কিছুই না হতে পারি, কখনই যেন “মানুষ” নামে নিজেকে পরিচয় দিতে লজ্জা বোধ না করি…

খুবই ছোট একটা লেখা লিখব… খুবই ছোট।কিন্তু মনের কষ্টগুলোকে সবাইকে জানাতে ইচ্ছে করছে।

মা এবং বাবা… শব্দদুটো একটা মানুষের জন্মের পর থেকেই সবচেয়ে প্রিয় দুটো শব্দ।
পৃথিবীর তাবৎ প্রাণীজাতির মধ্যে মানুষ বোধহয় সেই গুটিকয়েক প্রাণীর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত, জন্মের পরই যাকে পেতে হয় নিবিড় যত্ন। অনেক অনেকদিন পর্যন্ত তাকে অন্য আর মানুষগুলোর উপর ভরসা করে থাকতে হয়… তাকে মানুষ করা হয়… মানুষের মত মানুষ হওয়ার প্রেরণা থেকেই।

আর এইসব কিছুই হয় ভালবাসা থেকে। সত্যিকারের ভালবাসা। মা বাবার দেয়া সেই ভালবাসার সাথে আর কোন কিছুরই তুলনা চলে না,চলতে পারেনা।

জীবনের সবটুকু অর্জনকে যেই মানুষদুটো শুধুমাত্র তাদের সন্তানদের পিছনে ব্যয় করে দেয়, সেখানে আমরা কি করি তাদের জন্য? তাদের চাওয়াটাই বা কতটুকু?

মানুষ নাকি বৃদ্ধ বয়সে এসে আবার বাচ্চাটা হয়ে যায়। বিধাতার কি অপূর্ব খেলা!! আমাদের আবার সেই একই বৃত্তে এসে শেষ করতে হয় জীবনটাকে। ফিরে যেতে হয় অজানা এক দেশে।

হাসপাতালে প্রতিদিন হাজাররকম মানুষের সাথে পরিচয় হয়… হাজাররকম গল্প তাদের, হাজাররকম দুঃখ…

কিন্ত ওইদিন যে কষ্টটা পেলাম, আর কখনই পাইনি…

ওয়ার্ডে যাচ্ছিলাম। এক প্রায় ৮০ ছুঁইছুঁই বৃদ্ধার সাথে দেখা। একা একা মিটফোর্ডের সার্জারি বিল্ডিঙের সামনে দাঁড়িয়ে সবাইকে ডাকছেন… হাত বাড়িয়ে ছুঁতে চেষ্টা করার তাঁর যে মর্মান্তিক আকুতি, আমি অগ্রাহ্য করতে পারলাম না।

মানুষটা একা একাই কেঁদে চলেছেন। বরাবরের মতই আমরা যারা  নিজেদের দায়বদ্ধতা বিসর্জন দিয়ে দেইনি, তারা দাঁড়িয়ে যাই। রোগেশোকে কষ্ট পেয়ে একবুক দীর্ঘশ্বাস নদীতে ভেসে যাওয়া মানুষগুলোকে সাহায্য করার চেষ্টা করি।

বৃদ্ধা কানে শোনেন না। তাই যখন প্রেসক্রিপশনটা তাঁর কাছে চাইলাম, প্রথমে বুঝতেই পারলেন না।

জিজ্ঞেস করলাম, “মা, আপনার সমস্যাটা আমাকে বলবেন?”

ওষুধ পাননি তিনি। এমনিতে সরকারি হাসপাতালে সাধারণ ওষুধগুলো এমনি এমনি ষ্টোরে পাওয়ার কথা। কিন্তু বৃদ্ধার কপাল খারাপ। একটা ওষুধ জুটলেও আরেকটা তখন ষ্টোরে মজুদ নেই।

এরপরে যে কথাটা শুনলাম, আমার চোখে একেবারে পানি চলে আসল। এই অশীতিপর নারীটির কাছে মাত্র ছাব্বিশ টাকা দামের এক অতিসাধারণ ওষুধ কিনে খাওয়ার সামর্থ্য নাই!

খুব অবাক লাগল। এত বুড়ো একজন মানুষ, তাঁর এখন প্রয়োজন নিয়মিত যত্ন, ভাল বিশ্রাম, খাওয়াদাওয়া আর সময়মত ওষুধপত্র। অথচ জীবনের এক অতি করুণ পরিহাসে এই বৃদ্ধাকে এখন এই ২৬ টাকার ওষুধের জন্যও মানুষের কাছে কেঁদে মরতে হচ্ছে!!

ছেলেমেয়ে থেকেও নেই মানুষটির। প্রচণ্ড এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে বৃদ্ধা আমাকে শোনান তাঁর না বলা কাহিনি। কিছুই বলতে পারিনি তখন। দোকানে গিয়ে ওষুধটা কিনে দিলাম।

আমরা যে মানুষ, মাঝে মাঝে খুব অবাক লাগে। মানুষ হিসেবে মনুষ্যত্বের পরিচয় দিতে আমরা বরাবরই ব্যর্থ হই। আমরা চোখ বন্ধ করে ফেলি, পাছে খারাপ কিছু চোখে পড়ে যায়। কান দুই হাতে ঢেকে ফেলি, যদি খারাপ কোন কথা কানে চলে আসে!!

দুপুর থেকেই বৃদ্ধার ওই একটা কথাই আমার কানে বাজছে, “এত বড় দুনিয়ায় কেউ থেকেও নেই আমার মা।”

কয়টা টাকার ওষুধটা দিয়ে দেয়ার  বিনিময়ে আজকে এই নারীর কাছে যে আদরটা পেলাম, কখনই ভুলব না।

জানিনা কেমন ডাক্তার হব। কিন্তু মনে প্রাণে চাই… কিছুই না হতে পারি, কখনই যেন “মানুষ” নামে নিজেকে পরিচয় দিতে লজ্জা বোধ না করি…

এই লেখাটি পোস্ট করা হয়েছে সচেতনতা-এ। স্থায়ী লিংক বুকমার্ক করুন।

10 Responses to কিছুই না হতে পারি, কখনই যেন “মানুষ” নামে নিজেকে পরিচয় দিতে লজ্জা বোধ না করি…

  1. অবন্তিকা বলেছেনঃ

    মন খারাপ হয়ে গেলো। 🙁
    আপি, শিরোনামটা খুব ভালো লাগছে।

  2. স্বপ্ন বিলাস বলেছেনঃ

    খুব দুঃখ লাগে এমন ঘটনা দেখলে। কিন্তু, এমন ঘটনা এতো বেড়ে গেছে, শুধু ভাবি, মানুষ এমনভাবে বাবা-মা র অবদান ভুলে যায় কীভাবে?!!

    “কিন্তু মনে প্রাণে চাই… কিছুই না হতে পারি, কখনই যেন “মানুষ” নামে নিজেকে পরিচয় দিতে লজ্জা বোধ না করি…” :clappinghands:

    • নীল রঙ পরী বলেছেনঃ

      প্রায় প্রতিদিনই এমন ঘটনা চোখের সামনে ঘটতে দেখি।

      আজকাল মৃত্যুকেও এতোটা কষ্টকর মনে হয় না, মনে হয় এই অসহায় মানুষগুলোর চোখের পানিকে।

      বৃদ্ধমানুষগুলো নিজের সবকিছু বিসর্জন দিয়ে সন্তানগুলোকে মানুষ করতে চেষ্টা করেন… আফসোস, তারা মানুষ নামের কলঙ্ক হয়ে বড় হয়।

      এমন ঘটনা যেন আর না দেখতে হয়, সেই কামনা করি।

  3. বোহেমিয়ান বলেছেনঃ

    খুবই ভালো লেগেছে লেখাটা আপু।

    আপনার আশা পূরণ হোক।

    • নীল রঙ পরী বলেছেনঃ

      ভাইয়া, আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ…
      খুবই মন খারাপ থেকে লেখাটা লিখেছি… নিজেকে খুব অসহায় লাগছিল সেদিন…

      আমাদের এই কথোপকথন প্রায় অনেকগুলো মানুষ শুনেছে… আশ্চর্য হচ্ছে ,কেউ ওই মাকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসেনি।
      আমরা আধুনিক হচ্ছি, সেইসাথে আরও বর্বর হচ্ছি। আমাদের যেন বিধাতা খুব তাড়াতাড়ি এই অবস্থা থেকে উদ্ধার করে কেবল সেই আশাই করতে পারি।

  4. অক্ষর বলেছেনঃ

    আপু সত্যিই অসাধারণ একটা লেখা,
    ” জানিনা কেমন ডাক্তার হব। কিন্তু মনে প্রাণে চাই… কিছুই না হতে পারি, কখনই যেন “মানুষ” নামে নিজেকে পরিচয় দিতে লজ্জা বোধ না করি…”

    আমাদের সবার মাঝে যদি এই বোধটা আসত !! 🙁

  5. সাথী বলেছেনঃ

    খুবি ভালো লাগল লিখাটা।
    “জীবনের সবটুকু অর্জনকে যেই মানুষদুটো শুধুমাত্র তাদের সন্তানদের পিছনে ব্যয় করে দেয়, সেখানে আমরা কি করি তাদের জন্য? তাদের চাওয়াটাই বা কতটুকু?”
    আপনার এই কথার মর্ম যাতে সবাই বুঝতে পারে। কেউ যাতে তার মা-বাবার অবদান ভুলে না যায় আর মা-বাবার প্রতি দায়িত্ব টুকু যাতে অন্তত পালন করে।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।