ঘুম ভাঙলে কাজলের চোখ খুলতে ইচ্ছে করে না। সকালের নীরবতা তার কাছে অনেক আপন মনে হয়। গায়ের উপর ছোট্ট হাতটা পড়তেই চোখ মেলে তাকালো কাজল। ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠলো এক চিলতে হাসি। সকালের মিষ্টি রোদ টিনের চালার ফাঁকা দিয়ে ঘরে এসে ঢুকেছে। এক টুকরো রোদের মধ্যে ধুলার কণাগুলো যেন আনন্দে নাচছে। পাশ ফিরে ছোট্ট হাতের মালিকের দিকে তাকালো কাজল। তার সাত বছরের মেয়ের দিকে তাকালে চোখ ফেরাতে ইচ্ছে করে না। বড় বড় চোখ, কী সুন্দর চুল হয়েছে এই বয়সেই। এত সুন্দর করে হাসে মেয়েটা! সারাদিন মায়ের আশেপাশে ঘুরঘুর না করলে ভালো লাগে না তানিয়ার। ঘুমের ঘোরেও যেমন জড়িয়ে ধরেছে মা-কে।
তানিয়ার ওই পাশে শুয়ে আছে শাহেদ। ছেলেটার বয়স ছয় হলো গত মাসে। পিঠাপিঠি ভাইবোন বলেই হয়তো সারাদিন দুই ভাইবোনের ঝগড়াঝাটি লেগেই থাকে। আবার একজন আরেকজনকে ছাড়া থাকতেও পারে না। ভারী দুষ্টু হয়েছে ছেলেটা। হয়তো মেয়েটা খুব শান্ত বলেই ছেলেটার দুষ্টুমী খুব একটা খারাপ লাগে না কাজলের।
তাড়াতাড়ি চোখ ফিরিয়ে নেয় কাজল। ছেলেমেয়েদের দিকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে হয় না মায়ের, অমঙ্গল হয়। তবুও বারবার ওদের দিকে তাকিয়ে থাকতেই ইচ্ছে হয়।
পাশের ঘরে শ্বাশুড়ির ঘুম ভেঙেছে টের পায় সে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিছানা থেকে উঠে যায় কাজল। ঘরের দরজা খুলতেই ঠান্ডা বাতাস এসে লাগে গায়ে। শরীরটা যেন জুড়িয়ে যায়। উঠানের মাচায় শিম গাছটা বেড়ে উঠেছে বেশ। ছোট্ট ছোট্ট শিম দেখা যাচ্ছে পাতার ফাঁকে ফাঁকে। সকালের রোদ পড়ে শিশির ভেজা গাছটা যেন ঝিলমিল করছে।
হাতমুখ ধুয়ে এসে চুলার পাশে বসে কাজল। সকালে চা না খেলে তার শ্বাশুড়ীর ভালো লাগে না। চা বানিয়ে তাকে দিয়ে আসে এক কাপ। এর মধ্যে শামীম ঘুম থেকে উঠে গেছে। তার নাস্তার ব্যবস্থা করতে করতেই বেজে যায় সাড়ে সাতটা। তাড়াতাড়ি খাওয়া দাওয়া করেই ছুট লাগায় শামীম। বেচারার অফিসটা বড্ড দূরে হয়ে গিয়েছে।
কাজল ছেলেমেয়েদের ঘুম থেকে ডেকে তুলে এবার। স্কুলে পাঠাতে যে কী কষ্ট করতে হয় এদের। একজনও স্কুলে যেতে চায় না। ঘুম থেকে তুলে হাতমুখ ধুইয়ে, নাস্তা খাইয়ে স্কুলে পাঠাতে পাঠাতে নয়টা বেজে যায়।
শহরের এক প্রান্তের নদীর ওপারে বাসা কাজলদের। ঘর থেকে বের হয়ে দুই মিনিট হাঁটলেই নদী। বড্ড ভালো লাগে তার। নদীর তীরে এসে বসে থাকলেই অন্যরকম আনন্দ হয়। শীত চলে আসায় নদীর জল কমে এসেছে অনেক। বর্ষায় এই নদীর পানিই যে তার ঘরে ঢুকে যায় কে বলবে! কিছুদিন আগেও কাশফুলে ভরে গিয়েছিল নদীর পার। এখন অবশ্য খা-খা করছে নদীর তীর। মাঝে মাঝে ছেলেমেয়েকে এখানে গোসল করাতে নিয়ে আসে সে। ওরা সাতার জানে না, কিন্তু কোমর পানিতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নদীতে গোসল করতে খুব পছন্দ করে।
একটু নদীর পাড়ে থেকে হেঁটেই তাড়াতাড়ি ঘরে ফিরলো কাজল। বেশী দেরী হলে তার শ্বাশুড়ি আবার রাগ করবেন।
ছেলেমেয়েরা স্কুলে থাকলে সময়টা কেমন যেন কাটতে চায় না। ওদের হাসিমাখা মুখ, দুষ্টুমী, উঠানে দৌড়ানো- এ সব ছাড়া বাড়িটা অনেক ফাঁকা মনে হয়। কাজল মনে মনে ভাবতে থাকে কখন দেড়টা বাজবে। উঠোনে মা বলে চিৎকার দিতে দিতে ঘরে ঢুকবে ছেলেমেয়েরা। এসেই সারাদিনের গল্পের ঝুলি খুলে বসবে ওদের মা-র কাছে।
দু’টা বাজে।
স্কুল থেকেই এসে তানিয়া আর শাহেদ এসে বসেছিল তাদের মা-র কাছে। হাতপাখাটা নিয়ে কিছুক্ষণ ওদের বাতাস করে কাজল। গোসল করতে যেতে বলে বারবার। দুপুর হয়ে গিয়েছে, কখন গোসল করবে আর কখন খাবে। ওদের আজকে এক কথা, নদীতে যাবে গোসল করতে। হাতের কাজ শেষ হয়নি কাজলের। তার শ্বাশুড়িই তখন ওদের দু’জনকে নিয়ে গেলেন নদীর দিকে।
ওরা চলে যেতেই খাবার গোছাতে বসলো কাজল। আজকে পোলাও রান্না করেছে। বাচ্চাগুলো পোলাও খেতে ভীষণ পছন্দ করে।
মিনিট দশেক পরেই হঠাৎ অনেক মানুষের চিৎকার শুনে আত্মা কেঁপে উঠে তার। দৌড়ে ঘরের দরজার দিকে ছুটে যায় সে। সামনের দিকে কিছুক্ষণ নীরবে তাকিয়ে থাকে, তারপরই মাথা ঘুরে পরে যায় কাজল।
চার বছর পর
ঘুম ভাঙলে কাজলের চোখ খুলতে ইচ্ছে করে না। সকালের নীরবতা তার কাছে অনেক আপন মনে হয়। গায়ের উপর ছোট্ট হাতটা পড়তেই চোখ মেলে তাকালো কাজল। ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠলো এক চিলতে হাসি। সকালের মিষ্টি রোদ টিনের চালার ফাঁকা দিয়ে ঘরে এসে ঢুকেছে। এক টুকরো রোদের মধ্যে ধুলার কণাগুলো যেন আনন্দে নাচছে। পাশ ফিরে ছোট্ট হাতের মালিকের দিকে তাকালো কাজল।
তার দুই বছরের মেয়ে কণা ঘুমের ঘোরেই হাত তুলে দিয়েছে তার গায়ে। কাজল আরেক পাশে শুয়ে থাকা ছেলেটার মুখে ফিডার দিয়ে দিলো। এগারো মাস হয়েছে বাবু-র। রাতে কয়েকবার উঠে খাওয়াতে হয় ওকে। ছেলেমেয়ের উপর থেকে চোখ ফেরাতে ইচ্ছে করে না কাজলের।
সেই আগের মতো শীত এসেছে আবার। উঠানের মাচায় শিম গাছটা বেড়ে উঠেছে বেশ। ছোট্ট ছোট্ট শিম দেখা যাচ্ছে পাতার ফাঁকে ফাঁকে। সকালের রোদ পড়ে শিশির ভেজা গাছটা যেন ঝিলমিল করছে।
সকাল দশটার দিকে ফোন আসে কাজলের কাছে, তার দূর সম্পর্কের ভাইয়ের মেয়েটা আসবে তার বাসায়। এখানে আসেনি কখনো, তাই ঠিকানা জানতে ফোন দিয়েছে। তার বাসায় কেউ আসতে চাইলেই তাকে ঠিকানা বলতে হয় এভাবে ফোনে। সবসময়ের মতো বলে চলে সে, “মোহাম্মদপুরে আসবা। এসে একটা সিএনজি নিবা। বলবা, ওয়াশপুর ব্রিজের ওই পাড়ে যাবা। ব্রিজ থেকে নেমেই হাতের ডানে প্রথম রাস্তায় ঢুকবা। ওইখানে কাউকে জিজ্ঞেস করবা, শামীম ভাইদের বাড়ি কোনটা? তাহলেই দেখায় দিবে।”
একটু থেমে আবার বলে সে, “আর যদি না চিনে তাইলে বলবা, ওই যে যেই বাড়ির দুই ভাইবোন নদীতে ডুবে মরে গেসে, সেই বাড়ি। সবাই চিনবে এইটা বললে।”
ফোনটা রেখে চোখের পানি মোছে কাজল। এতোদিন হয়ে গেল, তবু চোখের নদীটা শুকায় না।
[একটি বাস্তব গল্প অবলম্বনে লেখা……]
তোর লিখাটা পড়া শুরু করেই বুঝলাম কষ্ট পেতে হবে, তবু দুর্দান্ত নিষেধাজ্ঞাটা দূরে ঠেলে রেখে পড়লাম, আর সবকিছু হঠাৎ করে খুব চুপ হয়ে গেলো……
তবু একটা কথা, গল্পটাকে কি জোর করে ছোট করে দিলি?? 🙁
এই গল্পটা লিখতে কেমন যেন অসহায় লাগছিল। মনে হচ্ছিলো যেই চোখ ছলছল মা-কে তার ছেলেমেয়ের ছবির দিকে তাকাতে দেখেছি, তার অনূভুতি কলমে নিয়ে আসতে পারবো না। কোন শব্দই হয়তো সেই মূহুর্তকে ফুটিয়ে তুলতে পারবে না……
সে জন্যই গল্পটা ছোট হয়ে গেল বোধ হয়……… 🙁
🙁
🙁
উফ্, লেখাটা এত সুন্দর হয়েছে, কাহিনীটা সত্যি কেন হল? 🙁
🙁
ধন্যবাদ 🙂
খুব ভালো লাগলো ।
ধন্যবাদ 🙂
এই কাহিনীটা আর যেনো পুনরায় সত্যি না হয়। 🙁
সেটাই আশা করি……
দারুণ গল্প!
অনেক পরিণত হাতের লেখা! অনেক পরিণত! :huzur:
সত্য কাহিনী হওয়ায় বেশি খারাপ লাগছে
ধন্যবাদ :happy:
ঘটনা শুনে আমারো অনেক মন খারাপ হয়েছে………… 🙁
সত্য ঘটনা অবলম্বনে লেখা গল্পগুলোর বেশিরভাগই এরকম ট্র্যাজিক থাকে কেন???
এই জগত সংসারে কি হাসি-আনন্দ-উচ্ছলতার কোন জায়গা নেই???
সত্য আনন্দের ঘটনা নাড়া দেয় না। কিন্তু, দুঃখের ঘটনা মনে থাকে অনেকদিন………
লুকোনোর কিছু নেই, দীর্ঘশ্বাসটা আটকানো গেলো না! 🙁
দীর্ঘশ্বাস লুকানো যায় না……… 🙁
পুনরায় যেন আর কোন মায়ের চোখ নদীতে পরিণত না হয় এই কামনা করি।
অনেক ভালো লাগলো গল্পটি।
“আর কোন মায়ের চোখ নদীতে পরিণত না হয় এই কামনা করি। ”
আমিও………
ধন্যবাদ 🙂