১৫ই ফেব্রুয়ারী, ১৯৫২ …..
মুশফিক মধুর ক্যান্টিনে বসে আছে । পুরো বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস উত্তপ্ত। মধুর ক্যান্টিনে কথার ঝড় বইছে । ক্যান্টিনের বয়-বেয়ারারা চা, সিঙ্গারা আর সিগারেটের যোগান দিতে দিতে হয়রান হয়ে পড়ছে । সবার মুখে একই কথা ,
– উর্দুকে আর কোনভাবেই প্রশ্রয় দেয়া যাবে না ।
পশ্চিম পাকিস্তানের অবিচার আর কেউই সহ্য করতে পারছে না । মুশফিক হঠাৎ বলে ওঠে,
– যাই হোক, সালাম ভাই আমাদের দিন কতকের মাঝেই কিছু একটা করতে হবে । তা না হলে মিলিটারিরা আরও বাড় বাড়বে ।
– কিন্তু বললেই তো আর করা যাচ্ছে না । মিলিটারিরা ক্যাম্পাসে যেভাবে ঘোরাফেরা করছে তাতে কখন যে কার কি হয়ে যায় ?
– আপনি এটা কি বলেন ভাই ? ওদের ভয়ে কি আমরা বসে থাকবো নাকি ? আমাদের ভাষা বাংলা । পুরো পাকিস্তানের ৫৬ ভাগ মানুষ বাংলায় কথা বলে । আর ওরা সেই বাংলায় আমাদের কথা বলতে দিবে না । এটা কেমন কথা ? আন্দোলন আমাদের করতেই হবে ।
রাসেল, জব্বার, রফিক এরাও মুশফিকের কথায় সায় দেয় । সন্ধ্যা হয়ে আসছে বলে সবাই যে যার হলে ফিরে যেতে শুরু করে । মুশফিক সূর্যসেন হলে থাকে । রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে সে অনেক কিছু ভাবে । বাড়িতে তার মা আর ছোটবোন । বাবা ৩ বছর হল মারা গেছে । কতদিন ওদের সাথে তার দেখা হয় না । খুব মনে পড়ছে ছোটবোন টাকে । এবার বাড়িতে গেলই ওর জন্যে লাল ফিতে নিতে হবে । ওর আবদার মেটাতেই হবে ।নইলে ও তুলকালাম কান্দ শুরু করে দিবে। ঘরে ঢুকেই মুশফিক টেবিলে বসে পড়ে । মাকে চিঠি লিখতে তার খুব ইচ্ছা করছে ।
মা,
কেমন আছো তোমরা সবাই ? তোমার শরীরটা ভালো তো ? তোমাকে আর বেশিদিন কষ্ট করতে হবে না । আর ১ বছরের মাঝেই আমি চাকরি পেয়ে যাবো । তখন তোমার সব কষ্ট শেষ । অনেকদিন হয়ে গেলো তোমাদের দেখি না । খুব দেখতে ইচ্ছা করছে তোমাদের । ক’দিন পরই বাড়িতে আসবো আমি । টুনু কেমন আছে ? ওর জন্য এবার লাল ফিতে নিয়ে আসবো । তুমি কিন্তু এখনই ওকে বলে দিও না । আমি এসে চমকে দেব । মা, তোমার রান্না কতদিন খাই না । এবার এসে পেট ভরে খাবো । ভালো থেকো তোমরা সবাই ।
ইতি
তোমার মুশফিক
১৯ই ফেব্রুয়ারী, ১৯৫২……
বিশ্ববিদ্যালয় আন্দোলনে ফেটে পড়ছে । গতকালও পুলিশ ছাত্রদের ওপর লাঠিচার্জ করেছে । পুরো বিশ্ববিদ্যালয়ে চলছে আন্দোলনের পূর্ব প্রস্তুতি । এই মুহূর্তে সবাই এক ও অভিন্ন । সাদা-কালো, ধনী-গরিব, হিন্দু-মুসলিম, ঝগড়া-বিবাদ ভুলে গিয়ে সবার মুখে একটাই স্লোগান ” রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই ” ।
মুশফিকও এর বাইরে নয় । ” রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ” -এর সাথে সে-ও কাজ করে চলছে । এখন তারা সবাই বসে আছে কলাভবনের বারান্দায় । চলছে পোস্টার, প্ল্যাকার্ড বানানোর কাজ । কাজের ফাঁকে রফিক ভাই বলে ওঠেন,
– শোনো তোমরা, আমদের মিছিলটা শুরু হবে ২১শে ফেব্রুয়ারী সকালে । রেডিওতে মিছিলের খবর পৌঁছে গেছে ।
মুশফিক বলে,
– আগে আগে মিছিলের খবর পৌঁছে গেলে যদি ওরা বাধা দেবার চেষ্টা করে ?
– আমরা বাঁধা মানবো না । আমাদের নিজেদের ভাষায় যারা কথা বলতে দিবে না , তাদের বাঁধা মানার তো কোনও প্রশ্নই ওঠে না ।
রফিক ভাইয়ের কথায় সবাই আরও উত্তেজিত হয়ে পড়ে । সবার দিকে তাকালেই বোঝা যায়, অনেক বড় একটা বিস্ফোরণের জন্যে অপেক্ষা করছে সবাই ।
২০ই ফেব্রুয়ারী, ১৯৫২……
মুশফিক ঘড়ির দিকে তাকায় । সন্ধ্যায় সাড়ে ৭টা । অনেকক্ষণ ধরে কার্জন হলে বসে বসে কাজ করছে । পোস্টার, প্ল্যাকার্ড বানাতে বানাতে ওর হাত ব্যাথা হয়ে গেছে । কাল মিছিল । আর মিছিল শেষেই ও রওনা দেবে বাড়িতে । হঠাৎ ওর মনে পড়ে ছোটবোনটার জন্যে লাল ফিতে কেনা হয় নি । মুশফিক জব্বার ভাইয়ের কাছে যায় ।
– ভাই, আমার একটু নিউমার্কেটে যেতে হবে । কাল মিছিল শেষে বাড়ি যাবো তো । তাই একটু কেনাকাটা ছিল ।
– অনেকদিন বাড়ি যাও না বুঝি ?
– হ্যাঁ । অনেকদিন যাওয়া হয় নি ।
– আচ্ছা যাও । কাল ১০টার মাঝে ক্যাম্পাসে চলে এসো ।
– আচ্ছা ভাই, আমি তাহলে আসি ।
এই বলে মুশফিক কার্জন হল থেকে বেরিয়ে আসে । নিউমার্কেটের সামনে শহীদের সাথে দেখা হয় । শহীদ মুশফিককে দেখে চেঁচিয়ে ওঠে,
– খবর শুনেছিস দোস্ত ?
– না । কি হয়েছে বল ।
– কাল আমাদের মিছিলের কথা শুনে পাকিস্তানিরা ১৪৪ ধারা জারি করেছে । বলেছে, মিছিল দেখলেই গুলি করবে ।
– কি বলিস এগুলো ?
– সত্যি দোস্ত ।
– যাই হোক, ভয় পাস না । এতো ছাত্র একসাথে দেখলে ওরাই উল্টো ভয় পেয়ে পালাবে ।
– তাই যেন হয় । তবে তুই তো মিছিলে থাকবি । একটু সাবধানে থাকিস রে ।
– আচ্ছা দোস্ত, তুই চিন্তা করিস না ।
মুশফিক লাল ফিতে কেনে । শখ করে লাল চুড়িও কেনে । হলে ফিরে যাওয়ার পথে মানুষ ভাবে, এই চুড়ি-ফিতে পেয়ে তার ছোট্ট বোনটা কত্ত খুশি হবে। ছোটবোনটার হাসিমুখ দেখতে পেলে তার খুব আনন্দ হয় । তার মাথায় আগামীকালের মিছিলের কথাও ঘোরে । সবকিছু ভেবে মনে মনে প্রচণ্ড শিহরিত হএ ওঠে মুশফিক ।
২১শে ফেব্রুয়ারী, ১৯৫২……
সকাল ১০টার দিকে ওরা সবাই মিলিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কাম্পাসের সামনে । মুশফিক সাড়ে ১০টার দিকে আসে । ওর বুকপকেটে লাল ফিতে আর চুড়ি । সবাই মিছিল সাজাতে শুরু করে । আস্তে আস্তে মিছিল বড় হতে থাকে । পুরো মিছিল জুড়ে ” রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই ” , ” উর্দু ভাষা নিপাত যাক ” সহ আরও অনেক প্ল্যাকার্ড । পুরো বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা জুড়ে উত্তেজনার স্পর্শ ।
মুশফিক মিছিলের একেবারে সামনের সারিতে দাঁড়িয়ে যায় । মিছিল শুরু হতে হতে প্রায় ১২টা বেজে যায় । মিছিলের মাঝে একটা ছন্দ থাকে । সামনের ৩-৪ টি সারি চিৎকার করে বলে ” রাষ্ট্রভাষা রাষ্ট্রভাষা।” তারপর বাকিরা একসাথে চিৎকার করে বলে ওঠে, ” বাংলা চাই, বাংলা চাই।” মুশফিক ছন্দে তাল মেলাতে থাকে ।
মিছিল আস্তে আস্তে এগিয়ে যায় । সবার মাঝেই অসম্ভব দৃঢ়তা কাজ করতে শুরু করে । ১৪৪ ধারা ভাঙ্গতে সবাই হয়ে ওঠে বদ্ধপরিকর ।
মিছিল ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনে আসতেই কিছু মিলিটারি জিপ এসে থামে । মিলিটারিরা টিয়ার গ্যাস ছোঁড়ে। মিছিল ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় । মিলিটারির সাথে ছাত্রদের সংঘর্ষ বাঁধে । শুরু হয় ভাষার জন্যে যুদ্ধ ।
মুশফিক কিছু বুঝে ওঠার আগেই তীক্ষ্ণ একটা বেদনা তার সারাদেহে ছড়িয়ে পড়ে । রাস্তায় লুটিয়ে পড়ে মুশফিক । নিস্তেজ হয়ে পড়ে তার দেহ । দুপুরবেলা কড়া রোদে পিচঢালা রাস্তায় লাল রঙের মোটা একটা রেখা ছড়িয়ে পড়ে । পাশে পড়ে থাকে ভাঙ্গা চুড়ি আর রক্তলাল ফিতে ।
( পাঠককে খোলাচিঠিঃ গল্পটি একটি ঐতিহাসিক পটভূমির উপর লেখা । তথ্যগত কিছু ভুল থাকতে পারে । আমি শুধু ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপট টিকে সবার সামনে তুলে ধরতে চেয়েছি । বেশ কিছু ঐতিহাসিক চরিত্র, যেমনঃ ভাষা শহীদ সালাম , ভাষা শহীদ জব্বার, ভাষা শহীদ রফিক এদের ব্যবহার করতে হয়েছে । এ চরিত্রগুলো তুলে ধরার ব্যাপারে যথেষ্ট সচেতন থাকার চেষ্টা করেছি। তবুও, চরিত্রগুলো বিশ্লেষণে ছোটখাটো কিছু ভুল থাকলে ক্ষমা করে দিবেন । )
ভাষা আন্দোলনের প্রতিটি বর্ণনা অনেক পথ ঘুরে যেন এক সুতোয় মিলে যাওয়া এক উপাখ্যান, আপনার উপস্থাপনা ভালো লেগেছে 8)
২১ ফেব্রুয়ারী কোনো তারিখ নয় , ২১ ফেব্রুয়ারী আমাদের এক আত্মপরিচয়….
ধন্যবাদ…… শিশিরকণা……
প্রতিটা বর্ণে যে একুশ মিশে আছে! ভালো লাগলো। :clappinghands:
অসংখ্য ধন্যবাদ……
এই সব গল্প আরও আসুক!
চমৎকার :clappinghands:
ধন্যবাদ……
চমৎকার গল্প।
সাবলীল উপস্থাপনা।
আরও চাই…… আরও।
চেষ্টা করব ভাইয়া…… আরও গল্প দিতে ।