ইতস্তত বিপ্লবী ৪ : একটি বৃষ্টি বিড়ালের চোখ

[ আগের পর্ব তিনটি না পড়েও যদি কেউ এই পর্বটি পড়ে থাকে, একটা নতুন গল্প হিসেবেই বুঝতে পারবে কাহিনী, তেমনভাবেই লিখা হয়েছে এই পর্ব। কিন্তু পরিপূর্ণ স্বাদের জন্য আগের তিনটি পর্ব পড়া আবশ্যক। নাহলে পড়ার আনন্দ কিছুটা মাটি হবেই। এই পর্ব পড়ার আগে পাঠকের সুবিধার্থেই আগের তিনটি পর্ব আগে পড়ে আসার অনুরোধ রইল। নিচের লিঙ্কগুলোতে পাওয়া যাবে এই সিরিজের আগের তিন পর্ব-
১। ইতস্তত বিপ্লবী
২। ইতস্তত বিপ্লবী ২ : উত্তেজক মৃত্যুযাত্রা
৩। ইতস্তত বিপ্লবী ৩ : অশুভ প্রত্যাবর্তন
আর না পড়লেও সমস্যা নাই। আবশ্যক কিছু নয়। ]

বিশ্বের সবচেয়ে বেশি পরিবর্তনশীল জিনিস হচ্ছে নারীর মন। আর সবচেয়ে ধ্রুবক? সেটা নারীর কথা। না মেনে যাবার উপায় নেই কোথাও। কিন্তু বিশ্বের আনাচাকানাচে অবহেলিত নারী সম্প্রদায়ের জন্য আজ পালিত হচ্ছে নারী দিবস। আমরা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছি আজকে, যে দেখো- নারীরা আলাদা, ওদের জন্য দিবস পালন করা লাগে।

চোখে আঙুল দেবার কথা ভাবতেই হাসি পেল। আমার চোখে সত্যি সত্যি আঙুল দেওয়া যায়, আক্ষরিক অর্থেই। আমার চোখ দুটি তুলে নেওয়া হয় বেশ কয়েকবছর আগে। তাই চোখের জায়গায় সম্ভবত দুইটা কুৎসিত গর্ত আছে আমার, যদিও আমার কখনও সেটা দেখা হবে না। কিন্তু আমি পরিষ্কার অনুভব করি সেটা। অনুভব করা ছাড়া কোনকিছু বোঝার উপায় অন্ধ মানুষের থাকে না।

“বাবা, আমাদের বিড়ালটা বাইরে গিয়ে সুর করে ডাকছে, শুনছো?” 

আমার মেয়ে পূর্ণতার বিড়াল পালার শখ জন্মগত। বাবা- মা দুজনেরই বিড়ালপ্রীতি আছে। তাই ওর বিড়াল ভালোবাসা অবাক করে না কাউকে। সাদা- বাদামী রঙের একটা বিড়াল ওর খুব পছন্দ। সেটার গতিবিধি পুরোটাই নখদর্পণে মেয়ের। বিড়ালটির নাম সে দিয়েছে “পিশু পিশু”। আয়েশা, আমার বউ, বিড়াল খুব ভালোবাসলেও ঘরে জায়গা দিতে বেজায় আপত্তি তার। বিড়াল খুব পছন্দ করলেও তার বিড়ালদের একটা ছোট্ট বদঅভ্যাস আছে- একাধিক বার তারা জামাকাপড়ের ওপর মলত্যাগ করেছে। যতই বলি, “পটি ট্রেইনড” বিড়াল আনো, সে কোনভাবেই মানতে রাজি না। একবার হলো কি, বৈশাখ মাসে হঠাৎ চারদিক কালো হয়ে আসল। কালবৈশাখী হবে ভাবলাম। কিন্তু আজকাল আবহাওয়া এতটাই বেরসিক যে, শত সম্ভাবনা দেখিয়েও সে শেষমেশ এলো না। বারান্দায় গিয়ে দেখা গেল, একটা পাজামা কুণ্ডলী পাকিয়ে পড়ে আছে। পিশু পিশু বারান্দায় ছিল, সে পড়ে থাকা পাজামার উপর শিল্পকর্ম করেছে, তারপর সেটাকে ঢাকার চেষ্টা করেছে কুণ্ডলী পাকিয়ে। বিড়ালও নিজের আবর্জনা ঢেকে রাখতে চায়, অনেক মানুষ চায়না যদিও।

আমরা নতুন বাসায় উঠেছি অল্প কিছুদিন হল। এখনো শীতের আমেজ না যাওয়ায় ফ্যান/ এ সি কিছুই লাগানো হয়নাই। কিন্তু আমরা এখানে উঠার পরপরই কে যেন শীতের সুইচটা অফ করে রোদ আর গরম ডেকে আনল। আজ ফ্যান লাগানোর চিন্তা করছিলাম, কিন্তু ঘুম ভাঙার পর দেখি আকাশ কালো। আচ্ছা যা কালো তার কিছুই কি নয় ভালো? আমরা বাইরে যতই সাদার গুণগান করি, ভেতরে কিন্তু সবারই কালো। আমারও। বর্ণবাদ চর্চা করি আমরা এখানে মনে মনে, আর অস্ট্রেলিয়া আমেরিকায় গিয়ে শিকার হই সেটার। বর্ণবাদ বিরোধী কোন দিবস আছে কি? সাদা দিবস বলতে কোন দিবস নাই? না থাকলে আজকেই দুটি দিবস হোক। দিনের বেলা হবে বর্ণবাদ বিরোধী দিবস, আর আঁধার নামলে সন্ধ্যা থেকে চলবে সাদা দিবস। ঠিক মানুষের মনের মত- দিনে কালো আর রাতে সাদা। কোন কিছু হারিয়ে না গেলে আমরা কখনো তার মর্যাদা টের পাইনা। তাই এ ব্যবস্থা করতে হবে।

পিশু পিশু একটা সাদা কালো বিড়ালের দিকে তাকিয়ে সুর করে চেঁচাচ্ছে। চেঁচানোর ধরনটা অনেকটা মানুষের বাচ্চার অ্যাঁও ওঁয়াও এর মত। প্রিয়জনকে কত অদ্ভুত ভাবেই না কাছে ডাকে একেক প্রাণী! বাসায় থাকতে না দিলেও, বাসা পরিবর্তনের সময়ে ঠিকই তাকে সাথে করে আনতে হয়েছে পূর্ণতার আবদারে। আর এই মেঘলা দিনে একলা থাকতে মশায়ের ভালো লাগছেও না। তাই মেয়ে বিড়ালটিকে হয়ত নরমভাবেই ডাকছে উচ্চস্বরে। আজকের আবহাওয়াটা বড্ড চমৎকার। চলন্ত রিকশায় হুডের নিচে লুকানোর ছলে ঠিকই কাছাকাছি হবে নতুন প্রেম করা সলাজ জুটি। থেমে থাকা রিকশার ভেতরে গুটিসুটি মেরে বসে একটু জিরিয়ে নেবেন কোন ক্লান্ত রিকশাচালক। আজকের দিনে ভাড়ার রেট ভালো হবে। স্টার লাইটের বদলে তাই তার হাতে আশার প্রতীক হয়ে জ্বলতেই পারে একটা বেনসন এন্ড হেজেস। আয়েশা খুব যত্ন করে বাইরের প্রকৃতির বর্ণনা শুনাবে আমাকে। হয়ত গানও হবে দু চারটা। হোম ডেলিভারিতে শহরের সেরা কফিটা বাসায় আসতে হবে আজ। ঢাকা শহরের একাংশে ছোটখাট বন্যা হয়ে যাবে, অল্প যা কিছু গাছ আছে তার পাতাগুলো হয়ে উঠবে আরও সবুজ, টুপ করে গড়িয়ে পড়বে ফোঁটা ফোঁটা পানি তার গা বেয়ে। বৃষ্টি থেমে যাবার পর দমকা বাতাসে হয়ত সে ঝেড়ে ফেলবে একগাদা পানি। সেটা ছাপোষা কোন কর্মচারীর কাগজের ফাইলটা ভিজিয়ে দেবে আর সে খুব বাজে একটা গালি দিয়ে উঠবে আনমনে। পাশে ছাতা হাতে দাঁড়ানো সুন্দরীর দিকে চোখ পড়তেই আবার জিভে কামড় দেবে।

বৃষ্টি

পিঁপড়ের দৃষ্টিশক্তি খুবই সীমিত। আমার চেয়ে সামান্য ভালো আরকি। সে মোটামুটি সবকিছুই ঝাপসা দেখে। আর একটু দূরের কিছু দেখতেই পায়না। কিন্তু এদের ঘ্রাণশক্তি খুবই প্রবল। ভয় রাগ বিপদ সবকিছুর গন্ধ সে পায়। আমার চোখ না থাকার কারণে আমারও অন্য ইন্দ্রিয়ের উপর নির্ভরতা বাড়াতে হয়েছে। আমি খুব করে চাই আমি এ সংসারে না থাকি। আমি বঞ্চিত করি এক লাবণ্যময়ী স্ত্রীকে, আর এক আদরের টুকরো ফুটফুটে মেয়েকে। কেউ কোনদিন মুখ ফুটে বলবে না, কিন্তু আমি স্পষ্ট জানি কখন কখন তারা এ অন্ধ আমাকে নিয়ে তারা হতাশা অনুভব করে। এই ক্ষেত্রে অবশ্য আমার একটা চীটকোড আছে। কেউ জানে না সেটা।

সেকারণেই যখন অন্য কারো সাথে ওরা ঘুরতে যায় আমার একটু কষ্টও লাগে না। বরং আমিই বলি ঘুরে এসো। আমি নাহয় কিছু দেখতে পারি না। কিন্তু পৃথিবীটা দেখার মত করেই বানিয়েছেন সৃষ্টিকর্তা। তাই সময় থাকতেই যত পারো দেখে নাও। এক দিন দুদিন পাঁচ বছর হয়ত আবেগ নিয়ে চলতে পারো, কিন্তু সারা জীবন নয়। কেবল আবেগ দিয়ে যেটা চলে সেটা স্বর্গ- এ অপরূপ পৃথিবী না।

 

বৃষ্টির বিরতি পড়েছে। পিশু পিশু হাঁটতে হাঁটতে রাস্তার পাশের সেলুনটার সামনে গিয়ে দাঁড়াল, একটা বড়সড় আয়না লাগিয়েছে ওরা দরজার পাশে। সেটার দিকে চোখ বড় করে তাকাল ও। স্পষ্ট দেখতে পেলাম আমি, লেজের দিকটা ভিজে আছে ওর। আমি কাউকে কোনদিন বলিনি, আমি বিড়ালের চোখে পৃথিবী দেখি। ওকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনা, কিন্তু ও যা দেখে টা দেখতে পারি আমি। আমার এই সিক্রেটটা কেউ জানেনা। আয়েশাও না। কিন্তু আয়েশা দিন দিন আরও সুন্দরী হয়েছে সেটা আমি জানি। আমি দেখি প্রতিদিন। আমার ছোট্ট মেয়ের ঝকঝকে দাঁতের হাসিও দেখি। সে জানে না। লুসিফারের হাত থেকে বাঁচলেও বিড়ালের চোখে দুনিয়া দেখার এ ক্ষমতাটা রয়ে গেছে আমার- কারো জানা দরকার নেই। কাজটা কি আমি ঠিক করছি? না। এটা আমার চীটকোড- আমার কালো অধ্যায়। কিন্তু কেউ জানেনা যে তাদের কালো অধ্যায়গুলো আমি ঠিকই দেখি। তাদের আমি কিছু বলিনি কোন দিন। সবারই প্রয়োজন থাকে। যেমন আমার প্রয়োজন জানা আর দেখা। তাই আমি শুধু দেখেই খুশি, জেনেই মানি।

সবারই এরকম একটা ক্ষমতা থাকে। একটা অতিরিক্ত জোড়া চোখ। সেটি দিয়ে সে সন্দেহ করে। সমস্যাটা হয় যখন মানুষ এই অতিরিক্ত চোখ দিয়ে দেখতে দেখতে নিজের আসল চোখের কথাই ভুলে যায়। আর আমার কথা আলাদা। আমার আছেই কেবল এই অতিরিক্ত চোখ জোড়া।

আমি সবকিছু বুঝি। অনেক কিছুই দেখি। কেবল জানি না ওর অপূর্ব সুন্দর চোখগুলোর দিকে আমার আসল চোখ দিয়ে সরাসরি চেয়ে থাকতে কেমন লাগে। আর জানিনা ওদের কথা ভেবে আমার চোখ ভিজে ওঠার অনুভূতিটা।

যার যা নেই সে তো তা চাইবেই!
যার যা নেই

ইতস্তত বিপ্লবী সম্পর্কে

যদি কখনো আমায় মনে পড়ে যায়,খোলো দুয়ার আকাশের-আমি তারাময়!
এই লেখাটি পোস্ট করা হয়েছে গল্প, সাহিত্য-এ এবং ট্যাগ হয়েছে , , , , , স্থায়ী লিংক বুকমার্ক করুন।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।