স্মৃতি: স্কুলজীবন

ক্লাস থ্রি-তে ভর্তি হলাম ধানমন্ডি গভঃ বয়েজ হাই স্কুলে। এর চেয়ে ছোটবেলার কিন্ডারগার্ডেন স্কুলের কথা খুব বেশি কিছু মনে নেই। নতুন স্কুলে ভর্তি হবার সাথে সাথেই আমার সমস্ত জগত দখল করে নিলো এই স্কুল। বিশাল বিল্ডিং, বড় একটা মাঠ, আমার শৈশবের চোখে তো অসীমের কাছাকাছি।

ক্লাস থ্রি-তে আমাদের ক্লাস নিতেন ফেরদৌসী ম্যাডাম। শান্ত চেহারার ম্যাডামকে আমাদের সবারই খুব পছন্দ। একদিন ক্লাস নিতে নিতে হঠাৎ ধুম করে মেঝেতে পরে গেলেন, চোখ বন্ধ। ছোট্ট ছোট্ট আমরা অবাক হয়ে বোঝার চেষ্টা করছি, কি হলো?! অনেকক্ষণ পর খারাপ কিছু ধারণ করে অন্য টিচারদের ডেকে আনার পর বুঝতে পারলাম, ম্যাডাম অজ্ঞান হয়ে পরে গিয়েছিলেন।

স্কুলে থাকতে একটা সময় একটা খেলার খুব প্রচলন হলো। সবাই অপেক্ষা করতাম টিফিন টাইমের জন্য। টিফিন টাইম হলেই এক দৌড়ে মাঠে! দুই দলে ভাগ হয়ে একদল আরেকদলকে ধরার চেষ্টা। বিশাল স্কুলে কাউকে খুঁজে বের করা যে কতটা কঠিন ছিল, না খেলে থাকলে কেউ বুঝবে না। আবার, ধরে এনেই কাজ শেষ, তা না। তাদের পাহারা দিতে হবে, কারণ পালানো দলের অন্যরা তখন তাদের ছাড়িয়ে নিয়ে যাবার চেষ্টা করবে। খেলার নাম ছিল ‘রেসকু’।

অনেক বড় হয়ে বুঝতে পেরেছিলাম, খেলার নাম হওয়ার কথা ছিল ‘রেসকিউ’!

ক্লাস সিক্সে উঠে ভেবেছিলাম, বড় হয়ে গিয়েছি। এখন থেকে স্কুল দুপুরে, সকালে উঠার ঝামেলা শেষ! কিন্তু, তখনও তো বুঝি নি বড় হওয়া কত ঝামেলা!

সিক্সে আমাদের টিচার হলেন হাসিব স্যার। ইংরেজী ক্লাস নেন। সর্বদা হাসিমুখের খুবই মিশুক মানুষ। কিন্তু, সমস্যা হলো, স্যার আগের দিনের পড়া থেকে ইংরেজী শব্দের বানান জিজ্ঞেস করেন। আর আনা পারলে হাতের নখ দিয়ে কানের লতিতে চিমটি দেন। আর সে যে কি চিমটি রে বাবা! স্যার চিমটি দেয়ার জন্য হাতের একটা নখ বড় রেখে দিলেন! মাঝে মধ্যেই আমার মত ফাঁকিবাজদের বলতে হত, “স্যার, কালকে ওই কানে দিসেন। এখনো ব্যাথা আছে। আজকে অন্য কানে দেন”।

ক্লাস এইটে ফার্স্ট টার্ম পরীক্ষা শেষ হবার পর স্কুলে শুরু হলো বৃত্তি কোচিং! খুবই ভালো ভালো সব ছাত্র আশেপাশে! সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১২টা বৃত্তি কোচিং, এরপর সাড়ে বারোটা থেকে সাড়ে পাঁচটা ক্লাস। জীবন ফানাফানা হয়ে যাচ্ছিল। এর মধ্যে একদিন আবার টিফিন হিসেবে নিয়ে যাওয়া খিচুরীর বক্স ব্যাগের মধ্যেই খুলে গিয়েছিল। নরম খিচুরী ব্যাগের মধ্যে বই-খাতার মধ্যে পথ খুঁজে বেরালে কেমন হয়, তা আর না-ই বা বললাম।

কিছুদিন পর বৃত্তি কোচিং করা বন্ধ করে দিলে জীবন বাঁচিয়েছিলাম সে যাত্রা।

বড় ক্লাসে উঠার পর পড়া না শিখে আসাটাই রুটিন হয়ে গিয়েছিল। ক্লাসের ৬০ জনের মধ্যে ৫০ জনকে কামরুন্নাহার ম্যাডাম বেঞ্চের উপর কান ধরে দাঁড় করিয়ে রেখেছেন আর আমরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে গল্প করছি সে দৃশ্য আমার এখনো চোখে ভাসে।

ক্লাস নাইনে উঠে সাইন্স পেয়ে তো ব্যাপক আনন্দিত হয়েছিলাম। ডাক্তার হওয়ার শখ ছেলেদের একটু কম থাকায় বেশির ভাগ ছাত্রের ফোর্থ সাবজেক্ট বায়োলজি। আর, ফোর্থ সাবজেক্ট পড়া লাগে নাকি- এ চিন্তায় বিভোর সবার জীবনে দুঃস্বপ্ন হয়ে দেখা দিলেন শুকদেব বালা স্যার। পড়া শিখে খুব কম ছাত্রই ক্লাসে যায়। স্যার চমৎকার একটা বেত নিয়ে আসেন আর বলেন, এমন জায়গায় মারবো, কাউকে দেখাতে পারবি না। এবং মারতেন। সপ্তাহে রবি, মঙ্গল, বৃহস্পতি তার ক্লাস। আমরা এই তিনদিন বাদে বাকি তিনদিন ক্লাসে যাওয়া শুরু করলাম। পরে অবশ্য স্যার মারা বন্ধ করে দিয়েছিলেন।

কিন্তু, এখনো ভাবলে দেখি, আসলে স্যারের মারার ভয়েই একটু হলেও পড়া হত!

পরের বছর এলে মনে হল, বনের রাজা বাঘ আর স্কুলের রাজা ক্লাস টেন। স্কুলের যে কোন অপরিচিত আরো সাথে কোন কথা বলতে নিলেই, এই ছেলে, তুমি কোন ক্লাসে পড়? মনে মনে বলতাম, আমার চেয়ে তো আর বড় হতে পারবে না।

আর স্কুল পালানো তো কিংবদন্তীর পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হল। কোন না কোনভাবে টিফিনের সময় স্কুল পালাতেই হবে। স্কুল পালিয়ে ক্রিকেট বা ফুটবল খেলা। আর কিছু না হলে সোজা বাসায়।

এভাবেই শত দুষ্টামির ফাঁকে কীভাবে যেন কেটে গিয়েছিল আটটা বছর। স্কুল ছেড়ে চলে আসার পর এখনো আমি জানি, যে স্যার ম্যাডামরা আমাদের মেরেছেন, বকেছেন- সব ছিল আমাদের ভালোর জন্য। তাদের কারণেই আজকের অবস্থানে আমরা সবাই। তাদের ভালোবাসার প্রতি আজীবন সম্মান থাকবে আমাদের।

 

এখন যখন স্কুলের সামনে দিয়ে যাই, কী গভীর ভালোবাসা নিয়ে যে স্কুলের দিকে তাকাই! ইচ্ছে হয় গ্রীষ্মের সেই কৃষ্ণচূড়ার ফুলে ঢাকা পথে হাঁটতে, বর্ষায় কদম ফুল গাছটা থেকে ফুল ছিঁড়ে সেটা দিয়ে ক্রিকেট খেলতে, এক হাঁটু পানি মাড়িয়ে স্কুলের মাঠে দৌড়াতে। অথবা শীতের সকালে হি-হি করে কাঁপতে কাঁপতে পরীক্ষা দিতে গিয়ে হালদার স্যার বা মকবুল স্যার গার্ড দিয়ে আসবে কিনা সেই ভাবনায় শিউরে উঠতে। কাগজ মুড়িয়ে বানানো বল আর ডায়রীটাকে ব্যাট বানিয়ে আবার ক্রিকেট খেলতে। সেই সব বন্ধুদের সাথে আড্ডায় মেতে উঠতে।

বাস্তবে ফিরে যেতে পারি না, কিন্তু, গভীর রাতে অথবা মন খারাপের বিকেলে স্মৃতিগুলো নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে হেসে উঠি নিজের অজান্তেই। আবারো ফিরে যেতে চাই সেই ছেলেবেলায়, সেই স্বপ্নের দিনগুলিতে।

 

স্বপ্ন বিলাস সম্পর্কে

বাস্তবে মানুষ হবার চেষ্টা করে যাচ্ছি। জীবনের নানা পথ ঘুরে ইদানীং মনে হচ্ছে গোলকধাঁধায় হারিয়েছি আমি। পথ খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করি আর দেখে যাই চারপাশ। ক্লান্ত হয়ে হারাই যখন স্বপ্নে, তখন আমার পৃথিবীর আমার মতো......ছন্নছাড়া, বাঁধনহারা। আর তাই, স্বপ্ন দেখি..........স্বপ্নে বাস করি.....
এই লেখাটি পোস্ট করা হয়েছে স্মৃতিচারণ-এ। স্থায়ী লিংক বুকমার্ক করুন।

23 Responses to স্মৃতি: স্কুলজীবন

  1. অবন্তিকা বলেছেনঃ

    ধুর! দিলেন তো স্কুলের কথা মনে করায়ে। 🙁
    দারুন সুন্দর একটা লেখা। 🙂

  2. প্রজ্ঞা বলেছেনঃ

    আরে ভাইয়া! আপনি আর আমি তো দেখি আসলেও ভাই-বোন! :happy:
    আপ্নে ধানমন্ডি বয়েজ আর আমি ধানমন্ডি গার্লস! :beerdrink:

    স্মৃতিকাতর হয়ে গেলাম তো! 😳

  3. সামিরা বলেছেনঃ

    এত ভাল লাগলো, আমিও লিখতে চাই স্কুল নিয়ে।
    মাঝে মাঝে মনে হয়, সময় থাকতে স্মৃতিগুলি লিখে না রাখলে, কবে না জানি ভুলে যাই। অলরেডি ভুলেও তো গেছি কত কী! 🙁

  4. কৃষ্ণচূড়া বলেছেনঃ

    “বাস্তবে ফিরে যেতে পারি না, কিন্তু, গভীর রাতে অথবা মন খারাপের বিকেলে স্মৃতিগুলো নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে হেসে উঠি নিজের অজান্তেই। আবারো ফিরে যেতে চাই সেই ছেলেবেলায়, সেই স্বপ্নের দিনগুলিতে।”
    আসলেই তাই… সবারই ওই দিনগুলো দারুণ সুন্দর!

    কত যে বিরক্ত হতাম পড়া ধরলে! আমার স্কুলের কঠিন নিয়ম কানুনে অস্থির থাকতাম। অথচ এখন বুঝি, ওগুলো ডিসিপ্লিন শেখার জন্য কতটা জরুরী ছিল। স্কুলের আপাদের এখন পথে ঘাটে দেখলেই জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছা করে। এইতো কদিন আগেই কলেজে গিয়ে সত্যি সত্যি তাই করেছি। এই মানুষগুলো যে কত কিছু দিয়ে গেল আমাদের…

    অনেক কথা মনে করায় দিলি দোস্ত।
    ভালো লাগল ভীষণ!

  5. বোহেমিয়ান বলেছেনঃ

    দারুণ লেখারে!
    আমারও তো লিখতে ইচ্ছে করছে!

    তাঁদের কারণেই আমরা এখানে! – একমত!

    খুবই ভাল লাগল। মনে হলো তুই যেন আমার স্কুলের কথা বলছিস, হয়ত সবারই তাই মনে হচ্ছে!

  6. শিমন বলেছেনঃ

    জাহিদ, তুই স্কুলে কিরকম ছিলি তা কি বলবো ? 😛

    ক্লাস টেনে তোদের সেকশনের তো বাইরে দিয়ে গ্রিল কাটা ছিলোনা, আমাদের ছিলো 😛 টিফিন পিরিয়ডে ওইখানে দিয়ে ব্যাগ ফেলায়ে আমরা 😀 সংসদ ভবন মাঠে খেলতে যাইতাম 😀

    হে হে হে…

  7. রাইয়্যান বলেছেনঃ

    আমি বয়েজে এক বছর পড়েছি, ক্লাস থ্রিতে। এর আগের পড়াশুনা সৌদি আরবে, এর পরের পড়াশুনা গভ. ল্যাবে। আর মাঝের এর এক বছর ছিল আমার জন্য খুব খুব বিশেষ একটা সময়!

    সৌদি আরবে পড়তাম বাংলাদেশ অ্যাম্বাসি স্কুলে। রেজাল্ট যতই ভালো হোক, পরিবারের সবার ভয় ছিল বাংলাদেশের প্রতিযোগিতায় হয়তো টিকতে পারব না। সেই আমিই যখন বয়েজে ক্লাস থ্রি’র তিন টার্মেই ফার্স্ট হয়ে বসলাম, আত্মবিশ্বাস তুঙ্গে উঠে গেল! সেই একবছরে বুকের মাঝে পেয়ে যাওয়া সাহস পরবর্তী সময়ে আমার জন্য ছিল খুব খুব খুব স্পেশ্যাল। স্যার ম্যাডামরা দারুণ আদর করতেন, সত্যিই আমি স্বপ্নের এক রাজ্যে ছিলাম!! বয়েজের জন্য :love: :love: :love:

  8. ফিনিক্স বলেছেনঃ

    গভীর রাত আর মন খারাপের বিকেলে কত কী মিস করি!
    পুরনো স্মৃতি আর এক ঝাঁক বন্ধুর কলকাকলি উঁকি দিয়ে যায় মনের জানালায়।

    এমন লেখা পড়ে এই ভর দুপুরেও সেইসব দিনের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। 🙁

  9. কিনাদি বলেছেনঃ

    বড়ই মচৎকার লাগলো :happy:

  10. নিস্তব্ধ অমিত বলেছেনঃ

    আমার ভয় নেই…… আমি তো এখনও স্কুলেই পড়ি……
    লেখা খুব ভালো লেগেছে……

    • স্বপ্ন বিলাস বলেছেনঃ

      তুমি এখনো স্কুলে পড়!!! তোমার লেখা তো তোমার বয়সের তুলনায় অনেক ভালো!!! 😯

      লেখা ভালো লেগেছে শুনে আনন্দিত! :happy:

  11. নিলয় বলেছেনঃ

    “বাস্তবে ফিরে যেতে পারি না, কিন্তু, গভীর রাতে অথবা মন খারাপের বিকেলে স্মৃতিগুলো নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে হেসে উঠি নিজের অজান্তেই। আবারো ফিরে যেতে চাই সেই ছেলেবেলায়, সেই স্বপ্নের দিনগুলিতে।”

    :clappinghands:

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।