সেই সকাল থেকে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। বাংলায় যাকে বলে, ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি। যতদূর জানি, ইলিশ মাছ সাইজে কাঁচকি মাছের মত গুঁড়ি গুঁড়ি হয় না, তাহলে ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি নাম দেয়ার কারণটা কী? ইলিশ মাছের ডিমটা অবশ্য গুঁড়ি গুঁড়ি হয়, এই বৃষ্টিকে তবে ইলশেডিম না বলে ইলশেগুঁড়ি বলে কেন?
টেবিলের উপর কনুই রেখে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে বৃষ্টি দেখছিলাম আর এসব ভেবে মনে মনে বাংলা ব্যাকরণের মুন্ডুপাত করছিলাম। সামনে খোলা ব্যকরণ বই, তাতে প্রকৃতি আর প্রত্যয় নিয়ে নানা শক্ত শক্ত কথা কপচানো। এই বৃষ্টি হিম হিম ছুটির সকালে ঘরে বন্দী থেকে ব্যাকরণের মত জঘণ্য জিনিস পড়তে হচ্ছে বলে মেজাজটাই বিগড়ে গেল।
মায়ের উপর যত রাগ হচ্ছিল ঝাড়তে লাগলাম কলমটার উপর। গোড়াটা দাঁতে কামড়ে ধরে যখন আনচান করছিলাম বাইরে যাবার একটা অজুহাত বের করবার, ঠিক তখনই চোখ আটকে গেল দক্ষিণ-পুবের খুঁটিটার গায়ে। ওধারটায় শুক্কুরদাদের ঘর; শুক্কুরদা, অমলদা আর শোভা বৌদির। বাপ-মা নেই, দাদা-বৌদির সংসারেই তাই শুক্কুরদার থাকা। তবুও ও ঘরটা অমলদার, একথা কেউ বলে না। আশেপাশের দশ গাঁয়ের মানুষ শুক্কুরদার ঘর বলেই এক নামে চেনে।
শুক্কুরদা মানুষটা বেশ সহজ-সরল। যদিও সহজ-সরল কথাটা তার ক্ষেত্রে খাটে না। বরং বোকাসোকা বললেই বেশি মানায়। তা সত্ত্বেও আমরা, মানে গাঁয়ের সব ছোটরা তাকে কিঞ্চিৎ ভয় পাই, তার চোখ দুটোর কারণে; গোল গোল বড় বড় দুটো চোখ। ও দুটো চোখ বাঁচিয়ে আমি তাই সফেদা গাছটার পাশ দিয়ে আড়ে আড়ে চাইলাম অমলদার দিকে। বেশ রাগ রাগ ভঙ্গিতে আমলদা কী যেন বলছেন আর শুক্কুরদা মুখ গোঁজ করে দাঁড়িয়ে আছে। বইপত্র ফেলে জানালার সামনে গেলাম নতুন কোন রহস্যের খোঁজে। নতুন রহস্য মানেই নতুন ঘটনা। আর নতুন ঘটনা মানেই শুক্কুরদা!
একবার এক রাতে ঘুম ভেঙে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে বাইরে বের হতেই শুনি কেমন ঘড়ঘড় একটা আওয়াজ হচ্ছে। তখন আমাদের বাড়িতে মাটির পুরোনো রান্নাঘর ভেঙে সবে নতুন আরেকটা ঘর তোলা হচ্ছে। মায়ের বিস্তর সম্পত্তি সেই রান্নাঘর থেকে ঠাঁই নিয়েছে ভিতরের ঘরগুলোতে। শুধু শত গাদাগাদি ঠাঁসাঠাসি করেও ছোট চৌকিটার কোন সুরাহা হয় নি। তাই ওটার বন্দোবস্ত হয়েছে সফেদা গাছটার নিচে। আওয়াজটা ওদিক থেকেই আসছিল। চোর ভেবে ভয় পেয়ে বাবার ঘুম ভাঙিয়ে দুজন দুটো মোটা লাঠি নিয়ে বেরিয়ে দেখি সব হাওয়া! পরে শুনেছিলাম, ও রাতে শুক্কুরদা এসে নাক ডেকে ঘুমিয়েছিল খোলা হাওয়ায়। একটু বাদে বৃষ্টিতে ভিজে ঘুম ভাঙলে উঠে চলে যায় ওখান থেকে। সে রাতে ঐ দুই লাঠির দুই ঘা দিলে আজ আর শুক্কুরদাকে দেখতে হত না; ভেবেই কেমন শিউরে উঠলাম! ও ঘরে ততক্ষণে ঝড় শুরু হয়ে গেছে। অমলদা জোরে জোরে বলছেন, “তোরে কচ্ছিনে, মনির বিয়েতি আমাগের দাওয়াত দিই নি, তাও তুই ও বিয়ে খাতি যাবি ?”
“ওরা আমাগের এমনিই ভালো পায়। দাওয়াত দিতি হবি ক্যান ?”
শুক্কুরদার জন্য আমার ভীষণ মায়া হল। মানুষটা দাওয়াত-টাওয়াত বড় একটা বোঝে না। কেউ তার সঙ্গে হেসে দুটি কথা বললেই সে ভেবে নেয় তাকে এরা ভালো পেয়েছে। তারপর সে কারণে-অকারণে তাদের কাছে যায়। দু’একটা কাজ করে দিয়ে বলে, “দুটো ভাত খাতি দিবানি ?” তা কেউ নিষেধ করে না। শুক্কুরদাকে আসলেই সবাই কম-বেশি ভালবাসে। বেশ স্বাস্থ্যবান, সরল, মাঝারি সাইজের এই মানুষটা গত দশ বছরে আশেপাশে ক’গ্রামের কারও বিয়ে খেতে বাদ রাখে নি। তার কখনোই দাওয়াত লাগে না। খবর পেলে আপনিই ছুটে গিয়ে সেখানে হাজির হয়ে যায়। আজকের ঘটনাটা অবশ্য একটু ভিন্ন। মনিদিরা বেশ সম্পন্ন ঘরের মানুষ। তাই আমাদের কয়েক ঘর গরিবকে তারা নেমন্তন্ন করে নি। আমরা কেউ দুঃখ পেলেও তাই সেখানে যাব না। কিন্তু শুক্কুরদা তো আর আমাদের মত নয়। সে তো আর আমাদের দশজনের দলে পড়েনা। তাই চিৎকার করে সে বলল, “ আমি খাতি যাবই ।”
আমলদা ভীষণ রেগে গেলেন, “তোর যাওয়া দ্যাখাচ্ছি।” বলেই ঘর থেকে এক ইয়া মোটা দড়ি নিয়ে এসে শুক্কুরদার হাত পিছমোড়া করে বাঁধলেন খুঁটির সাথে, “এইবার যাবি ক্যামনে, দ্যাখবানি।”
শুক্কুরদা চোখ-মুখ শক্ত করে দাঁড়িয়ে রইল শুধু। মুখে কিছু বলল না।
বেলা গড়িয়ে চলল। ঘটনা দেখবার আশায় জানালার সামনে দাঁড়িয়ে থেকে দুবার মায়ের কাছে বকুনি খেলাম। তবু নতুন কিছুই ঘটল না। দুপুরে খাবার ডাক পড়তে তড়িঘড়ি নাকেমুখে দুটো গুঁজে ফিরে এলাম পড়ার টেবিলে। এবার আর গিয়ে জানালার সামনে দাঁড়াই নি। বাধ্য ছেলের মত মুখের সামনে বই ধরে রেখে পড়ার ভান করে চোখ আর কানটা খোলা রেখেছি। হঠাৎ শুনি শুক্কুরদা বলে উঠেছে, “ ঐ কলাপাতা দিল রে।”
খানিকটা অবাক হয়ে চেয়ে রইলাম। মানেটা কী এর?
মিনিট পাঁচেক পরে শুনি, “ঐ ভাত দিল রে।”
এইবার ঘটনা কিছুটা আঁচ করতে পারলাম।
গ্রামের বিয়ে। খোলা জায়গায় সার বেধে সবাইকে খেতে দেয়া হয় কলাপাতায়। তা খাদ্য তালিকা মোটামুটি সবসময়েই একরকম- ভাত, সবজির ঘন্ট, ডাল, মাংস আর দই। দইয়ের জায়গায় দুধ-বাতাসা দিয়েই কাজ সারে গরিব ঘরগুলো। শুধু মনিদির মত বড়লোক যারা, তারা ঘন দুধে পাতা মিষ্টি দই দেয়।
ভাবনায় ছেদ পড়ল শুক্কুরদার গলা শুনে, “ ঐ ঘন্ট দিল রে।”
এই ঘন্ট জিনিসটা আমার একেবারেই পছন্দ না। রোজই তো দুবেলা ঐ শাকপাতাই খাচ্ছি। তা বিয়ে বাড়িতে গিয়েও ও খেয়ে খিদে নষ্ট করা ছাড়া আর কী বা লাভ হয়? তবু কেন যে শুক্কুরদার ঐটেই বেশি পছন্দ, কে জানে! মাংস বাদ দিয়ে বিয়ে বাড়ি গিয়ে কেউ শুধু ঘন্ট দিয়ে খায়? শুক্কুরদাটা না এক্কেবারে বোকা!
মাংসের কথা ভাবতে না ভাবতেই শুনতে পেলাম, “ঐ গোশত দিল রে।”
এইবার মনিদির বিয়েতে খেতে না পেয়ে আমার সত্যিই ভীষণ দুঃখ হল। সাথে সাথে কোথা থেকে যেন ভুরভুর করে খিদেটা বেশ চাগিয়ে উঠল। মন খারাপ আর খিদের পাল্লায় পড়ে কখন যে অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছি খেয়ালই করি নি।
হঠাৎ তীব্র চিৎকারে চমকে উঠলাম, “ঐ দই দিল রেএএএএএ…… !”
পলক ফেলবার আগেই জানালার সামনে দিয়ে অদ্ভুত ভঙ্গিতে সাঁই করে একটা শরীর ছুটে যেতে দেখলাম তীর বেগে; পিছনে নাচতে নাচতে চলেছে একটা হাতবাঁধা খুঁটি! চকিতে চাইলাম দক্ষিণ-পুবের কোণের দিকটায়। কয়েক জোড়া নগ্ন পা পেরিয়ে চোখ আটকে গেল মাত্র খুবলে উঠে যাওয়া মাটির দিকে। খুঁটির অস্তিত্বের চিহ্নস্বরূপ রয়ে যাওয়া ছোটখাট গর্তটায় চেয়ে রইলাম হা করে!
অসাধারন! :huzur:
ধন্যবাদ আপু। 🙂
পলক ফেলবার আগেই জানালার সামনে দিয়ে অদ্ভুত ভঙ্গিতে সাঁই করে একটা শরীর ছুটে যেতে দেখলাম তীর বেগে; পিছনে নাচতে নাচতে চলেছে একটা হাতবাঁধা খুঁটি!
:clappinghands: :penguindance:
ওরে….ওরে….ওরে….জটিল =))
ধন্য ধন্য…বাদ! 🙂
হা হা! =)) হাসতে হাসতে শেষ। সেইরকম লাগলো! :dhisya:
হাসাতে পারানোর জন্য ভালো লাগছে। 🙂
আসলেই অসাধারণ! কী চমৎকার বর্ণনা! :fire:
(ইয়ে গল্পে ইমো না দেয়াটা ভালো মনে হয়। এটা তো পোস্ট না তাই না? আমি প্রথম প্রথম দিতাম। )
ব্যাকরণ কোনটা সঠিক? ব্যাকরণ? নাকি ব্যকরণ? :voypaisi:
আমি তো জানতাম ব্যাকরণ!
হ্যাঁ ইমোর ব্যাপারে আমিও বলতে চাইছিলাম।
আর হুম, ব্যাকরণ।
গল্প পড়ে মুগ্ধ বিমোহিত হয়ে ভুলের কথা বলতে ভুলে গেছি। 😛
মাঝে মাঝে ভুলে যাওয়া ভালো। 😛
তুমি যাহা জানো, আমি তাহা জানি… 😛
ইমো উডায়া নিছি। 😀
ভাই রে ভাই :welcome: এত্ত সুন্দর করে কেমনে লিখে রে ভাই!
থ্যাঙ্কু থ্যাঙ্কু …গলে গেলাম… 😀
“ঐ দই দিল রেএএএএএ…… !” :rollinglaugh: =))
বিয়া খাইতে মুঞ্চায়
তাইলে আগে বিয়া কইরা ফালা! 😆
:clappinghands:
:beshikhushi:
এই রকম একেকটা পিস না থাকলে দুনিয়া যে কই থাকত! হাহাহা
ঠিক বলেছ অদিতি আপু। শুক্কুরদা কিন্তু সত্যিই ছিলো…
স্বপ্ন বিলাস ভাইয়ার সাথে একমত! :beerdrink:
“বিয়া খাইতে মুঞ্চায়” :clappinghands:
লেখাটায় কিছুটা শরৎচন্দ্রের ছায়া আছে! মজা পেলাম দারুণ! 🙂
স্বপ্ন বিলাস ভাইয়াকে বিয়ে করে ফেলতে বলো… 😛
গল্পে শরৎচন্দ্রের ছায়া ? হায় আল্লাহ, মেয়ে বলে কী !! খুশিতে তো মরে যেতে ইচ্ছে হয় শুনলে !! :beshikhushi:
দারুণ ঝরঝরে লেখনী আপনার। একটানে পড়ে ফেলেছি। বেশ ভাল লাগল 🙂
পলক ফেলবার আগেই জানালার সামনে দিয়ে অদ্ভুত ভঙ্গিতে সাঁই করে একটা শরীর ছুটে যেতে দেখলাম তীর বেগে; পিছনে নাচতে নাচতে চলেছে একটা হাতবাঁধা খুঁটি! =)) =))
ধন্যবাদ। 🙂
ওপারের বাবুদের বিশেষ করে শরৎ চন্দ্রের বেশ প্রভাব দেখা যায় ভাষায় 🙂 এ জিনিস আমার দ্বারা জীবনেও সম্ভব নয় ! মজা পেলুম 😀
ওরে এতো খুশি কোথায় রাখি রে! আমার তো পকেটে আর জায়গা নাই! কার সাথে কার তুলনা! হে পরওয়ারদিগার! 😛
তোর দ্বারা হুমায়ুন আহমেদ স্টাইল কিঞ্চিৎ সম্ভব। তোর কিছু গল্পে সেই ছাপ আছে। 🙂
মজা পেলাম অনেক =))
ধইন্যা। 😀
বড়ই মজাদার গপ্পো 🙂
ধইন্যা। 😛