এক মুহূর্তের গল্প

জ্যামটা ছেড়ে যেতেই গাড়িগুলো চলতে শুরু করল । আর ঠিক তখনই ময়লা কাপড় পরা পাঁচটা ছেলেমেয়ে ফুটপাতে এসে বসল ।

কারও হাতে বকুল ফুলের মালা, কারও হাতে পপকর্ণ, কারও হাতে স্বরবর্ণের বই, কারও হাতে চকোলেটের প্যাকেট, আবার কেউ বা কাঁধে বিরাট ঝোলায় ময়লা কাগজপত্র নিয়ে বসে আছে ।

হাতে বিভিন্ন জিনিসপত্র নিয়ে বসে থাকা এই ছেলেমেয়ে গুলোর নাম বকুল, ফজল, রহিমা, সুলতান ও মণ্টু ।এরা এ দেশে পথশিশু বা টোকাই নামে পরিচিত ।

দেশের সব মানুষ চায়, যেন ঢাকার যানজট কমে। শুধু এরাই এর বিরোধী। এদের কথা-

” জ্যাম লাগ, আরও বেশি কইরা লাগ। ”

দুপুরের কড়া রোদে বসে ঘাম মুছতে মুছতে বকুল ফজলকে জিজ্ঞেস করল,

– কিরে, কত বেচলি আইজকা ?

– বেশি না, ৩০-৪০ হইব ।

– ভালই তো বেচছস। আর আমার ফুল রোদে হুকাইয়া মইরা যাইতাছে। কিন্তু বিক্রি হইতাছে না।

– আরে, অইব অইব । বিকাল হইতে আরও অনেক বাকি। একটু পরই দেখবি টুনটুনি আর টুনটুনা গাড়ি লইয়া বাইর অইব। তহনই বিক্রি অইব।

– হ । ভালোই কইছস ।

মণ্টু চুপচাপ বসে আছে দেখে রহিমা জিজ্ঞেস করল,

– কিরে, কি হইছে তোর ?

– কিছু না ।

– আরে কছ না ?

– আজকে কাগজ টোকাইতে লইছি পরে এক সাবে লাত্থি দিছে। আরে, আমার কাগজ আমি টোকাই, তাতে হ্যার কি? লাত্থি দেওনের পর আবার হাসে।

– থাক, দুঃখ করিছ না। আমাগ কষ্ট কি আর হেরা বুঝব। হেরা খালি ভাষণ দিবো, দূর থাইক্কা দেখব, লাত্থি দিবো আর হাসব ।

রহিমার কথা শুনে হেসে ফেলল সুলতান। বাবা-মার একমাত্র ছেলে ছিল সে। থাকত সাতক্ষীরায়। বাবা-মা শখ করে নাম রেখেছিল সুলতান। সব ঠিকঠাকই ছিল। কিন্তু হঠাৎ সিডর এসে সব ওলট-পালট করে দিলো। তাদের জমি-ভিটা সব নষ্ট হয়ে গেলো। তার বাবা-মা দু’জনই মারা গেলো। তালগাছের উপর টানা দুই রাত সে বসে ছিল। সেই বসে থাকাই হয়েছে তার বিপদ। এরপর চলে এলো ঢাকায়, শুরু করল পেটের দায়ে পপকর্ণ বিক্রি। পপকর্ণের ঝুলিটা নামিয়ে সুলতান বলল,

– ঠিকই কইছস রহিমা, বড়লোক আর নেতারা আমাগো কতা কয় ঠিকই । কিন্তু আমাগো লাইগা কোনও কাম করে না । খালি নিজেগ পেট বড় করে। আর হের লাইগাই আমাগো পেট খালি শুকায়। তয়, হেরা যদি মানুষ হইত, তয় এডি করবার পারত না, তহন আমাগো লাইগাও কিছু না কিছু করতে হইত।

হাসতে হাসতে রহিমা বলে,

– তার মানে, তুই কইবার চাইতাছস, হেরা আমগো মতো মানুষ না ?

– না, হেরাও মানুষ । তয় শুধু শইলের দিক দিয়া । মনের দিক দিয়া হেরা জানোয়ার ।

ওদের দুইজনের এশব কথা শুনতে শুনতে অসন্তুষ্ট হয়ে পড়ছিল মণ্টু । তাই কিছুটা ঝাঁঝের সুরেই সে বলল,

– বাদ দে তো এইসব । হেগ কাম হেরা করুক গিয়া । তা আইজকা খাবি কি ?

হতাশার সুরে সুলতান বলল, খালি রুডি-ভাজিই খাইতে অইব। আগে তো ভাত খাইতাম। আর অহন তো ভাতের হোডেলের সামনে যাইতেই ভয় লাগে। খাওনের দাম যেই বাড়ছে।

– হ, ঠিকই কইছস। দুঃখ-কষ্ট যা আছে সব আমাগো লাইগা । আর সব সুখ ওই লাত্থি দেওইন্যা পার্টির লাইগা ।

– তয়, একদিন দেখবি আমাগো কপালও খুইল্যা যা……

বাক্যটা শেষ করতে পারল না সুলতান । আবার জ্যাম লেগেছে । যে যার ঝোলা নিয়ে দৌড়াতে শুরু করল ।

 

 

 

(  গল্পটি ঐতিহ্য-গোল্লাছুট প্রথম-আলো গল্প লেখা প্রতিযোগিতা-২০০৯ এ

অন্যতম সেরা গল্পের স্বীকৃতি পায় )

Amit Pramanik সম্পর্কে

নিজের ব্যাপারে কিছু বলা মনে হয় সবসময়ই কঠিন। আসলে, প্রতিটা মানুষই তো স্বাভাবিক। আমিও তাই। পড়াশুনা করি, খাই, আড্ডা দেই, ঘুমাই, দুষ্টামি করি, মাঝে মাঝে এক আধটুক লেখা লেখির চেষ্টা করি আর মুভি দেখি। এইতো.... এভাবেই চলছে...... দুঃখ আছে, আনন্দ আছে...... হতাশা কিংবা বিস্বাদ সবই আসে মাঝে মাঝে...... কিন্তু, সময় তো আটকে থাকে না...... নতুন কিছুর অপেক্ষায় এভাবেই প্রতিদিন একটু একটু করে এগোতে থাকি সামনের দিকে..... " চাই সবচেয়ে বড় আকাশ নক্ষত্র আর ঘাস আর চাই চন্দ্রমল্লিকার রাত শুধু এইটুকুই জীবনের শেষ চাওয়া...... "
এই লেখাটি পোস্ট করা হয়েছে গল্প, সাহিত্য-এ। স্থায়ী লিংক বুকমার্ক করুন।

10 Responses to এক মুহূর্তের গল্প

  1. বোহেমিয়ান বলেছেনঃ

    ভালো লেগেছে ভাইয়া।
    এবং স্যালুট “মানুষের” কথা বলার জন্য।

    “ওদের” কথা বলার জন্য।
    সরব তৈরির পেছনের আইডিয়াই ছিলো এটা- আমরা এমন লোকদের কথা বলতে চাই, এমন বিষয় নিয়ে বলতে চাই – যাদের কথা অন্য কেউ বলে না

    তোমার প্রতি অনুরোধ বেশি বেশি পড়ো এবং লিখো।

  2. কিনাদি বলেছেনঃ

    বাহ্‌! দারুণ গল্প তো! 🙂

  3. নিশম বলেছেনঃ

    একবার বলেছি, আবার বলবো ???

    লেখাটা দারুন হয়েছে 🙂

  4. ফিনিক্স বলেছেনঃ

    ওদের কথা আমরা প্রায়ই ভুলতে বসি। ইচ্ছাকৃত নয় যদিও।

    এই গল্পের জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। আমাকে আরো একবার মনে করিয়ে দিয়ে গেল, বেঁচে থাকার সময় ফুরিয়ে আসছে আমার, তবু কাজ ফুরোচ্ছে না। আরো কত কাজ যে বাকির খাতায় জমেই যাচ্ছে কেবল! 🙁

  5. সামিরা বলেছেনঃ

    সুন্দর গল্প।
    “তয়, একদিন দেখবি আমাগো কপালও খুইল্যা যা……”-বাক্যটা কথা আর কাজে, শেষ হয় যেন একদিন সত্যিই!

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।