গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট করলাম বেশ কয়েক মাস হয়ে গেল। সময় খুব দ্রুত কেটে যাচ্ছে। ফোর্থ ইয়ারের শেষ দিকে বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। ল্যাব প্রোজেক্ট আর থিসিসের চাপে যখন নিজেকে আর ধরে রাখতে পারছিলাম না, তখন নিজেকে এই বলে সান্ত্বনা দিচ্ছিলাম, ‘এই তো আর কয়েকটা দিন।’ তারপর র্যাগের প্রোগ্রামগুলো একের পর এক চোখের পলকে শেষ হয়ে গেল। র্যাগ কনসার্টে জনের ‘আমার পৃথিবী’, জেমসের ‘সুন্দরী তমা’ আর তুহিন ভাইয়ের ‘কফি হাউজের আড্ডা’ শুনতে গিয়ে বারবার আনমনা হয়ে যাচ্ছিলাম। সত্যি এবার ভার্সিটি লাইফটা শেষ হয়ে গেল! যেদিন রেজাল্ট দিল, সেদিন যেমন খুশি হয়েছিলাম, তেমনি মনে হচ্ছিল জীবন থেকে হঠাৎ বড় একটা অংশ হারিয়ে গেল। প্রিয় ক্যাম্পাস, প্রিয় মুখ, শেষ বিকেলে ক্যাফেতে বেজে ওঠা প্রিয় গান- সব হঠাৎ হারিয়ে গেল। সকালে ঘুম থেকে উঠে বিরক্তি নিয়ে ক্লাসে যাওয়া কিংবা দুপুরের খাওয়া বাদ দিয়ে ল্যাব রিপোর্ট লেখা কিংবা বিকালের ল্যাব দেরিতে শেষ করে বাস ধরার জন্য দৌড়- কোন কিছুরই কোন তাড়া নেই। জীবন থেকে যেন হঠাৎ সব ব্যস্ততা উধাও! যে ব্যস্ততার জন্য এত বিরক্তি, এত রাত-দিন প্রার্থনা ‘কবে এর শেষ হবে?’- সেই ব্যস্ততার সমাপ্তিতে যেন ঠিক ততটাই ফাঁকা, শূন্যতার উদয় হল। তবে নতুন একটা জীবন শুরু হল আর সেই জীবনের নাম অনিশ্চয়তা!
চাকরি নামক সোনার হরিণের পেছনে ছুটে চলা- এ এক অদ্ভুত মোহ! আপনি একের পর এক চাকরিতে অ্যাপ্লাই করেই যাবেন, একই সিভি সব জায়গায় ড্রপ করতেই থাকবেন- তবে কেউ কোন রিপ্লাই দিবে কিনা তা উপরওয়ালা ছাড়া কেউ বলতে পারবেন না। তবে এখন বুঝতে পারছি বেকারত্ব বাংলাদেশের কত বড় একটা সমস্যা! তাই স্বপ্ন, লক্ষ্য সব বাদ। একটা চাকরি, মাথা ঠুকবার জন্য একটা ডেস্ক আর মাসে কিছু বেতন- এটাই যখন জীবনের লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়, স্বপ্নকে তখন বিসর্জন দেয়া ছাড়া কোন উপায় থাকে না। তারপরও আশেপাশের সেই প্রিয় মানুষগুলোর অনেককেই দেখছি স্বপ্নের জন্য লড়ে যাচ্ছে। আমি কেন জানি তাদের মত সাহসী হতে পারছি না। আমার শুধু একটাই লক্ষ্য- ‘একটা চাকরি…একটা কিছু হলেই হল।’
মাস চারেক আগে এক সিনিয়রের সাথে কথা হচ্ছিল। উনি তখন মাত্রই একটা কোম্পানিতে এমটিও হিসেবে জয়েন করেছেন। উনাকে একরাশ শুভেচ্ছা জানানোর পর বললাম, ‘এখন তো তাহলে আপনার সব টেনশন শেষ। লাইফে সেটেল হয়ে গেলেন।’ উনি আক্ষেপ নিয়েই বললেন, ‘এই জব তো আমার প্যাশন ছিল না। কত হাই-ফাই স্বপ্ন ছিল। সব বাদ দিয়ে শেষমেশ এই জব জুটল। তাই করছি।’ কথা বলে যা বুঝলাম, উনার পরিবারের প্রত্যাশা আরও বেশি কিছু ছিল। কিন্তু জীবন তো প্রত্যাশার জালে আবদ্ধ থাকে না। লাইফ ইজ ফুল অফ সারপ্রাইজেস। লেটস লিভ ইট।
আর জীবনটা কেমন ধরণের সারপ্রাইজ তা বুঝতে পারলাম যখন একদিন হুট করে চাকরি পেয়ে গেলাম। পার্ট টাইম জব। লেভেল ২, টার্ম ১ এর ছেলেমেয়েগুলোকে পড়াতে গিয়ে নিজের সেই অতীত অস্তিত্বকে আবারও নতুন রূপে আবিষ্কার করলাম। খুব ইচ্ছে হত ওদের সাথে বেঞ্চে বসে পড়ব, লেকচার তুলব, তবে এবার আর কোন বিরক্তি থাকবে না! ক্লাসে যেদিন তাড়াতাড়ি লেকচার কাভার করে ফেলতাম, সেদিনই সুযোগ পেয়ে কথা বলতাম ওদের সাথে। ঘুরেফিরে সেই একই পুরনো আক্ষেপ- ‘কবে পাশ করব? কবে এর শেষ হবে?’ মনে মনে হেসে বলতাম, ‘এখনই ভাল আছ। এর শেষ দেখতে চেও না। এর শেষ কখনই মধুর নয়।’
জীবন এখন শুধুই ছুটে চলা। পার্ট টাইম জব ফুল টাইম হবে কিনা, আদৌ জব থাকবে কিনা, নতুন জব খুঁজব কিনা, দেশে কোন ভবিষ্যৎ আছে কিনা, বিদেশে চলে যাব কিনা- কতশত প্রশ্ন, কত দ্বিধা, কত হতাশা! মনের মধ্যে অবিরাম চলতে থাকা এই যুদ্ধের কবে যে শেষ হবে, কবে যে একটু নিশ্চিন্ত হব, কবে যে বিকেলের খোলা হাওয়ায় রিকশায় একটু একাকী, একটু স্বাধীন, একটু চিন্তামুক্ত মনে নিজের মত করে ঘুরে বেড়াতে পারব জানি না। এই অনিশ্চয়তার কোন সমাপ্তি কি আছে? শুভ সমাপ্তি? জানি না।