টিউশনি করে হলে ফিরছে সৌরভ। রাতের পৌনে নয়টা বাজে। রাস্তায় বিশাল জ্যাম, রিকশা এক পাও নড়ে না। আজকের ম্যান ইউ আর আর্সেনালের ম্যাচটাও মিস হয়ে গেলো।
‘বাইয়া দুইটা ফুল নিয়া যান’
‘ফুল নিয়ে আমি কি করব?’
‘আফার লাইগা নিয়া যান’
‘!! তুইও আমার লগে মজা নেস! আমার কোনো গার্লফ্রেন্ড নাই।’
‘নেন বাইয়া, আইজ বেচন কুব কারাপ অইসে।’
‘দে দুইটা। কত?’
‘১০ টেকা।’
‘আইচ্ছা ফুল লাগবো না, এই নে দশ টাকা।’
রুমে এসে সোজা বিছানায় শটান হয়ে শুয়ে পড়ে সৌরভ। সারাদিন অনেক ধকল গেছে। জ্যামের কারনেই প্রতিদিনই কয়েক ঘন্টা নষ্ট হয়। আজকেও টিউশনির টাকা দিলো না। মানিব্যাগে মাত্র ২০০ টাকা আছে। টাকা যে কোন দিক দিয়ে শেষ হয়ে যায় কিছুই টের পাওয়া যায় না।
কালকে আবার ক্লাস টেস্ট। কিছুই পড়া হয় নি। অনলাইন, অফলাইন, অ্যাসাইনমেন্ট, ল্যাব, ভাইভা, প্রজেক্ট … প্রতিদিনই কিছু না কিছু থাকবেই।এসব ব্যস্ততার মধ্যেই প্রতিদিন কেটে যায়।
কয়েকদিন পর…
হলের ক্যান্টিনে বসে আছে সৌরভ। একটা ছেলে এসে নাস্তা দিয়ে যায় তাকে।
‘আরে তুই এইখানে কি করিস? তোকে না দেখসিলাম বাংলা মোটরের মোড়ে ফুল বেচিস!’
‘হ বাই, অহন এইহানে কাজ পাইসি, থাকা খাওন দাওন ফিরি হে হে’
‘হুম। কি নাম তোর?’
‘রতন। অ … বাই, আফনে আমার থিকা চল্লিশ টেকা পান’
‘কেমনে?’
‘ঐদিন যে ১০ টেকা দিসিলেন হেইডা পঞ্চাশ টেকার নোট আসিলো। অন্ধকারে আমিও খেয়াল করি নাইক্কা।’
‘আইচ্ছা যাই হোক, তোর টাকা দেয়া লাগবে না। যা একটা ডিউ নিয়ে আয়।’
রতনের দিকে কতক্ষন তাকিয়ে থাকে সৌরভ। আজকাল হারিয়ে যাওয়া টাকা, মানিব্যাগ ফেরত দেওয়া এসব সততার কাহিনী প্রায়ই শোনা যায়। কিন্তু একটা ক্যান্টিন বয়ের সততা! কিছুটা অবাক হয় সে।
রতন এসে টেবিলে ডিউ এর বোতল রাখে।
‘তুই বিকালে চা বিক্রি করিস?’
‘হ।’
‘তাইলে প্রতিদিন ঠিক সন্ধ্যার পর আমার রুমে চা দিয়ে যাবি। ২০৪ নাম্বার রুম।’
‘আইচ্ছা।’
বিকেলে ঘুমের অভ্যাস সৌরভের একদমই নেই। ল্যাব না থাকলে মুভি দেখে অথবা ফিফা খেলে কাটায়।
সন্ধ্যার দিকে রুমে ঢুকে রতন। টেবিলে চা রাখার সময় তার চোখ পড়ে কম্পিউটারের উপর।
‘এইডা কি বাইয়া?’
‘অ্যানিমেশন।’
‘ওমা, ফুতুলে দেহি কতা কয়!’
‘হুম, কম্পিউটারে করা যায় এইসব।’
হা করে দাঁড়িয়ে দেখতে থাকে রতন। দেখে আর অবাক হয়। সৌরভও জানে রতনের এসব দেখে মজা পাওয়াটাই স্বাভাবিক। সেও পিসির সাউন্ড বাড়িয়ে দেয়।
‘পড়ালেখা জানিস?’
‘না’।
‘সন্ধ্যার পর তো তোর কাজ থাকে না। ক্যাফের পাশে ছোট বাচ্চাদের পড়ানো হয়। কালকে থেকে ওখানে ক্লাস করবি? বুঝছিস?’
‘মানে’
‘আচ্ছা যা কালকে আমিই নিয়া যাব। তোর বুঝা লাগবে না।’
এই কয়দিনে সৌরভ আর রতনের সম্পর্কটা বড়ভাই ছোটভাই এর মত হয়ে গিয়েছে। সকাল আর বিকেলে নাস্তা সবসময় রতনই ওকে দিয়ে যায়। রতনকেও টিপস দিতেও ভুলে না সৌরভ।
ঈদের ছুটির নোটিশ দিয়েছে। ১ দিনের বন্ধ। আজ কালকের মধ্যেই টিকেট কাটতে হবে। সৌরভ রতনকে ডেকে বলে বিকেলে রুমে দেখা করতে।
‘তোর পড়ালেখা কেমন চলতেসে?’
‘হুম বালা।’
‘ঈদে বাড়ি যাবি?’
‘হ।’
‘শোন কালকে সকালে ক্যাফের সামনে তোদেরকে ঈদের জামা কাপড় দেয়া হবে। যেয়ে নিয়ে আসবি।’
পরদিন রাতে রুমে আসে রতন। তার হাতে একটা কার্ড।
‘বাই, আমি ত কাইল বাড়ি যাইতাসি।’
‘হুম, আমি পরশু যাব।’
‘এইডা আফনের লাইগা। আমি যেসুমতে কাগজ কুড়াইতাম হেসুমতে ফাইসিলাম।’
সৌরভের মুখে হাসি। কার্ডটা হাতে নিয়ে দেখে সে। সুন্দর একটা ঈদ কার্ড, উপরে বেশ ময়লা কিন্তু ভিতরটা চকচকে। বেশ বড় করে ভাঙ্গা ভাঙ্গা ভাষায় লেখা ‘সৌরভ বাই’।
‘হা হা, আমার নাম লিখছিস কেন? তোর নাম লিখে দে।’
একটা পেন্সিল দেয় সৌরভ । প্রায় পাঁচ মিনিট লাগিয়ে নিজের নাম লেখে রতন।
‘হুম গুড। সাবধানে যাইস।’
‘আসি বাই, দুয়া কইরেন।’
ঈদের পর ক্লাস শুরু হয়েছে আজ এক সপ্তাহ হলো। কিন্তু রতনের কোনো খবর নেই। আরো একসপ্তাহ কেটে যায়। রতন আর আসে না। ক্যান্টিন এর মান্নান ভাই ও কোনো খোজ খবর দিতে পারলেন না।
দেখতে না দেখতেই ৬ মাস পার হয়ে যায়। এর মাঝে সৌরভ বাইক কিনেছে। ইদানীং বাইকটা ডিস্টার্ব দিচ্ছে।ঠিক করার সময় হয়ে ওঠে না। একদিন সময় করে কাঁটাবনের একটা দোকানে ঠিক করতে নিয়ে যায় সে। হঠাৎ পাশের দোকানে কাজ করতে থাকা একটা ছেলের দিকে তাকিয়েই স্থির হয়ে যায় সে। ‘আরে রতন তুই?’
‘আরে বাইয়া কেমুন আসেন?’
‘হুম ভালো। তুই ক্যান্টিনের কাজ ছাড়ছিস কেন?’
‘আমি ছাড়তাম চাই নাই, আমার চাচায় জোর কইরা আমারে এইহানে আইনা ঢুকাইসে। এইহানে ইনকাম বালা, তয় আমার বালা লাগে না। ছাড়নের ও উপায় নাই। চাচায় হুনলে আমারে মাইরা ফালাইব।’
‘তা তুই পড়াশোনা করবি না?’
‘জানি না।’
রতনের মায়া মায়া চেহারাটায় কেবল কালির ছাপ। হাতে পায়ে সবখানে। ওর মধ্যে তো সততা ছিলো, প্রতিভা ছিলো। একজন অর্থলোভী মানুষের কারণে তার জীবনের স্বপ্নগুলো হয়ত পূরন হবে না।
বাইক নিয়ে চলে যায় সৌরভ। আর ভাবে, না জানি আরো কত রতনের স্বপ্ন এভাবে ধূলিস্যাৎ হচ্ছে…
🙁
ভাল হয়েছে গল্পটা।
আসলেই তো!
এখানেই শেষ!! :brokenheart:
উহু, সৌরভরা রতনদের উদ্ধার করুক এসব অর্থলোভীদের হাত থেকে… সিক্যুয়েল দাবি করতেছি
আমারো এমন একটা রতনের কথা মনে পড়লো, আমার রতনটার নাম ছিলো সুরুজ মিয়া……
আমাকে বলছিলো, ভাইয়া, চুইংগাম খেয়ে গিলে ফ্যালবেন না, তাইলে পেটের নাড়িভুঁড়ি প্যাঁচ লাইগ্যা যায়!
মনটা খারাপ হয়ে গেলো! 🙁
সুরুজ মিয়ার কথা তুই আবার মনে করিয়ে দিলি!
যতবার চায়ের দোকানটার পাশ দিয়ে যাই, আজও উঁকি মেরে খুঁজি ওকে। জানি নেই, তবু অকারণেই খুঁজে যাই…
🙁
সত্যি তাই, এভাবেই হয়তো রতনেরা হারিয়ে যায়!
এমনভাবে কত রতন যে কীভাবে হারিয়ে যাচ্ছে সমাজ থেকে। শত চেষ্টা করেও সেই বাঁধভাঙা স্রোত থেকে ক’জনকেই উদ্ধার করতে পারছি আমরা…… 🙁
🙁
এই রতনদের জন্য কষ্ট হয়। ভীষণ, ভীষণ কষ্ট হয়। কিন্তু কিছুই করতে পারি না! সাধ্য যে বড্ড কম আমার! 🙁