শাহেদ উপাখ্যান

শুক্রবার।

ডিজিটাল দেশের অ্যানালগ ঘড়ির ঘন্টার কাঁটা তখন তিন এর ঘরে। শহীদ ডা. শামসুদ্দিন হোস্টেলের এফ ব্লক থেকে হেলে দুলেন দুলকি চালে বেরিয়ে এলো শাহেদ। শাহেদের বর্ণনা যদি উপমা দিয়ে দিতে হয় তাহলে বলতে হবে তার চেহারা ঠিক পেলের মতো, চোখগুলো টিয়ার গ্যাসের শেলের মতো, দাঁতের পাটি হরতালে জ্বলা রেলের মতো আর মাথাটাকে সে সবসময় রাখে বেলের মতো। চেহারা যাই হোক শাহেদ হলো মা-বাবার গোল্ডেন বয়। ‘কালোই জগতের আলো’ কথাটার যথার্থতা রক্ষা করার আপ্রাণ চেষ্টা করে শাহেদ। তাই তো এস.এস.সি. , এইচ.এস.সি.তে গোল্ডেন এ প্লাস পেয়ে মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে সে সিলেট মেডিকেল কলেজে পড়তে এসেছে।

 

তবে শাহেদের সেই জৌলুস অনেক আগেই উসখুস করে পলায়ন করেছে। এখন শাহেদকে দেখতে অনেকটা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মতো লাগে। তার বেল মাথায় এখন চুল গজিয়েছে। দাঁড়িগুলোও চুলের সাথে পাল্লা দিয়ে বড় হচ্ছে। শাহেদ এখন প্রায় সময় হোস্টেলের সামনে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা সিলেট স্টেডিয়ামের ফ্লাড লাইটের দিকে উদাস নয়নে তাকিয়ে থাকে।

 

শাহেদ তার এই আপেক্ষিক অবনমনকে রাউল্টের সূত্রের সাহায্যে ব্যাখ্যা করার বহু চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে। তবে আমার কাছে কেউ জানতে চাইলে আমি বলব, শাহেদের এই অবনমনের পিছনে ছোট্ট একটা পটভূমি আছে। বড় ঘটনার বড় পটভূমি আর ছোট ঘটনার ছোট পটভূমি। এই বিশাল মহাবিশ্বের নানা জাগতিক, অতিজাগতিক এবং মহাজাগতিক ঘটনার মধ্যে শাহেদের বর্তমান অবনমন নিতান্তই তুচ্ছ ঘটনা। তাই এর পিছনকার পটভূমিটাও বেশ বড় নয়। টার্ম পরীক্ষার সময় যে বড় সাইজের খাতা দেয়া হয় তার এক পৃষ্ঠার মধ্যে অনায়াসে এই পটভূমি লেখা হয়ে যাবে। পটভূমির সার-সংক্ষেপ এই যে, অ্যানাটমির ‘অ্যাবডোমেন’ কার্ডে  পরপর তিনবার ফেল করার পর তার এই দশা। কার্ড ফাইনাল পরীক্ষায় সে প্র্যাক্টিক্যালে ৫৮ পেয়ে ফেল করে, সাপ্লিমেন্টারি পরীক্ষায় ভাইভাতে ৫৫ আর রি-সাপ্লিমেন্টারি পরীক্ষায় রিটেনে পায় ৫৭। কোন বারই সে একসাথে তিন পরীক্ষায় পাশ মার্ক ৬০ তুলতে পারেনি। একেকবার একেক পরীক্ষা তার খারাপ হয়েছে।

 

আগামী রবিবার শাহেদ আবারও ‘দ্যা ম্যাজিক বক্স’ এর ম্যাজিক দেখতে যাবে। অ্যাবডোমেন বা উদরকে চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা দ্যা ম্যাজিক বক্স বলেন। কিন্তু এবার সে ভাইভা বোর্ডে নিজের ভাগ্য পরীক্ষা করার আগেই নিজের ভাগ্য জানতে চায়। এই যুগান্তকারী বুদ্ধিটা অবশ্য শাহেদের মাথা থেকে আসেনি, এসেছে বায়োকেমেস্ট্রি ডিপার্টমেন্টের মামা হারুনুর রশীদের কাছ থেকে। কলেজের তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারিদেরকে ছাত্র-ছাত্রীরা মামা ডাকে। এই ছাত্র দরদী মামা শাহেদকে বলেছে তার জানাশোনা এক জ্যোতিষী আছে যার উপর তার আগাধ বিশ্বাস।

“অত দেরি লাগলনি আইতে?” হোস্টেলের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মামার কথায় চমকে উঠল শাহেদ। তার উদাস নয়ন তখনো স্টেডিয়ামের ফ্লাড লাইটের পানে তাকিয়ে ছিল।

“শুক্রবারতো, তাই নামাজ পড়ে খেয়ে দেয়ে আসতে হইছে।” বলল শাহেদ।

“মামা, জ্যোতিষবাবার চেম্বার তো রেল স্টেশন। রিশকা লইলাই কিতা কইন?” প্রায় সব সিলেটি রিকশাকে রিশকা বলে, লাফকে বলে ফাল। বাংলা ব্যাকরণে এটাকে সম্ভবত ধ্বনি বিপর্যয় বলা হয়। পরিবেশ বিপর্যয়, পুঁজিবাজার বিপর্যয়সহ নানান বিপর্যয়ের মুখে এই ধ্বনি বিপর্যয় খুব একটা গুরুত্ব পায় না।

“হ্যাঁ হ্যাঁ রিকশা ডাকেন।” মামার প্রশ্নের জবাবে বলল শাহেদ।

রিকশায় করে রেল স্টেশন যাওয়ার পুরোটা পথে হারুন মামার মুখে জ্যোতিষীর গুণ-কীর্তন শুনে শাহেদের সাথে সাথে রিকশাওয়ালাও কনভিন্স হয়ে গেছে। সেও ঠিক করেছে আজকে নিজের হাতটা জ্যোতিষবাবার কাছে দেখিয়ে নিবে। প্রতি মাসে সে কত লটারির টিকেট কিনে। একটা টিকেটও লাগেনা কেন এইটা তার জানা দরকার।

 

অবশেষে হারুন মামা, শাহেদ এবং রিকশাওয়ালা জ্যোতিষীর চেম্বারে পৌঁছুল। জ্যোতিষীর চেম্বার সিলেট রেল স্টেশনের রাস্তার উল্টো দিকে দুইটা ঠেলাগাড়ির মাঝখানে। জ্যোতিষী রাস্তাতেই তার চেম্বারের যাবতীয় স্থাবর-অস্থাবর জিনিসাদী নিয়ে বসেছেন। জ্যোতিষীর পিছনে কোঁচকানো একটা ময়লা ব্যানার। ব্যানারে একটি হাতের ছবি দেয়া যদিও সেটা ডান হাত না বাম হাত শাহেদ অনেক চেষ্টা করেও বুঝতে পারেনি। হাতের ছবির নিচে লেখা জ্যোতিষী সম্রাট ‘দুলাল চৌধুরী’। নামের পাশে কিছু ইংরেজি অক্ষরের বাংলা রূপ ছোট করে লেখা। সেগুলো সম্ভবত জ্যোতিষী সম্রাটের ডিগ্রি হবে। চেম্বারের দুই পাশে দুই ঠেলা গাড়ি থেকে কম অ্যামপ্লিফায়ারের দুই মাইক থেকে দুই ধরণের বক্তব্য শোনা যাচ্ছে। একটা মাইক থেকে প্রাপ্ত বক্তব্য মোটামুটি এই রকম, “এই বইটি পড়িলে আপনি জানিতে পারিবেন কোন মসজিদে জ্বিনের বাদশারা নামাজ পড়ান। এই বইটি পড়িলে আপনি…………।” আরেক মাইক থেকে প্রাপ্ত বক্তব্য হচ্ছে, “এই মলম ব্যবহারে আপনার আঙুলের চিপায়-চাপায় যত খাঁওজানি, চুলকানি………..।” এই দুই বক্তব্যের মাঝখানে জ্যোতিষীর চেম্বারে এক বিশেষ আবহ সৃষ্টি হয়েছে।

 

এরই মাঝে প্রায় বিশ-পঁচিশ মিনিট পার হয়ে গেছে। জ্যোতিষীর উপর হারুন মামার অনেক বিশ্বাস থাকলেও শাহেদের বিশ্বাস আস্তে আস্তে বাষ্পীভূত হওয়া শুরু করেছে। এত সময় ধরে জ্যোতিষী উল্টে-পাল্টে তার হাতটা শুধু দেখছে। তার নাম কী, বয়স কত কিছুই জিজ্ঞেস করেনি।

 

হঠাৎ শাহেদ পিছনের দিকে বেশ হৈ-হল্লা শুনতে পেল। কতগুলো দাঁড়ি-টুপিওয়ালা লোককে দাঙ্গা পুলিশ দৌড়ানি দিচ্ছে। রেঞ্জের মধ্যে পড়লে লাঠি দিয়ে মৃদু ধনাত্নক চার্জে চার্জিতও করে দিচ্ছে। শাহেদ অপলক নয়নে পুলিশের এই লাঠি চার্জ অবলোকন করছিল। লোকগুলো দৌড়াতে দৌড়াতে ওর প্রায় কাছে চলে এসেছে। তাদের পিছনে পুলিশও দৌড়াচ্ছে। শাহেদ তখন সামনে তাকিয়ে দেখে জ্যোতিষী সম্রাট দুলাল চৌধুরী, বায়োকেমেস্ট্রির হারুন মামা, রিকশাওয়ালা কেউ আশে পাশে নেই। এমনকি দুই পাশে যে দুই ঠেলাগাড়ি ছিল সেগুলোও দিব্যি হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। হঠাৎ শাহেদের মনে হলো তার দাঁড়ি এক মুষ্ঠি না হলেও কোয়ার্টার মুষ্ঠি হয়ে গেছে আর শুক্রবার বলে তার পড়নেও পাঞ্জাবি, পায়জামা ও টুপি। কিন্তু ততক্ষণে বেশ দেরি হয়ে গেছে শাহেদের রাইট নী জয়েন্টের ল্যাটেরাল অ্যাসপেক্টে অর্থাৎ ডান হাঁটুর পার্শদেশে দাঙ্গা পুলিশের হাতের গদাটা আছড়ে পড়লো……………..।

 

সপ্তাহখানেক পরের কথা। শাহেদের অ্যাবডোমেন কার্ড রি-রি-সাপ্লিমেন্টারি পরীক্ষা মোটামুটি ভালই হয়েছে। ফিজিওলজি টিউটোরিয়াল করার জন্য অনেক কষ্ট করে ডান পাটা টেনে টেনে তিন তলায় উঠল শাহেদ। ডিপার্টমেন্টের নোটিশ বোর্ডের সামনে বেশ ভিড়। বায়োকেমেস্ট্রি মেটাবলিজম কার্ডের রেজাল্ট দিয়েছে। শাহেদ ভিড় ঠেলে সামনে গিয়ে দেখে তার রোল নাম্বারের পাশে লাল কালিতে লেখা ফেল। মন খারাপ করে ক্লাসের দিকে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতে থাকল শাহেদ। আবার এই কার্ড পাশ করার জন্য তাকে যে কতবার সাপ্লিমেন্টারি পরীক্ষা দিতে হয় সেই হিসাব কষছে মনে মনে। হঠাৎ কোত্থেকে এসে উদয় হয় হারুন মামা। শাহেদের কানে কানে এসে বলে,  “মামা নতুন এক জ্যোতিষবাবার সন্ধান পাইছি। আউক্কা আজকু বিকালে যাই আফনেরে লইয়া…………।”

 

 

[গল্পটি লেখতে গিয়ে আমার ছোট ভাই নাবিদ রেজা নাঈমের ‘হাত দেখানোর পটভূমি, বর্ণনা ও তার প্রভাব’ গল্পের প্রভাবে সামান্য প্রভাবান্বিত হয়েছি।]

মুবিন সম্পর্কে

দেয়ালে দেয়ালে মনের খেয়ালে লিখি কথা। আমি যে বেকার, পেয়েছি লেখার স্বাধীনতা।।
এই লেখাটি পোস্ট করা হয়েছে বিবিধ, রম্য, সাহিত্য, হাবিজাবি-এ এবং ট্যাগ হয়েছে , , , , , , স্থায়ী লিংক বুকমার্ক করুন।

18 Responses to শাহেদ উপাখ্যান

  1. বোহেমিয়ান বলেছেনঃ

    হাহা

    ভালো লাগছে! 😀

    আরও চাই! 😀

    তোমার লেখায় বেশ চমৎকার কিছু জায়গা আছে। আমার মনে হয় আরও নিয়মিত হওয়া উচিৎ

  2. ফিনিক্স বলেছেনঃ

    ফানি, সিরিয়াস ভিউ সব মিলেমিশে একাকার!

    চমৎকার লাগল। 🙂

  3. অবন্তিকা বলেছেনঃ

    হিহিহি! 😛

  4. বাবুনি সুপ্তি বলেছেনঃ

    আহারে বেচারা। খারাপই লাগছে ভাবতে।

  5. স্বপ্ন বিলাস বলেছেনঃ

    মজা পেলাম :happy:

  6. জ্ঞানচোর বলেছেনঃ

    “হঠাৎ শাহেদ পিছনের দিকে বেশ হৈ-হল্লা শুনতে পেল। কতগুলো দাঁড়ি-টুপিওয়ালা লোককে দাঙ্গা পুলিশ দৌড়ানি দিচ্ছে। রেঞ্জের মধ্যে পড়লে লাঠি দিয়ে মৃদু ধনাত্নক চার্জে চার্জিতও করে দিচ্ছে। শাহেদ অপলক নয়নে পুলিশের এই লাঠি চার্জ অবলোকন করছিল। ”

    এটা পড়ার পর নিজেকে চেয়ারের উপর ধরে রাখতে পারলাম না।
    এত সিরিয়াস একটা মোমেন্টকে এত সহজে উত্থাপন। সেলাম হুজুর।
    :huzur:

  7. রাজারপোলা বলেছেনঃ

    হুম পড়লাম।

    শাহেদ টাইপের ছেলে আছে নাকি তোমাদের ক্লাসে ??

  8. গাঙচিল বলেছেনঃ

    খুব খুব খুউউব চমতকার লাগল।
    মনে হচ্ছে আমি গল্পটা পড়িনি, কেউ আমাকে হিপনোটাইজ করে পড়িয়ে নিচ্ছিল!!! কোন ফাঁকে যে শেষ হয়ে গেল টেরই পাইনি! 😯
    অসসাধারন হয়েছে ভাইয়া…………!

    :huzur: :huzur:

  9. সালমান আরজু বলেছেনঃ

    চমৎকার হয়েছে গল্পটি!
    ”কলেজের তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারিদেরকে ছাত্র-ছাত্রীরা মামা ডাকে” মামা ডাকের ভূমিকাটা আরও ভিন্নভাবে দেয়া যেতে পারে।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।