বিরক্তিতে ভ্রূ কুঁচকে তাকালো আকাশ। পেছন থেকে পাঞ্জাবির কোণায় হ্যাঁচকা টান পড়েছে। মেজাজ আগে থেকেই চড়ে ছিলো। রিকশাওয়ালা ভাড়া নিয়ে অযথা তর্ক করেছে। এখন নোংরা ছেড়া হাফপ্যান্ট পরা ছেলেটাকে দেখে বিরক্তিটা আরও বাড়লো। ঢাকা শহরে এদের সংখ্যা হু হু করে বাড়ছে। দেখতে দেখতে আর সমবেদনাও জাগে না। গরম চোখে ছেলেটার দিকে চাইলো সে। চোখ দিয়েই যেন ছাই করে দেবে। ছেলেটার চোখের ভাষায় তাতে বিন্দুমাত্র পরিবর্তন এলো না। দুচোখ ভর্তি অসহায়ত্ব। আরও উৎসাহ নিয়ে সে আকাশের পেছন পেছন আসতে লাগলো।
—‘ভাইজান, দুইদিন ধইরা আমি আর আমার বইন না খাইয়া রইছি। কিছু ট্যাহা দ্যান।’
—‘না খেয়ে মরতে পারিস না! আছিস তো জঞ্জালের মতো। যত্তোসব।’
এইটুকু বলেই আকাশ জিভ কাটলো। এভাবে সে বলতে চায় নি। সকাল থেকেই মেজাজটা খারাপ। তা না হলে এইটুকু বাচ্চা ছেলেটাকে এইভাবে বলতো? আনমনে নিজেকেই প্রশ্নটা করে সে। ভীষণ অনুতাপ হচ্ছে। সেই থেকে সহানুভূতি। তাকাতেই দেখতে পেলো ছেলেটা তাকিয়ে আছে আগের মতোই নির্বিকার। একটুখানি মন খারাপ পর্যন্ত হয় নি। যেন সে পুরোপুরি সচেতন তার জঞ্জালের মতো বেঁচে থাকা নিয়ে। তার বেঁচে থাকা না-থাকায় যে এতো বড়ো পৃথিবীর কিছু আসে যায় না, জানে সে তাও। ডান পায়ের বুড়ো আঙুল দিয়ে মাটি খুঁটছে। চোখের পাতা মাটির উপর নিবদ্ধ। পারলে সে নিজেও মিশে যায় মাটিতে। ভীষণ মায়া হলো আকাশের। মায়া হলো নাকি প্রায়শ্চিত্ত করতে ইচ্ছে হলো— কে জানে। কাছেই এক চায়ের দোকানের বেঞ্চিতে বসলো সে। ‘কিছু খাবি?’ ছেলেটা মাথা নাড়লো। খাবে না। ‘যদি দশটা ট্যাহা দিতেন।’ আকাশ এইবার হেসে ফেললো।
— ‘দশ টাকা দিয়ে কী করবি?’
—‘পঞ্চাশ ট্যাহা হইলে ভাত কিনুম।’
—‘তো এখন খেতে অসুবিধা কী?’
টং দোকান থেকে একটা বাটার বনের প্যাকেট ছিঁড়ে ছেলেটার হাতে ধরিয়ে দিলো আকাশ। প্যাকেটটা হাতে নিয়েও ছেলেটা চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো। দৃষ্টি সেঁটে আছে মাটিতে। ‘আমার কথায় কিছু মনে করিস না। খা এইটা। বস এইখানে।’ আকাশ ছেলেটাকে বেঞ্চের ডান পাশের খালি জায়গাটার দিকে ইশারা করলো। ছেলেটা আড়চোখে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিলো। তার চোখের দৃষ্টিতে অসহায়ত্বের সাথে যোগ হয়েছে অস্বস্তি।
আকাশ ততোক্ষণে এক কাপ চা দিতে বলেছে দোকানদারকে। তারপর ছেলেটার দিকে তাকালো ভালো করে। নাহ, এই চোখের ভাষা পড়বার সামর্থ্য তার নেই।
সে বললো— ‘দশ টাকাও পাবি, এবার খা।’
—‘আমার বইনে না খাইয়া রইসে।’
অকারণে চমকে গেলো আকাশ। ‘তোর বাসায় কে কে আছে?’
—‘একটা ছোডো বইন।’
—‘বাবা মা?’
—‘মা? মা মনো অয় মইরা গ্যাসে। গার্মেন্সে কাম করতো। আমারে অনেক আদর করতো।’
ছেলেটার চোখদুটো চিক চিক করে ওঠে।
—‘মনে হয় বলছিস কেনো?’
—‘লাশ পাই নাই। গার্মেন্সের বিল্ডিং ভাইঙ্গা অনেক লোক মরসে। মায়ের কোনো ছবি আসিলো না। লাশ ঘাইট্টা মায়েরে বাইর করতারি নাই।’
—‘বাবা?’
—‘মার লাশ না পাইয়া পরথম কয়দিন বাপে অনেক কানলো। কয়মাস বাপে রিশকা চালায়া আমগো খাওন জুটাইতো। এহন বিয়া কইরা আলাদা থাহে। দেখতেও আহে না।’
—‘বয়স কতো তোর?’
—‘দশ-বারো হইবো।’
—‘আর বোনের?’
—‘আট-নয় মনো অয়। একলা ঘরে থাকতে ভয় পায়। দিনের বেলা পাশের বাড়ির নাসিমা খালার লগে থাহে।’
কথা বলতে বলতে ছেলেটা কিছুটা সহজ হয়ে এসেছে। বাটার বন খেতে শুরু করেছে। অর্ধেক খাওয়া হয়ে যাওয়ার পর বাকি অর্ধেকটা সে প্যাকেটে মুড়ে পকেটে রেখে দিতে যাচ্ছিলো। তখন আকাশ বললো, ‘তুই খেয়ে নে পুরোটা। তোর বোনকে আরেকটা কিনে দিবো।’
সাথে সাথে ছেলেটার মুখে আলো খেলে গেলো। এবার খুব আয়েশ করে খেলো সে। খুব নিশ্চিন্ত। এই প্রথম আকাশের মনে হলো কাউকে খাইয়ে অন্যরকম এক তৃপ্তি মেলে। ছেলেটার খাওয়া শেষ হতেই তার হাতে আরেক প্যাকেট বন আর একশ টাকার একটা নোট তুলে দিলো সে। ছেলেটা অবাক চোখে আকাশের দিকে তাকালো। চোখে টলমল করছে কৃতজ্ঞতা। তার দৃষ্টি আকাশের হৃদয়ে ছোট্ট একটা ঝড় বয়ে নিয়ে এলো। সে আর বেশিক্ষণ বসে থাকতে পারলো না। দ্রুত ওঠে হাঁটা শুরু করে দিলো। রক্তের টান উপেক্ষা করে বাবা চলে গেছে। কিন্তু ছেলেটা ক্ষুধাপেটেও তার বোনকে ভুলে যায় নি।
ছেলেটার নাম জিজ্ঞেস করা হয় নি! কোথায় থাকে তাও জিজ্ঞেস করতে মনে ছিলো না। কিন্তু এতোক্ষণে অনেক দূর চলে এসেছে আকাশ। একবারও পেছন ফিরে না তাকিয়ে। অবশ্য, নামে কী আসে যায়!
লেখা : ২০১৩
আমরা কত ভাগ্যবান! 🙁
হ্যাঁ, আপু 🙂
অনেকদিন পর এত সুন্দর একটা লেখা পড়লাম!