ছোট্ট একটা শহর।
শহরের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীটাও ছোট।
জানালা দিয়ে তাকালে চোখে পড়ে ছোট্ট একটা চৌকো আকাশ।
কিন্তু সে তুলনায় বড্ড ঘিঞ্জি, আর ব্যস্ত শহরটা।
শহরের আকাশে যতক্ষণ আলোর গোল চাকতিটা দেখা যায়, রাস্তায় ছুটে চলা যন্ত্রদানবগুলো পাঁয়তারা করে কীভাবে ওটাকে কালো ধোঁয়ায় বেশ করে ঢেকেঢুকে দেয়া যায়।
আর সে রাস্তা ধরে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে চলা মানুষগুলোর জীবন চালাতে গিয়ে আর সে হতচ্ছাড়া জীবনটার মানে খুঁজে বের করার ফুরসত মেলে না।
তারপর, একসময় দানবগুলোর সাধ মেটাতেই হয়তো, আলোর চাকতিটা কোথায় যেন টুপ করে লুকিয়ে পড়ে, আর আকাশটা নিজেকে মুড়ে নেয় কালো চাদরে।
তখন একদল মানুষ ব্যস্তসমস্ত হয়ে ঘরে ফেরে, সবাই না অবশ্য, যাদের ঘরে সান্ধ্য আইন জারি আছে, তারা শুধু।
রাত যত বাড়ে, রাস্তাগুলোর জটলা ততই কমতে থাকে, ভরে ওঠে ছোট ছোট ঘরগুলো। শেষে একসময় যখন একে একে বাতিগুলো সব নিভে যেতে শুরু করে, তখনই শুরু হয় আমাদের গল্পের।
ঐ দূরে যে ঘরটাতে এখনো আলো নেভে নি, ওখানে টেবিল-চেয়ারে বসে মগ্ন হয়ে পড়ছে এক ছেলে। কাল পরীক্ষা ওর।
পাশের বস্তিতেই তখন দু’মাসের বাচ্চাটার কান্না থামাতে ব্যস্ত এক মা। ছেঁড়া কাপড়টা দিয়ে ওর শীত কমানোর চেষ্টা করছে সে।
দূরে কোথাও অনবরত ডেকে চলেছে একটা কুকুর, রোজই ডাকে।
ওহ্হ্, আর ঐ যে গানের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে, ঐ লোকটা প্রতিরাতেই ছাদে বসে গান ধরে, সুখভর্তি বোতলটা থাকে সাথে। ওর বৌ-বাচ্চা তখন ঘরে গভীর ঘুমে অচেতন।
ঠিক তখনি খটমটে বাঁধানো ফুটপাথে পাশ ফিরে শোয় হাড্ডিসার ক্ষয়ে যাওয়া শরীরটা। ওর ঘুমও গভীর, সারাদিন খাটুনি তো কম যায়নি!
ও বাড়ির ছোট্ট মেয়েটা এখন বালিশে মুখ গুঁজে সমানে কেঁদে চলেছে। না পারছে চোখের পানি আটকাতে, না পারছে শব্দ করে কাঁদতে, পাশে ঘুমিয়ে থাকা দাদুটা যদি টের পেয়ে যায়! আমার কী দোষ, গাল ফুলিয়ে ভাবে মেয়েটা, আমি যাদের ভালবাসি তারা সব এমন হয়ে যায় কেন? ওর আবার বড্ড অভিমান!
পাশের ফ্ল্যাটের চল্লিশোর্ধ্ব প্রফেসরেরও ঘুম আসছে না তখন। ঘুমন্ত স্ত্রীর পাশে শুয়ে এপাশ-ওপাশ করছেন, ক্ষণিকের তন্দ্রায় চোখ একটু বুজে এলেই মনে পড়ে যাচ্ছে ক্লাসে আসা নতুন মেয়েটার কথা। আহা, মুখটা বড্ড…
রাতজাগা পাখিটা তখনো একই স্বরে ডেকে চলছে। প্রতিদিন এ সময়েই কী যেন হয় ওর।
নয়তলার ওপরে তখন গণকযন্ত্রের সামনে বসে আছে সদ্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢোকা ছেলেটা। ওর চঞ্চল চোখ দুটো এখন নিষিদ্ধ আনন্দ উপভোগে ব্যস্ত।
তাহাজ্জুদের নামাজ পড়তে ওঠা এক বাবা একটা বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে; স্তব্ধ, চুপচাপ। ওপাশে ফিসফিস শব্দ, চাপা খিলখিল হাসির আওয়াজ। কড়া নাড়তে গিয়েও হাত নামিয়ে নিয়ে আস্তে আস্তে ফিরে আসলেন তিনি ক্লান্ত পায়ে। মেয়েটার যে কী হবে, দীর্ঘশ্বাস পড়লো একটা।
রাস্তা দিয়ে হঠাৎ হুড়োহুড়ি করে দৌড়ে যাওয়ার শব্দ। আরেকটা ছিনতাই হল বোধহয়।
শালটা গায়ে জড়িয়ে হোস্টেল থেকে বেরিয়ে গেলো একটা ছেলে। নাহ্, আজ রাতে আর ঘুম হবে না। সিগারেটে সুখটান দিয়ে গান ধরলো ও। হাঁটতে হাঁটতে কতদূর যে চলে এলো…জীবনটাকে বড় শূন্য আর একঘেয়ে লাগে হঠাৎ।
তখন জানালায় ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে ডুবে যাওয়া চাঁদটার কথা ভাবে এক নৈরাশ্যবাদী, সাথে নিজের বদলে যাওয়া জীবনটার কথা। নাহ্, জীবনটা অত খারাপ না!
আস্তে আস্তে জ্বলে থাকা বাতিগুলোও নিভতে শুরু করে একটু পর, আর ছোট এই শহর তার গল্পে ভরা শরীরটাকে নিয়ে নিকষ আঁধারে ডুবে যায়।
ঘুম ঘুম এই ব্যস্ত শহরটা নীরবতার আড়ালেও তার মুখরতা হারায় না।
[লেখাটা আগে সামহোয়্যারইন ব্লগে প্রকাশিত হয়েছিলো:((http://www.somewhereinblog.net/blog/sm0019/29297810))
আমার একটা স্বপ্ন, সারা রাত রাস্তায় হাঁটব!
একলা, হাতে একটা ক্যামেরা!
স্বপ্নের সমস্যা এইখানেই! ক্যাম্রা টা ছিনতাই হবে!!!
এই ভয়ে আর স্বপ্ন নিয়ে আগাইতে পারি না।
লেখাটা অনেক ভালো লাগছে
ভাইয়া আমারও তবে সেখানে ক্যামেরা ছিল না, আর কয়েক দিন আগেই আমি সারা রাত হেটে কাটিয়েছি, তবে সাথে ২ বন্ধু ও ছিল, একদিন একা হাঁটার খুব ইচ্ছা :beerdrink:
স্বপ্নটাও অনেক ভালো লাগছে। 🙂
ঘুম ঘুম শহরের বড় বিষন্ন ও অনেকটাই নেতিবাচক ছবি আঁকলেন? অথচ সারাদিনের কাজের পর বিশ্রামের মতো ভাল বিষয় আর কি থাকতে পারে?
বেশি নেতিবাচক হয়ে গেছে? আপনি বলার পর খেয়াল করলাম।
রাতের শহরের সুন্দর দিকগুলি নিয়েও হয়তো লিখবো একদিন। 🙂
পড়ার জন্য ধন্যবাদ।
আপি আপি আপি, অনেক অনেক অনেক বেশি ভাল লাগল :babymonkey:
অনেক অনেক অনেক ধন্যবাদ অক্ষর! 😀
এই ব্যস্ত শহর ছেড়ে দূরে কোথাও হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করে। যেখানে মাথার উপর এক আকাশ ভরা তারা থাকবে। আমি তারা গুণতে গুণতে একসময় টের পাবো আকাশটা অনেকখানি কাছে নেমে এসছে, যেন হাত বাড়ালেই স্পর্শ পাওয়া যাবে!
ঘুম ঘুম এই ব্যস্ত শহরে আমি আজও একা একা এমন স্বপ্ন বুনে যাই।
দিন দিন আরো ব্যস্তই হচ্ছে শহরটা। 🙁
এইজন্যই এই শহরটা ছেড়ে দূরে কোথাও পালিয়ে যাবার ইচ্ছেটা দিনকে দিনই বাড়ছে আমার! 🙁
আমরা চলে গেলে শহরটা তো পালটাবে না আর আপু! 🙁
পুরোটা জুড়ে একটা সাধারণ চিৎকার শুনলাম বলে মনে হল…নির্লিপ্ততা! সবচেয়ে সরব এবং সর্বত্র! স্থিতি জড়তায় আটকে থাকা বাতাস রাতের মায়ায় বিদ্রোহী হতে পারে না…সে ক্ষমতা আজ লুপ্ত। 🙁
🙁
অনেক সুন্দর মন্তব্যটার জন্য ধন্যবাদ।
স্রেফ অসাধারণ! মুগ্ধ হয়ে গিয়েছি পড়ে! :clappinghands:
ধন্যবাদ ভাইয়া! 😀