অব টারজান

দ্যা লেজেন্ড অব টারজান মুভির গল্পে যদি ফিরে যাই তাহলে দেখব যে এক কালো চরিত্র টারজানকে নিতে এসেছে কঙ্গোর কালোদেরকে বাঁচাতে! আফ্রিকার উপরে ঔপনিবেশিক শক্তির যে রক্তাক্ত অধ্যায় সেটা হতে পারত জর্জ ওয়াশিংটন উইলিয়ামস নামক এক কৃষ্ণাঙ্গ এক্টিভিস্ট এর গল্প। যিনি বেলজিয়ান এর রাজার কাছে কঙ্গোর লোকদের উপর অত্যাচার নিয়ে  খোলা চিঠি লেখার মাধ্যমে জনমত গঠনের কাজ করেছেন। কিন্তু না। টারজান এর বীরত্বের গল্পের জন্য রিয়েল লাইফ হিরো উইলিয়ামস তাই হয়ে গেলেন এক কাল্পনিক সুপারহিরোর সাইডকিক! মুভিতে স্যামুয়েল এল জনসনকে দিয়ে যে চরিত্রটি দেখান হয়েছে তা আসলে হোয়াইট সেভিওর ন্যারেটিভ এর পশ্চাৎদেশ বাঁচানো ছাড়া আর কিছুই না! কেউ যদি বলতে আসে যে আপনেরা তো আবারো সাদা চামড়ার গুণগান গাওয়াইতাছেন কালো চামড়ার মানুষদের উদ্ধ্বার এর মাধ্যমে তাইলে বলা যাবে এই দ্যাখো আমরা তো স্যামুয়েল এর মতো শক্তিশালী অভিনেতা নিছি, শক্তিশালী রিয়েল লাইফের চরিত্র দিছি!

আসল কাহিনী কিন্তু সেই হোয়াইট সেভিওর ন্যারেটিভ। এই ন্যারেটিভ এর মূল থিম হলো একজন সাদা চামড়ার ইউরোপিয়ান কিংবা আমেরিকান কালো/ব্রাউন ব্যক্তি/গোষ্ঠীকে কোন সমস্যা/ বিপদ থেকে উদ্ধার করবে। মাঝে সাঝে এই উদ্ধ্বারপ্রক্রিয়ায় নিজের সম্পর্কে কিছু জানবে কিংবা নিজেকেই কিছুটা বদলাবে। যত যাই হোক, উদ্ধ্বারকর্তা কিন্তু হবে একজন হোয়াইট! এই বিষয়টা অতিরিক্ত কমন! একটু চিন্তা করে দেখুন! অবাক হয়ে যাবেন!

 হোয়াইট চরিত্ররা কখনও সাদা চামড়ার শিক্ষক, কোচ কিংবা প্রমিজড ওয়ান হিসেবে আসে!

 টুয়েলভ ইয়ার্স এ স্লেভ  মুভিটার কথা মনে আছে? যত শক্ত চরিত্রেরই হোক না কেন একজন কৃষ্ণাঙ্গকে বাঁচায় একজন সাদা চামড়ার ব্রাড পিট! কিংবা ব্লাড ডায়মন্ড এর ডিক্যাপ্রিওর কথাই মনে করুন! অথবা ডান্সেস উইদ দ্যা উল্ভস এ কেভিন কস্টনার বাঁচায় রেড ইন্ডিয়ানদের।  অথবা চিন্তা করুন এক সুপারহিরো মুভির কথা! যেখানে এক কৃষ্ণাঙ্গ থাকে মূল নায়ক!  হ্যানকক নামের কালো সুপারহিরোকে হেল্প নিতে হয় এক সাদা চামড়ার কাউন্সেলর এর! তারপরই সেই সুপার হিরো দুনিয়া বাঁচাতে পারে!

শুধু পুরুষ নয়! আপনি মেয়ে হোয়াইটদেরও পাবেন কালোদের উদ্ধার এ! যেমন ধরেন সাম্প্রতিক সময়ের মুভি দ্যা হেল্প এ!

 

শুধু যে কালোদেরকে বাঁচানোর মতো মহত্তম কাজ করে এই সব মুভির চরিত্ররা এমনও কিন্তু না ব্যাপারটা! সাদারা যেখানে যায় সেখানেই তারা নেটিভদেরকে রক্ষা করে, নেতৃত্ব দেয় এবং শেষ পর্যন্ত উদ্ধার করে মহাবিপদ থেকে!
হোয়াইট সেভিওর ন্যারেটিভ

হোয়াইট সেভিওর ন্যারেটিভ

 

ইন্ডিয়ানা জোন্স এন্ড দ্যা টেম্পল অব দ্যা ডুম এ যেমন হ্যারিসন ফোর্ড অসহায় ভারতীয়দের বলির হাত থেকে বাঁচাতে আসে কিংবা

টম ক্রুজ যখন দ্যা লাস্ট সামুরাই এ কিন্তু তিনি জাপানিজদের নেতৃত্ব দেন! শুধু তাই নয় সাদা চামড়ার লোকেরা এলিয়েনদেরও উদ্ধারকর্তা হয়ে যায়! এভাটার এ যেমন এক হোয়াইট হয়ে যায় নীল এলিয়েনদেরকে উদ্ধ্বারকর্তা!

 

 এই জাতীয় ফিল্মগুলা দেখা থেকে বিরত থাকা উচিৎ কিংবা দেখলেও এর পেছনের ইতিহাস, সমস্যা ইত্যাদি জানা উচিৎ। কারণ এই জাতীয় ফিল্মগুলো আমাদের আইডিয়া দেয় যে সাদাদের ছাড়া বাকিরা নিজেদের বিপদ থেকে উদ্ধ্বার করতে পারে না! আমেরিকান সুপিরিওটির একটা পরোক্ষ প্রভাব কিন্তু মনে পড়েই যায়!

প্রশ্ন আসতে পারে এই জাতীয় ফিল্মগুলার অরিজিন কী?

এই জাতীয় ফিল্মগুলো অরিজিন সেই সাদা চামড়ার কলোনিয়াল/ ইম্পিরিয়ালিস্টিক চিন্তাভাবনা যার আসল প্রকাশ ঘটেছিলরুডইউয়ার্ড কিপলিং এর  কবিতাহোয়াইট ম্যান’স বার্ডেন এ! সাদা চামড়ার মানুষরা তুলনামূলকভাবে অসভ্য, অসংস্কৃত, ভঙ্গুর অশ্বেতাঙ্গদেরকে উদ্ধার করে নিজেদের শক্তি, মেধা, অনুপ্রেরণা কিংবা মানবিকতা দিয়ে!

 

যে সকল ফিল্মে হোয়াইট সেভিওর ন্যারেটিভ আছে তার  পুরো লিস্টের জন্য দেখুন এইখানে। একটু সাবধানে লিস্টটা বিশাল! হাঁপিয়ে যাবেন!
এই বিষয়ে দুর্দান্ত একটি ইউটিউব ভিডিও

 

মুভি নিয়ে আমার আগের পোস্ট
বিবাহিত জীবনে সুখী হইবার সহজ উপায় অথবা রিলেটিভিটির দুষ্ট রসিকতা!
কেন “হোয়াই দিজ কোলাভেরি ডি” এত জনপ্রিয় হলো?
সরব বাপ্পির এভারেস্ট জয় এর সাথে বিল গেটস এর রূপবতী মেয়ের সম্পর্ক কী?!

 

 

বোহেমিয়ান সম্পর্কে

পেশায় প্রকৌশলী, নেশায় মুভিখোর আর বইপড়ুয়া। নিজেকে খুঁজে পাবার জন্য হাঁটতে থাকি। স্বপ্নের সাথে হাঁটা, স্বপ্নের জন্য হাঁটা। https://www.facebook.com/ibappy
এই লেখাটি পোস্ট করা হয়েছে সচেতনতা-এ এবং ট্যাগ হয়েছে , , , স্থায়ী লিংক বুকমার্ক করুন।

2 Responses to হোয়াইট সেভিওর ন্যারেটিভঃ ইন্ডিয়ানা জোন্স থেকে টারজান

  1. রুহশান আহমেদ বলেছেনঃ

    হুম সেদিনের আড্ডায় কোন একটা মুভি সম্পর্কে কথা উঠায় এই টার্মটা প্রথম শুনেছিলাম আপনার কাছে। এখন ভালোভাবে জানলাম। মারাত্নক বিষয়, আপনি ছাড়া অন্য কারো থেকে শুনলে নির্ঘাত কনস্পিরেসি থিওরি বলে উড়ায় দিতাম 🙁

  2. পাহাড়ি কন্যা বলেছেনঃ

    “হোয়াইট সেভিওর ন্যারেটিভ”- আইডিয়ার সাথে পরিচিত ছিলাম কিন্তু টার্মটা আজকেই প্রথম জানলাম। অস্কারে উপস্থাপনা নিয়েও এ ব্যাপারটি উঠে এসছিল।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।