[গল্প লেখার উদ্দেশ্য নিয়েই লেখা আমার প্রথম গল্প। লেখার নিম্নমান পড়তে গেলেই টের পেয়ে যাবেন। অনেক দুঃসাহসে ভর করে তবু দিয়ে দিলাম। যারা পড়বেন ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে বিবেচনা করে নেবেন আশা করি। আর যারা এইটুকু পড়ে ইতিমধ্যেই নিদারুণ শঙ্কিতবোধ করছেন, তারা আর এগুবেন না, প্লিজ!]
১:::
খুনটা হয়েছিল শেষ রাতে। একটানা ডাকতে ডাকতে ঝিঁঝিগুলো ক্লান্ত হয়ে থেমে যাবার সময়টায়। রাত পোহালে কুয়াশার চাদর জড়িয়ে মাঘের সূর্যটা যখন সদ্য হাঁটতে শেখা শিশুর মত সৈয়দ বাড়ির উঠোনে আছড়ে পড়ল, তখন উঠোনটা ভিড়ে ভিড়াক্কার। দক্ষিনে চালতা গাছের গায়ে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল রেবা, চোখ উঠোনের ঠিক মাঝখানে রাখা খাটিয়াটায়- বোবা হয়ে শরীরটা যেখানে ঘুমিয়ে আছে। ঠোঁটের কোল বেয়ে গড়িয়ে আসা কষ শুকিয়ে গেছে, চোখ দুটো কাচের মতন নিষ্প্রভ, চেয়ে আছে শূন্যে। শান্ত রেবাকে সান্তনা দিতে নিরুপায় আরও দশ বাড়ির বউ-ঝিরা তাকে ঘিরে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে। ঘরের দাওয়ায় বসে পঙ্গু সৈয়দ সাহেব। পুরো নামটা ছোট হতে হতে হারিয়ে এখন কেবল বংশের নামটাই বেঁচে আছে লোকমুখে।
“তা সৈয়দ সাব,” পুব দিকের ভিড় থেকে চেয়ারম্যান মনু মিয়ার কন্ঠ শোনা গেল, “এইবার তো গোসল দিয়া জানাজা পড়াইতে হয়, কী কন?”
একটা চাপা গুঞ্জন উঠল উঠোনটা ঘিরে। সঙ্গে সঙ্গে কালনাগিনীর মত তেড়ে এল রেবা। ঠান্ডা গলায় হিসহিসিয়ে উচ্চারণ করল, “আমার স্বামীর জানাজার দরকার নাই। আব্বা তো খাড়াইতে পারব না। নাইলে হের পোলার জানাজা হেরেই পড়তে কইতাম।”
“এইডা তুমি কী কও, রেবা? বাপে ল্যাংড়া বইলা পোলার জানাজা হইব না? ক্যান আমরা আছি না?”
“কইলাম তো চ্যারমেন চাচা, আমার স্বামীর জানাজা লাগব না। আপনেরা অহন যান,” বলতে বলতে দু’চোখ ভিজে আসে রেবার।
কত বছর ধরে মানুষটা তার স্বামী? হিসেবটা গুলিয়ে যায়। শুধু মনে পড়ে, গত তিনটা বছর ধরে তার নাম বাঁজা মেয়েমানুষ। তার স্বামী নাসিমের সামনে না হলেও আড়ালে আবডালে এ নামেই তাকে ডাকত সবাই। তবু কখনও হিসেব করে নি রেবা, জীবনে কী পেল, আর কী পেল না। কিছু পাবার আশায় সে নাসিমকে বিয়ে করে নি। মুক্তিযোদ্ধা পঙ্গু শ্বশুর তাকে পছন্দ করে ছেলের বউ করে এনেছিলেন।
২:::
‘মুক্তিযোদ্ধা’- হ্যাঁ, এই একটা শব্দের জন্যই আজ এতকিছু। এই একটা শব্দই আজ এই বাড়ির সবকটা জীবনকে গ্রাস করে নিয়ে গেছে। গত পরশুদিন দুপুর অবধিও সব ঠিক ছিল। খাবার পর্বটা যখন প্রায় শেষের দিকে তখন তাদের বাড়িতে এলো ঐ চেয়ারম্যান, সাথে দুই ছোকড়া। তাদের একজনের হাতে বিশাল ক্যামেরা, অন্যজনের হাতে মাইক। বেশ তরল গলায় চেয়ারম্যান বলে উঠল, “সৈয়দ সাব, এইবার আপনেগো দুখের দিন শ্যাষ। দেহেন, কাগো লইয়াইছি। শহরের মানুষ। টিভি থেইক্কা আইছে। আপনের লগে কথা কইতে চায়। সব যদি খুইল্লা কন তইলে টেকাও পাইবেন। হে হে হে। মানে আপনেগো আর কষ্টে থাকন লাগব না আর কি।”
কথা শেষ হতেই এক ছোকড়া ঝুঁকে সৈয়দ সাহেবকে চটপট সালাম করে নিল।
“চাচা, আমার নাম সাজ্জাদ। এবারের বিজয় দিবসে আমরা একটা অনুষ্ঠান করছি। দেশের পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে, তাদের বর্তমান অবস্থা নিয়ে। আমরা চেষ্টা করছি তাদের সাহায্য করতে, অবস্থার উন্নতি করতে।”
কথা শুনে চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে সৈয়দ সাহেবের। এই ছেলেরা আজকাল মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য দিতে চায়। এরা যুদ্ধ কী তা-ই জানে না, অথচ একজন যোদ্ধাকে সাহায্য দিতে চায়! সাহায্য, টাকা, এইগুলো দিয়ে আজ তার মত মুক্তিযোদ্ধাকে কেনা-বেচা করা হয় মিডিয়ার বাজারে। হায়! দেশ স্বাধীন করা মুক্তিযোদ্ধারা আজ দু-তিন টাকা সের দরে লাউ-কুমড়ার মত পাইকারি বিক্রি হয়! এর থেকে যারা সেসময় শহীদ হয়েছে, তারা মরে গিয়েও বেঁচে গেছে। তাদেরকে অন্তত এই পণ্য হবার নির্মম উপহার পেতে হয় নি!
মুখে এসবের কিছুই বলেন না তিনি।
কিন্তু চেয়ারম্যান ঠিকই বলে ওঠেন, “কই, নাসিম কি বাড়িত নাই? এরা এত দূর থেইক্কা আইছে, তা একটু কিছু এগো লাইগা আয়োজন করেন সৈয়দ সাব। নাইলে আপনের বৌমারেই কন না হয়, নাস্তা-পানি কিছু দিতে।”
৩:::
“বৌমাআ আ…” চমকে ফিরে তাকায় রেবা। সূর্যের আলো এখন উঠানের অনেকটা জুড়ে, খাটিয়াটা ছুঁই ছুঁই করছে।
“বৌমা, তোমার শাশুড়ির কবরের পাশে আরেকটা কবর খুঁড়তে কও। নাসিমের জানাজা আমি একাই দিমু।”
“সৈয়দ সাব, এত বাড়াবাড়ি কিন্তু ভালা না। আপনের পোলা বাড়াবাড়ি করছিল বইলাম…”
“বৌমা…”
“আপনেরা অহন যান, চ্যারমেন চাচা,” রেবা মুখ নিচু করে। এতটুকু সূর্যের আলোও যেন আজ বড্ড চোখে লাগছে।
৪:::
সেদিন দুপুরে কাপে চা ঢালতে ব্যস্ত রেবা।
হঠাৎ নাসিমের উত্তেজিত কন্ঠ শুনতে পায় ভেতর থেকে, “আপনেরা অহন যান।”
রেবা ছুটে এসে দরজার চৌকাঠে দাঁড়ায়।
“আহা, নাসিম তুমি বুঝতাছ না। সব কাহিনী কইলে তোমাগোই লাভ। যাগো অবস্থা যত খারাপ হেরা তত বেশি টেকা পাইব।”
“আমার বাপে কি টেকার লাইগা যুদ্ধ করছে নি?”
“তা ঠিক আছে। তুমি শুধু শুধু মাথা গরম করতাছ। এই চাকরির বাজারে তোমার ওই মুক্তিযুদ্ধ সাট্টিফিকেটেরও একটা দাম আছে। আছে না?”
“আমার সাট্টিফিকেটের দরকার নাই। আমি ঐগুলান ভাঙ্গাইয়া খাই না।”
“ঠিক আছে, তোমার ভালা তুমি না দেখলে নাই। কিন্তু গেরামের আর পাঁচ জনের কথাও তো ভাববা। তোমরা কিছু একটা পাইলে তার একটা হক তো তাগোও আছে, না? হে হে, সেইডার জইন্যও তো…”
“এইখান থেইক্কা অহনই সবাই বাইর হইয়া যান। দরকার পড়লে আমরা এই গেরামে থাকুম না।”
রেবা এক পা সামনে এগিয়ে দেখে তার শ্বশুরের মুখটা থমথমে। হাতটা কাঁপছে।
“চাচা, আপনি বলেন না। এসবে তো কোন লজ্জা নেই, তাই না? আপনার স্ত্রীকে কি প্রেগন্যান্ট অবস্থাতেই পিশাচ হানাদারগুলো…?”
“ঐ হারামির বাচ্চা, তুই বাইর হ অহনি। আমার মায়রে নিয়া আর একটা কথা কইলে তোর জিব আমি টাইন্না ছিঁড়া ফালামু। এতদিন পরে মজা লইতে আইছস?”
“সৈয়দ সাব, আপনের পোলা কিন্তু বাড়াবাড়ি করতেছে। ওর মায়রে পোয়াতি অবস্থায় নষ্ট কইরা ফালানের পর পেডে লাত্থি মাইরা ওর জন্ম হইছে- এইডা কইলে কি ওর মুখে ফোস্কা পড়ব?”
“শালা রাজাকার, পাকিস্তানী শুয়োর, তুই আমার জাত নিয়া টানাটানি করস? তোর এত সাহস? একাত্তরে তুই কী ছিলি আমি জানি না? আমার মায়রে তুই…”
ছুটে গিয়ে নাসিম চেয়ারম্যানের কলার ধরে। ছেলে দুটো আর দাঁড়ায় না। গ্রামের ত্রিসীমানা থেকে কোথায় হারিয়ে যায় তা আর দেখা হয় না কারও।
৫:::
সেই বিকেলের আলোও উঠোনময় খেলে বেড়িয়েছিল নরম পায়ে, এই সকালের আলোর মতই। শুধু সেদিনের উঠোনে কোন খাটিয়া ছিল না, ঠোঁটের কোল বেয়ে শুকিয়ে যাওয়া কষ মুখে নাসিম ঘুমিয়ে ছিল না।
উঠোনটা ফাঁকা হয়ে আসে। জানাজা পড়তে না দেয়ায় চেয়ারম্যান তার লোকজন নিয়ে ফিরে যেতে থাকে অপমানিত হয়ে। এরপর কী হবে কে জানে! রেবা এগিয়ে যায় খাটিয়ার কাছে। তার স্বামী দু’চোখ মেলে চেয়ে আছে শূন্যের দিকে।
স্বামীর চোখে চেয়ে রেবা একটা লাইন পরিষ্কারভাবে পড়তে পারে, “শালা রাজাকার, পাকিস্তানী শুয়োর!”
পরিশিষ্ট:::
মাস দুই পরে গ্রাম ছেড়ে যাবার সময় হাস্যোজ্জ্বল মুখে চেয়ারম্যান একটা খোলা খাম এগিয়ে দেয় রেবার দিকে।
“এইডা রাখ রেবা, ঐ টিভি থেইক্কা দিছিল। এহন কই না কই যাইবা, কামে লাগব। তোমাগো যেটুক হক সেটুক আছে। বাকিডা গেরামের আর পাঁচজনের ভালা কামেই…হে হে হে, বুঝবারই পারতাছ!”
পঙ্গু সৈয়দ সাহেব বসে থেকেই হাত বাড়িয়ে দেন।
চমকে ওঠে রেবা, “আব্বা!”
খাম থেকে টাকাগুলো বের করেই হ্যাচকা টানে ছিড়িতে থাকেন সৈয়দ সাহেব। তার হাত কাঁপে, মুখ-চোখ কুঁচকে জল বেরিয়ে আসে। এরপর ছেঁড়া কাগজগুলো মাটিতে ফেলে তিনি একদলা থুতু ছুঁড়ে দেন তার উপর।
মাঘের সূর্যটা এখন হাঁটা ছেড়ে দৌঁড়োতে শিখেছে। তার তীব্র আলোয় সেই থুতুর দলাটি চকচকে ছুরির ফলার মত জ্বলতে থাকে একরাশ ঘৃণা নিয়ে।
অস্থির হইছে…… :happy: :happy: :happy: :happy: :happy:
এখনও সন্দেহ আছে যে আদৌ হইছে কি-না! 😳
আমার তো চমৎকার লাগছে গল্প।
এবং আসলেই আমাদের অবস্থা এখন এমনই!
কিন্তু এই অবস্থা তো আমি আমরা কেউ ই চাই না।
অথচ মুক্তিযোদ্ধাদের দাম শুধবার মত কোন কিছুই এখন একচ্ছত্র অধিকারে নেই।
খুব ভয়ংকর একটা অনুভুতি বুকে নিয়ে কমেন্টটা করছি। ঘৃণার চেয়েও ভয়ানক কিছু…
কিছু কিছু ক্ষেত্রে এই অনুভূতিটা যদি সবার মাঝেই থাকত!
অনেক ভালো হয়েছে গল্পটা আপু। প্রথমের কথাগুলি কেন যে লিখলা!
🙁
আমার লেখা প্রথম গল্প, তাই বিষয়টা প্রথমেই সবাইকে জানিয়ে দেয়া উচিত বলে মনে হল। নয়ত চাপাবাজি হয়ে যেত না?
কী যে অসাধারণ লিখলি!!! মনটা খুব খারাপ হয়ে গেলো। কেমন যেন একটা ঘৃণায় ভরে উঠছে মনটা। মুক্তিযুদ্ধের সময় যারা প্রাণ দিয়ে লড়েছে এই দেশটার জন্য তারা বাদে সবাই ভোগ করছে দেশটাকে। তারাই পরে আছে ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে……… 🙁
মাঝে মাঝে রাগে-দুঃখে নিজের হাত-পা কামড়ে খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করে! কিছু যদি সত্যি করে যেতে পারতাম মৃত্যুর আগে!
অনেক ভালো হয়েছে গল্পটা। দমটা কেমন বন্ধ হয়ে আসছে! কেমন যেন একটা পাঁথর চাপা কষ্ট লাগছে বুকটার মধ্যে। কেন এমন হয়! মানুষ কেন এতো খারাপ হয়!!
মানুষ ভালোও হয় রে। আমি আশায় আশায় পথ চেয়ে থাকি, বিশ্বাস হারাই না সহজে আর।
অনেক সুন্দর! মন খারাপ হয়ে গেলো। 🙁
🙁
চমৎকার হয়েছে গল্পটি। অনেক ভালো লাগলো।
একদম কাট কাট লেখা-গল্পের সাথে পুরোপুরি মিলে গেছে।গল্পের ভাবটা লেখায় খুঁজে পেলাম। :dhisya: