নিখিল এ বিশ্বসংসারের উৎপত্তি, এর বিকাশ ও পরিণতি – যুগ যুগ ধরে ভাবুক মানুষকে করেছে চিন্তিত। সেই প্রাচীন মানুষের কচ্ছপ তত্ত্বের উপর দাঁড়ানো সমতল পৃথিবী, বিজ্ঞানের হাত ধরে ঠাঁই নিয়েছিল গোলাকার ভূ-কেন্দ্রীক মহাবিশ্বের একেবারে কেন্দ্রে। সময়ের ব্যবধানে, এ ধারনা থেকে সরতে সরতে, আমরা আজ এসে দাঁড়িয়েছে বিশা্ল মহাবিশ্বের এক তুচ্ছ কিনারায়।
রাতের মেঘহীন আকাশে চোখ মেলে তাকালে যে টুইঙ্কল-টুইঙ্কল-লিটল-স্টার দেখি, কবির কবিতায় যেগুলো প্রিয়ার খোঁপায় ফুল হয়ে ধরা দেয়, বিজ্ঞানচিন্তায়, সেগুলো আপাতত আমাদের জন্য অধরাই রয়ে যাবে। আর, আমরা জানি, তাদের নিভু নিভু আলোও মূলতঃ বাড়ে কমে না, এটা শুধুই আমাদের চারপাশের বায়ুমন্ডলের তৈরী মায়া।তাই বলে, কবি-কুলের কবিতায় বিজ্ঞান কোন ব্যঘাত চায় না। বরং তাদের কল্পনায় এক ভীন জগতের অভিজ্ঞতায় আরো রং ছড়িয়ে দেয়াই বিজ্ঞানের কাজ। আসুন, প্রথমে এই রঙ্গিন জগতের কিছু জানা জিনিস, আবার জেনে নেই।
এটা আমাদের সূর্য। বিশেষ আলোরোধী গ্লাসের মধ্য দিয়ে তাকালে এমনটি দেখাবে।
আমরা আজ জানি, আমাদের গনগনে আলোর সূর্য-মামা (( বাংলা উইকিপিডিয়া: সূর্য )) । আসলে ওই রাতের আকাশের তারাগুলোর মতই এক ছোট্ট তারকা। আ্য়তনে পৃথিবীর চেয়ে মাত্র তের লক্ষ গুণ বড়। দুরত্ব বিচারে মাত্র ১৫ কোটি মাইল দুরে হওয়ার এর তেজস্বীতা এত বেশী। আট আটটি বৃহৎ গ্রহ ও তাদের বহু উপগ্রহ আর ছোট ছোট গ্রহাণু নিয়ে সূর্য-তারকার ছোট্ট পরিবার।
আলোকবর্ষ দুরে: তারায় তারায় আলোর নাচন
লুব্ধক বা সিরিয়াস। সবচেয়ে উজ্জল তারা। এটা একটা সিমুলেটেড ইমেজ।
সূর্যকে পেছনে ফেলে (পরিচিত তারকাগুরোর মধ্যে ) সবচেয়ে কাছের তারাটির নাম সিরিয়াস (লুব্ধক/মৃগব্যাধ।)।
অগ্রহায়ণের দখিনা আকাশের সবচেয়ে উজ্জ্বল তারকাটির দুরত্ব প্রায় সাড়ে আট আলোকবর্ষ। ((এক আলোকবর্ষ হলো আলো প্রতি সেকেন্ডে তিন লক্ষ কিলোমিটার করে যেতে যেতে এক বছরে ঠিক যে দুরত্বে গিয়ে পোঁছাবে, সেই দুরত্ব। সে হিসাবে তা দাঁড়ায় প্রায় দশ ট্রিলিয়ন কিলোমিটার বা একশ কোটি কোটি কিলোমিটার।)) এরকম হাজার হাজার তারকা আমরা খালি চোখে দেখতে পাই ((প্রায় তিন হাজার তারা খালি চোখে আমরা সনাক্ত করতে পারি।))। আরও প্রায় অসংখ্য কোটি কোটি তারকা দেখতে পাইনা। সেগুলো দেখতে হয় দুরবীক্ষণযন্ত্র দিয়ে।ভাল মানের আধুনিক দুরবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে বিজ্ঞানীরা আকাশের আনাচে কানাচের অসংখ্য তারকা খুঁজে বেড়ান।
ওইযে সুদূর নিহারিকা : গ্যালাক্সি
প্রতিবেশী গ্যালাক্সি, এন্ড্রোমিডা , তারকা সংখ্যা বিচারে দানবীয় ছায়াপথগুলোর একটি।
আকাশের তারাগুলো আবার বিশাল বিশাল দল বেঁধে ছুটে বেড়ায়। এরকম একেকটি তারকাপুঞ্জকে বিজ্ঞানীরা বলেন গ্যালাক্সি বা নিহারিকা অথবা ছায়াপথ। যে সব তারকা অনেক দুরে সেগুলোকে অতি শক্তিশালী দুরবীক্ষণযন্ত্র দিয়েও আলাদা করা যায় না। তখন কেবল তাদের তারকাপুঞ্জ বা গ্যালাক্সিটাই দেখতে পাওয়া যায়। জ্যোতির্বিদগণ তখন আবার এই গ্যালাক্সিগুলোকে খুঁজে বের করেন। এদের সুন্দর সুন্দর সব নাম দেন। যেমন আমাদের সবচেয়ে কাছের গ্যালাক্সিটার নাম হলো এন্ড্রোমিডা।(কে বলেছে বিজ্ঞানীরা কবিতা বোঝেন না?) সেই ৯৬৪সালে আবিষ্কৃত ‘ছোট মেঘ’ নামে পরিচিত এই বস্তু, পরে গ্যালাক্সি হিসেবে আবিষ্কৃত হবার পর বিজ্ঞানী তার এই নাম দেন। পৃথিবী থেকে প্রায় ২৫লক্ষ আলোকবর্ষ দুরে অবস্থান এর । দেখতে সর্পিলাকার এই গ্যালাক্সিতে তারকার সংখ্যা ধারনা করুন তো একটু?
প্রায় এক লক্ষ কোটি ((এক ট্রিলিয়ন।))।
প্রায় এক লক্ষ কোটি ((এক ট্রিলিয়ন।))।
আমাদের হোম গ্যালাক্সি
নিজের মুখ দেখা নিজের আয়নায়। আমাদের নিজ ছায়াপথের (আকাশগঙ্গা) উজ্জ্বল কেন্দ্র। পৃথিবী থেকে দেখা।
স্বভাবতই ধারনা করা যায়, যে আমাদের কাছাকাছি তারকাগুলোসহ আমাদের এই সৌরজগৎ, ওই সুদুর গ্যালাক্সিগুলোর মতো, কোন এক গ্যালাক্সির ভেতর রয়েছে। সেই গ্যালাক্সির পেটের মধ্যে থেকে কি আমরা আমাদের সেই মাতৃ-গ্যালাক্সি দেখতে পারি? অবাক করা হলেও সত্যি, আমরা আমাদের গ্যালাক্সি টা দেখতে পারি। কারণ আমাদের নিজ গ্যালাক্সি হলো দেখতে ঠিক এনড্রোমিডার মত। চ্যাপ্টা চাকতির মত সর্পিলাকার এ গ্যালাক্সির কেন্দ্রে সবচেয়ে বেশী সংখ্যক এবং পুরোনো তারকাগুলোর আবাস। তাই এই অঞ্চলটা অধিক উজ্জল।
রাতের মেঘ মুক্ত আকাশে তাকালে মাঝ বরাবর আকাশের এই প্রান্ত থেকে ওই প্রান্ত পর্যন্ত, ঘোলাটে মেঘের মতো এক বলয় দেখা যায়। আদি-বিজ্ঞানীরা একে নাম দিয়েছিলেন, আকাশগঙ্গা। কিন্তু, এটা আসলে আমাদের নিজেদের গ্যালাক্সির মাঝের দিকের ঘন দৃশ্য ছাড়া আর কিছুই নয়।
আমাদের গ্যালাক্সির নাম তাই আকাশগঙ্গা।ইংরেজীতে মিল্কী-ওয়ে (দুধেল পথ)।
আমাদের গ্যালাক্সির নাম তাই আকাশগঙ্গা।ইংরেজীতে মিল্কী-ওয়ে (দুধেল পথ)।
যার মধ্যে রয়েছে প্রায় চল্লিশ হাজার কোটি তারকা। সূর্য হলো তার এক কোনে পড়ে থাকা একটি নগণ্য তারকা।
পুরো মিল্কীওয়ের মধ্যে আমাদের অবস্থান দেখানো যায় এভাবে-
পুরো মিল্কীওয়ের মধ্যে আমাদের অবস্থান দেখানো যায় এভাবে-
আমাদের নিজ ছায়াপথের একটা সিমুলেটেড চিত্র। আমাদের অবস্থান কেন্দ্র আর পরিধির মাঝামাঝি।
সমগ্র মহাবিশ্ব: সীমার মাঝে অসীম তুমি
একেকটা গ্যালাক্সি এত তারকা ধরে! নানা গ্যালাক্সির নানান আকার নানান আকৃতি। আকার ভেদে ছোট বামুন-গ্যালাক্সি গুলোতে এক কোটি থেকে শুরু করে দানবীয় গ্যালাক্সিগুলোতে এক ট্রিলিয়ন পর্যন্ত তারকা থাকতে পারে। এরকম ছোট বড় গ্যালাক্সি মিলে মোট দৃশ্যমান গ্যালাক্সির সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৭হাজার কোটি।গ্যালাক্সি গুলোর প্রতিটা তারার মধ্যে দুরত্বও বেশ কয়েক আলোকবর্ষের কম নয়। এজন্য গ্যালাক্সি গুলোর দুরত্বকেও যদি আলোকবর্ষে মাপতে যাই তবে দাঁড়ায় বিপত্তি। তাই দরকার আরো বড় একক।বিজ্ঞানীরা ব্যবহার করেন পারসেক ((প্রায় ৩.২৬ আলোকবর্ষ))।
এরকম একেকটা গ্যালাক্সীর ব্যাস দাঁড়ায় ১০০০থেকে শুরু করে ১লক্ষ পারসেক পর্যন্ত।প্রতিটা গ্যালাক্সীর মধ্যে দুরত্ব আবার হয় নিযুত পারসেক।
সমগ্র মহাবিশ্ব। একটা ধারনা চিত্র। এর কোন এক কোনে অবহেলায় পড়ে আছে আমাদের বিশাল ছায়াপথ। এখানে দেখানো হয়েছে কেন্দ্রে।
সবমিলিয়ে হিসাব করলে, ভাবতে ভয় লাগে, কত বিশাল আমাদের এই বিশ্বটা। বিজ্ঞানীদের নিখুঁততম হিসাবে এ বিশ্বের ব্যসার্ধ (আমাদেরকে কেন্দ্রে চিন্তা করলে) ধরা দিয়েছে প্রায় ১৪.৩ বিলিয়ন পারসেক ((প্রায় ৪৬ বিলিয়ন আলোকবর্ষ ।))।
যার মধ্যে তারকার সংখ্যা ধারনা করা হয় প্রায় ৩০ সেক্সিলিয়ন ((৩০এর পর একুশটা শূন্য)) থেকে ১ সেপ্টিলিয়ন ((১ এর পর চব্বিশটা শূন্য)) পর্যন্ত।এই যে বিশাল মহাবিশ্ব। এর শুরুটা কিন্তু অত বিশাল ছিল না। হয়েছে অতি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র এক মহাবিন্দু থেকে। এর গল্প শুনলে মাথা ঘুরে যাবে। শুধু কি তারা? আরো কত কী যে আছে! এসব ভাবতে ভাবতে যদি মাথা গরম হয়ে যায় তবে সঙ্গীত হলো মহৌষধ।
দেখুন না, রাতের আকাশের দিকে তাকিয়ে। গেয়ে উঠুন আপন মনে।
আজি যত তারা তব আকাশে
সবে মোর প্রাণ ভরি প্রকাশে॥
নিখিল তোমার এসেছে ছুটিয়া, মোর মাঝে আজি পড়েছে টুটিয়া হে,
তব নিকুঞ্জের মঞ্জরী যত আমারি অঙ্গে বিকাশে॥
দিকে দিগন্তে যত আনন্দ লভিয়াছে এক গভীর গন্ধ,
আমার চিত্তে মিলি একত্রে তোমার মন্দিরে উছাসে।
আজি কোনোখানে কারেও না জানি,
শুনিতে না পাই আজি কারো বাণী হে,
নিখিল নিশ্বাস আজি এ বক্ষে বাঁশরির সুরে বিলাসে॥ (( রবীন্দ্র সঙ্গীত: আজি যত তারা তব আকাশে।))
…
আজ এটুকুই থাকুক না , পড়তে থাকুন!! ((সকল ছবি কৃতজ্ঞতা: উইকিপিডিয়া))।
:angel_not: :guiter: :yahooo:
ওয়াও!!!!!!! চোখ বড় হতে হতে ইয়া বড় হয়ে যাচ্ছে। খালি চোখে তারা গুলো খুঁজে নিতে খুব ভাল লাগে। মাঝে মাঝে মহাকাশের, বিভিন্ন ছবি দেখি। কি যে সুন্দর দৃশ্য আছে। পুরো ঘোর লাগিয়ে দেয়! অনেক্ষন চিন্তা করতে করতে হঠাৎ ভয় ধরিয়ে দেয় যে, আমরা কতই না ছোট!
দারুণ লাগছে। :clappinghands:
পরের পর্বের অপেক্ষায় 😀
অসাধারণ অসাধারণ!!
আমার খুব প্রিয় একটা বিষয় হলো অ্যাস্ট্রোনমি। যতবারই ছবি দেখি, ততবার কেমন একটা শিহরণ হয় শরীর জুড়ে!
প্লিজ এটা কন্টিনিউ করবেন।
দারুণ, আরেকবার পড়তে হবে। :happy:
দারুন! :clappinghands:
অসাধারণ।
পরের পর্বের অপেক্ষায় আছি।