কি যে ভীষণ কষ্টের ! কি ভীষণ কষ্টের!

ইদানীং প্রায়ই সকালে আমার ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়। আব্বা-আম্মা সকাল ৬টার আগেই ঘুম থেকে উঠে নামাজ কালাম পড়েন। তাদের দরজা খোলার শব্দ, কথা, কুরআনের আওয়াজে আমার ঘুম ভাঙ্গে। ঘুম ভাঙ্গার পরে শুনতে পাই আব্বা কিংবা আম্মা কুরআন পড়ছেন।

গত কয়েকদিন ধরে সকালে ঘুম ভাঙ্গলে দেখি আম্মা সোফায় বসে মৃদু শব্দে কি যেন পড়ছেন। ঘুম ঘুম চোখে দেখে বুঝলাম এটা কুরআন শরীফ না। কুরআন শরীফ আকারে বড় হয়,কিন্তু এই বইটি ছোট আকৃতির। তবে কি বই পড়ছে আম্মা ঘুম জরানো চোখে আমি লক্ষ্য করিনি। ভাবলাম হয়ত কোন হাসিদের বই পড়ছেন।

কয়েকদিন পরের ঘটনা। সকাল ঘুম থেকে উঠে দেখি আম্মা সোফায় বসে আছেন। চোখ ছলছল করছে। যেন এখুনি কেঁদে দিবেন এমন অবস্থা। আম্মার মন খারাপ কেন? ভেবে বের করতে পারলাম না। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে আমি বললাম, আম্মা অনেক ক্ষুধা লাগছে নাস্তা দাও।

আম্মা জড়ানো মাখা গলায় বললেন, এই বইটা পড়ে শেষ করে তারপর দিচ্ছি। কয়েকদিন ধরে বইটা পড়ছি কাজের জন্য শেষ করতে পারছি না।

আমি আম্মার দিকে তাকিয়ে লক্ষ্য করলাম আম্মার হাতে আয়েশা ফয়েজ এর লেখা শেষ চিঠি বইটা। বইমেলার তৃতীয় দিনে মেলায় গিয়েছিলাম তখন বইটা কিনেছিলাম।

আম্মা সাধারণত গল্প বা উপন্যাসের বই পড়েন না। বেশিভাগ সময় দেখি হাদিসের বই পড়েন। আমার বুঝতে বাকি রইলো না এই বইটিই আম্মার চোখ ছলছলের কারণ।

আমি আম্মাকে প্রশ্ন করলাম, আম্মা বইটা কেমন?

আম্মার বলেন, অনেক বেশি সুন্দর লেখা এবং কষ্টের অনুভূতি। তাই তো শেষ না করা পর্যন্ত উঠতে পারছি না।

আম্মার চেহারা দেখে আমি বুঝতে পারলাম আম্মা এটাও বলতে চাচ্ছিলেন যে, বইটা পড়ে কান্না পাচ্ছে রে বাবা। অনেক বেশি কান্না পাচ্ছে। সন্তান হারানো যে কি ভীষণ কষ্টের কি ভীষণ কষ্টের।

কিন্তু সন্তানের সামনে মায়েদের দু:খের কথা বলতে হয় না। এতে সন্তানরা কষ্ট পাবে তাই আম্মা হয়ত এই কথাগুলো বলেনি।

আমার আম্মাকে যে বই কাঁদতে পারে এটি কোন সাধারণ বই নয়। এটি আসলে একটি বই বা গল্প নয়। প্রিয় পুত্র হুমায়ূন আহমেদকে লেখা এক মায়ের হাহাকারের চিঠি। পুত্র হারানো শোকে এক মায়ের নীরব কান্নার হাহাকার। আহা! কি কষ্টের এই হাহাকার । কি কষ্টের এই অনুভূতি।

অনেক মায়েরা এরূপ অনুভূতি নিয়ে বেঁচে থাকেন। পুত্র হারিয়ে যায়। বেঁচে থাকতে হয় একা। কেউ বা বৃদ্ধাশ্রমে দিন কাটায়। পুত্র থেকেও নেই। কিন্তু প্রকাশ করতে পারে না তাদের অনুভূতিগুলো। আয়েশা ফয়েজ এরূপ মায়েদের অনুভূতি যেন নিপুণভাবে তুলে ধরেছেন তাঁর এই চিঠিতে।

আয়েশ-ফয়েজ-শেষ-চিঠি

দুই:
হুমায়ূন আহমেদের মা আশেয়া ফয়েজ নুহাশ পল্লী গেছেন। ওনার সামনে হুমায়ন আহমেদের করব। ওনি চাইছেন পুত্রের কবরটা একটু স্পর্শ করতে।কিন্তু তিনি তা পারছেন না। সমাধিটা এত বড় যে তিনি করবটা ছুঁতে পারছেন না। দু:খ-ভারাক্রান্ত মনে তিনি শাওনকে বলেন, দেখো এই সমাধিটা বেশি বড় হয়ে গেছে, আমি হাত দিয়ে কবরটা ছুঁতে পারছি না। সমাধিটা একটু ছোট করো।

শাওন বলেছিলো সমাধিটা ছোট করবে। কিন্তু আর তা করা হয়নি।

আয়েশা ফয়েজ লিখেলেন,আমি যখন কবরটা দেখি তখন আমার বুকটা কেমন জানি ব্যথা করে। আমার মনে হয় আমার বাচ্চাটা বুঝি কষ্ট পাচ্ছে। জানি আমার কথার মাঝে কোন যুক্তি নেই। তবুও আমার কষ্ট হয়। সম্রাট হুমায়নের সমাধি কেমন হবে সেটা কল্পনা করার ক্ষমতা আমার নেই। কিন্তু আমার হুমায়নের সমাধি কেমন হবে সেটা কল্পনা করার ক্ষমতা ছিলো। সমান মাটির মাঝে কবরটা একটু খানি উঁচু আর পুরো জায়গাটা সবুজ ঘাস দিয়ে গালিচার মতো ঢাকা। আমি কাছে বসে কবরটা হাত দিয়ে ছুঁয়ে বসে থাকতাম আর বলতাম, আমার বাবাটা ঘুমিয়ে আছে। আমার আদরের মানিক শান্ত হয়ে শুয়ে ঘুমিয়ে আছে।

তিন:
এবার বইমেলায় গিয়ে চোখ পড়লো হলুদ খাম ও ছাই রংয়ের পাতা মিশ্রিত একটি প্রচ্ছদের দিকে। বইটি প্রথম পাতায় বড় বড় হলুদ বর্ণে লেখা “শেষ চিঠি” তারপর নিচে কালো রংয়ে লেখা আয়েশা ফয়েজ। এই মা ২০১৪ সালে ২৭ সেপ্টেম্বর মারা গেছেন। মৃত্যুর আগে পুত্রের শোকে কাতর হয়ে ছিলেন তিনি। অনেক কিছু বলতে চেয়েছিলো হুমায়ূন আহমেদকে। কিন্তু তা বলা হলো না। সেই না বলা কথাগুলো রয়েছে এই বইতে।

এই বইতে লেখা চিঠি যিনি লিখেছেন তিনি নেই পৃথিবীতে। আবার যাকে চিঠি লিখেছেন সেও নেই এই পৃথিবীতে। দুইজনই ভিন্ন এক রহস্যময় পৃথিবীতে রয়েছে। মায়ের এই চিঠি কি হুমায়ূন আহমেদ দেখতে পাচ্ছেন? মা কি জানতে পারছেন চিঠি পাওয়া পারে পুত্রের অনুভূতি কেমন ছিলো? তাঁর পুত্র চিঠি পাওয়া পরে উত্তর দিবেন?

বইয়ের নাম: শেষ চিঠি
লেখক: আয়েশা ফয়েজ
প্রচ্ছদ: আহসান হাবীব
প্রকাশনী:তাম্রলিপি
মূল্য:১৬০ টাকা
রকমারি ডটকমের এই ঠিকানা থেকে বইটি কেনা যাবে।

তুসিন সম্পর্কে

নিজের সম্পকে বলার মত কেমন কিছুই নেই।প্রিয় একটি গানের লাইন তুলে দিচ্ছি Say you, say me Say it for always That’s the way it should be Say you, say me Say it together Naturally I had a dream,I had an awesome dream ভালবাসি বই পড়তে।ভালবাসি প্রযুক্তিকে :) www.tusin.wordpress.com এখানে মাঝে অনুভূতিগুলো তুলে রাখি।ভাল লাগা , মন্দ ভালা........
এই লেখাটি পোস্ট করা হয়েছে বইপড়ুয়া-এ এবং ট্যাগ হয়েছে , , স্থায়ী লিংক বুকমার্ক করুন।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।