আমি তোমাকেই বলে দেব
সেই ভুলে ভরা গল্প
কড়া নেড়ে গেছি ভুল দরোজায়-
সঞ্জীব এর গান! আমি মোটামুটিভাবে গান কানা মানুষ। গান খুব শোনা হয়- কিন্তু সেটা অন্য কেউ দিলে, বা সহজলভ্য হলে বা সবাই-শুনে-ফেলেছে-একমাত্র-না-শোনা-মানুষ আমি ঠিক তখন শুনি!
সঞ্জীব এর গান শুনে পাঙ্খা হয়েছিলাম কৈশোরে। তারপর গানের বেলায় দারুণ অলস আমি খুঁজে খুঁজে তাঁর আরও গান বের করি। বন্ধুদের সাথে এই গায়ক/ গীতিকারের প্রশংসায় পঞ্চাশমুখ হই।
২.
আমি বেশ ইন্ট্রোভার্ট টাইপ ছিলাম কৈশোরে, এমনকি বুয়েট এ ঢুকেও! ছিলাম বলছি কারণ এখন অতটা নই। এখন মানুষের সাথে যেচে গিয়ে মিশতে পারি। কলেজে পড়া অবস্থায় স্বপ্ন দেখতাম আমার লেখা গানে সঞ্জীব বাপ্পা গাইবে!! [গান লেখার শখ ছিল]
একবার ২ লাইন লিখছিলাম এই রকম
রাত আজ ঘুমুবে না করছে বাহানা
এসো না এসো না! কাছে এসো না!
হাহা! এই বাংলা সিনেমা টাইপ পচা লেখা দিয়েও ভাবছিলাম একটা সময় ভালো লিখব, ভাগ্যের লিখনে হয়ত এদের সাথে দেখা হয়ে যাবে! বলে বসব- আমার একটা দারুণ গান আছে। কান্নার রঙ ছুঁয়ে যাবার মত, জোছনার ছায়া ছুঁয়ে যাবার মত! আপনারা গাইবেন?
ধীরে ধীরে আমি নিজে ব্যস্ত হয়ে পড়ি, সময় আমাকে হারিয়ে ফেলে-অথবা আমি নিজেকেই। ধুর! আবার নিজের কথা শুরু করলাম! (আমারে নিয়া এই এক সমস্যা! খালি নিজের ঢোল পিটাই! ) এদের সাথে দেখা হতে গিয়েও হয় নি দেখা- বলাও হয় নি। আমি নির্জনে শুনে গেছি এদের গান। সঞ্জীব এর গান। বায়স্কোপের নেশা না ছাড়ার গান, রূপালি নদীর গান… কত বার যে শুনেছি! কিন্তু ইন্ট্রভার্ট আমার স্বপ্ন পূরণ হয় নি!
৩.
আজ সঞ্জীব এর মৃত্যুবার্ষিকী। ২০০৭ এ সঞ্জীব যখন মারা গেলেন! কত পত্রিকায় এলো, কত ব্লগ পোস্ট এলো! জীবিত থাকতে কোন খোঁজ খবর ছিলো না! যখনই দরজার ওপাশে চলে গিয়েছিলেন, তারপরই শুরু প্রশংসা আর ফুলের ছড়াছড়ি, ছোড়াছুড়ি!
সরব শিহাব এর এই কার্টুনটা দেখা যেতে পারে
এই ফাঁকে নিজেদের খুব সামান্য আয়োজনের, প্রচেষ্টার কথা বলিঃ আমরা হুমায়ূন আহমেদ বেঁচে থাকতেই একটা ইবুক করেছি। এই ইবুক করার পেছনে শুধু তাঁর লেখার প্রতি মুগ্ধতা ছিলো তাই না, বরং একজন গুণী মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর একটি মাধ্যম ছিলো। (এর পেছনে কাজ করা তরুণদের সজীবতা চোখে পড়ার মত!)
৪.
এই প্রশ্নটা আমার অনেক দিনের কেন আমাদের গুণী মানুষদের নিয়ে আমরা হৈচৈ করি তাঁদের মৃত্যুর পর?
আমরা তো জানিই গুণের কদর না করলে গুণী জন্মায় না!
তবু ভুল করে যে কত গুণী আমাদের দেশে জন্মে যান! তাঁদের জন্য দুঃখ হয়, নিজের অক্ষমতায় লজ্জা পাই! কত শত মেধাবী যে এখনও মঞ্চ কাঁপিয়ে যাচ্ছেন! আমরা কি আসলেই তাঁদের যথাযোগ্য মর্যাদা দিচ্ছি?
আজম খান মারা যাবার পর আমরা ফেইসবুকে প্রোফাইল পিকচার দিয়েছি!
তারেক মাসুদকে হারানোর পর আমরা স্মরণ করেছি, হা হুতাশ করেছি!
এর আগে না!
তবে কি এরা ভুল দরোজায় কড়া নেড়ে গিয়েছেন? বাকিরা এখনো ভুল দরোজায় কড়া নাড়ছেন?
আমি তোমাকেই বলে দেব
সেই ভুলে ভরা গল্প
কড়া নেড়ে গেছি ভুল দরোজায়-
🙁
“তবে কি এরা ভুল দরোজায় কড়া নেড়ে গিয়েছেন? বাকিরা এখনো ভুল দরোজায় কড়া নাড়ছেন?”
আপনার ধাঁচেই বলা যেতে পারে, “সময় তাদের হারিয়ে ফেলছে- আর আমরা সময়কে”!
আর যেন কাউকে এভাবে অকালে হারাতে না হয় সেই প্রার্থনাই করি।
আর, সঞ্জীবদা! তিনি বেঁচে আছেন, বেঁচে থাকবেন- তাঁর সৃষ্টিতে, তাঁর গানে!
চেষ্টাও করতে হবে!
ব্যাপারটা আসলে এমন না যে গুণীরা বেঁচে থাকতে তাঁদের কদর করা হয় না……।
যখন এই গুণী মানুষগুলো চলে যান দরজার ওপাশে , তখন আমরা তাঁদের অনুপস্থিতির ব্যাপারটা অনেক বেশি অনুভব করি…… সেই অনুভব থেকেই জন্ম নেই ভয়ংকর কষ্টের…… আর এই কষ্টের জন্যই গুণী মানুষগুলোর মৃত্যুর পর মানুষ এতো হাপিত্যেশ করে ওঠে……
সঞ্জীবদা আর বাপ্পাদা। উফ! সেই ক্লাস ফোর থেকে শুরু। একই পাগলামিতে কবিতা লিখতে ধরলাম। (অবাক হইছি খুব।) ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে থাকতে সকাল ছয়টায় যখন প্রথম খরবটা শুনি সেই অনুভূতিটা বলার মত না। কত্ত কত্ত ক্যাসেট যে টাকা বাঁচায়ে কিনছি! এখনো আছে আমার কাছে সেইগুলা। এখন তো ক্যাসেটের যুগ নাই। ফ্রেন্ডরা, ভাইয়া কত্তো ক্ষেপাইতো! কি আসে যায়! কত্ত কত্ত বুড়া মানুষ বেঁচে থাকে, অথচ অসম্ভব রকমের এই মানুষগুলা ক্যান হারায়ে যায়! 🙁
বাংলা সিনেমায় তোমার তো এখনও ভবিষ্যত আছে!
হাহা!
গাড়ি চলেনা চলেনা……….জীবন গাড়ি থেমে যায় আর ভাল লাগাটা রয়ে যায় ।
সঞ্জীব’দার সাথে আমার কখনো কথা হয়নি, কিন্তু তবু, কোন এক অদ্ভুত কারণে মানুষটা আমার খুব বেশি কাছের কেউ বলে মনে হয়, ঠিক যেন হঠাৎ খুঁজে পাওয়া কোন এক বড়ো ভাই, যে এখনি একটা ধমক লাগাবে, “তোরে চায়ের টাকা দিতে বলছি?? মাতব্বরি করিস ক্যান? তাইলে খাওয়া আবার, আরেক কাপ!”
সঞ্জীব’দার বুঝি কোথাও খুব কষ্ট ছিলো, মানুষটা হারিয়ে যাবার পর (হ্যাঁ, হারিয়ে যাওয়াই) বাপ্পা’র লিখাটা পড়ে নিজের অজান্তেই চোখ ভিজে আসছিলো, মনে হয়, এই মানুষটাকে আমি কেন এমন করে চিনি? কেন মনে হয়, উনি ঠিক পাশেই আছেন, মিটিমিটি হাসছেন, আমার ছেলেমি দেখে……
মনে পড়ে, বইমেলায়, একটা পোস্টার দেখেছিলাম উনার……পুরোপুরি মনে নেই, তবু…
“নিশি রাত্রিরে ঘরে ফেরা আমি…
ঘরের থেকে ডাক, কে যায়?
আমি বলে যাই, বন্ধু, আমি তোমাদেরই লোক”
লিখাটা দেখে সেখানেই ঠায় দাঁড়িয়ে ছিলাম ২ মিনিট, কতোটা আগুন থাকলে ভিতরে এমন করে লিখা যায়? শুধু বোকামিটা করেছিলাম পোস্টারটা কিনিনি, কেন এমন গাধামি করেছিলাম এখনো জানিনা……
সঞ্জীব’দাকে নিয়ে বলা শেষ হবে না, তবু শুধু জানি……
কি যে একা দীর্ঘ রাত, আমি হেঁটে গেছি, বিরান পথে…
তোর কমেন্ট পড়ে লজ্জা পাচ্ছি! সঞ্জীবদাকে নিয়ে তোর লেখাই উচিৎ!
দারুণ কমেন্ট দোস্ত! দারুণ!
সঞ্জীবদা কেমন মানুষ যখন থেকে জানতে পেরেছি তখন থেকেই ভক্ত হয়ে গিয়েছিলাম। ছেলেদের সম্পর্কে একটা ফ্যান্টাসি ছিল ছোটবেলায়। ভাবতে ভাল লাগত, আমায় এমন একজন ভালবাসবে যে একটু এলোমেলো, পাগল পাগল টাইপের, ভবঘুরে আর দুষ্টু। সঞ্জীবদার ভেতর এর সবগুলো গুণ বিদ্যমান ছিল। তবু কেন জানি না, প্রেমিক হিসেবে চাওয়ার থেকে সঞ্জীবদাকে নিজের ভাই হিসেবে চিনেছি অনেক অনেক বেশি।
কত দুষ্টু-মিষ্টি গান যে ছিল সঞ্জীবদার! বাপ্পা আর সঞ্জীবদা কোন লাইভ অনুষ্ঠানে এলে তা নিয়ে কতই না দুষ্টুমি করত। মনে আছে, বাপ্পা একবার বলেছিল, “সঞ্জীবদা মানুষটা কিন্তু খুব দুষ্টু। বাজি গানে লিখেছে- তুমি ই প্রথম বলি না এমন, শেষ হতে পারো কি? আচ্ছা, এইটার মানে কি দাদা?”
সঞ্জীবদা মুচকি মুচকি হাসে। সেই হাসি আমি আজও চোখের সামনে দেখতে পাই!
সঞ্জীবদা চলে যাবার পরে প্রথম আলোতে বাপ্পার লেখাটা পড়ে খুব কেঁদেছিলাম। মৃত্যুর আগেও মনে হয় কেউ কেউ ঠিক বুঝতে পারে যে সময় ফুরিয়ে এসেছে। নাহলে সঞ্জীবদা সুন্দরবন ভ্রমনের অমন সুন্দর স্বর্গীয় একটা মুহূর্তে বাপ্পাকে কেন বলতে যাবে,”আমি চলে গেলে আমার মেয়েটাকে দেখবি তো?”
কেন মৃত্যুর আগে পরিবারের সাথে শেষ সেই ভ্রমনের সময় সঞ্জীবদার বারবার মনে হত কেউ তাকে ডাকছে! কেন অন্যমনস্ক হয়ে যেত সে খানিক পরপর?
যারা মুসলমান নয় তাদের মৃত্যুর পর না-কি তাদের জন্য প্রার্থনা করা যায় না। আমি জীবনে নিজের আপন মানুষ ছাড়া অন্য কোন মানুষের মৃত্যুতে এতটা ভেঙে পড়ি নি। শুধু যেদিন শুনলাম সঞ্জীবদা আর নেই, সেদিন সবকটা টিভি চ্যানেলের সব কয়টা খবর দেখেছি আর কেঁদেছি, আর আল্লাহকে বলেছি, “আল্লাহ আমি কি এই মানুষটার জন্য একটু দোয়া করতে পারি? অল্প একটু? এই মানুষটাকে আমরা কিছুই দিতে পারি নি, তুমি এই মানুষটাকে কি এইবার একটু শান্তিতে ঘুমুতে দিতে পারো? যদি খুব বেশি অন্যায় আবদার হয়ে যায় তো আমাকে ক্ষমা করো তুমি। কিন্তু আল্লাহ পারলে আমার প্রার্থনাটা তুমি কবুল করো প্লিজ, প্লিজ আল্লাহ প্লিজ!”