– এই টুনি! কী করিস?
– লালটুকে খাবার দিই মা!
– কী! তুই আবার এই কুকুর নিয়ে পড়ছিস? তোকে না কতবার বলেছি কুকুরের ধারেকাছ যাবি না ? নাপাক জীব!
দৌড়ে ঘরে ঢোকে আট বছরের ফুটফুটে মেয়ে টুনি। শুয়ে থাকা মার পাশে এসে দাঁড়ায়।
– মা,আমি তো ধরি নাই,খালি খাবার দিয়েছি!
– তবুও! কামড়ে দিলে? কুকুর ভালো না!
– লালটুর পেটে যে বাচ্চা আছে মা, তাই একটু বেশি খাবার লাগে তো
– আহারে আমার দরদী! আমার পেটেও যে বাচ্চা,আমার খাবারর দিকে খেয়াল আছে মেয়ের? সারাদিন খালি কুকুর নিয়ে চিন্তা!
গাল ফুলিয়ে বসে পড়ল টুনি।
– মা,সারাদিন তো বাইরে ঘুরলে কিছু বল না, শুধু লালটুর কাছে গেলেই তোমার যত কথা! ওর বাচ্চাগুলো হোক, তারপর আর আমাকে ওর দরকার হবে না!
দীর্ঘশ্বাস ফেলে সুলতানা। ছোটবেলা থেকেই কুকুর দেখতে পারে না সে। কেমন যেন ঘেন্না হয়। এসব নোংরা জীব মানুষ ধরে? আর এই দেশে মানুষই খাবার পায় না,আবার কুকুর!
সুলতানার স্বামী রহমান মিয়া ঘরে ফেরে।
– সুলতানা,দেশের অবস্থা তো ভালো না। যুদ্ধ তো চলছেই, আবার শুনলাম পাকবাহিনী নাকি গ্রামের ঠিক বাইরে ক্যাম্প করেছে। আবার তোমারও তো বাচ্চা হবার সময় ঘনিয়ে এলো…কী করা যায়?
– চল,ডাক্তার তো দেখা করতে বলছিল। কালকে একবার যাই।
– আচ্ছা,সকাল সকাল উইঠো।
গভীর রাতে কুকুরের ডাক আর দরজা ভাঙার শব্দে জেগে ওঠে সুলতানা। টর্চের উজ্জ্বল আলোয় চোখ যেন অন্ধ হয়ে যায় তার।
দশ মিনিট পর।
উন্মত্ত পাক বাহিনী পরিবেষ্টিত অবস্থায় উঠানে দাঁড়িয়ে সুলতানা। একটু আগে তার স্বামীকে বিছানাতে গুলি করে মারা হয়েছে। ইচ্ছাকৃত টার্গেট মিসের ফলে প্রথম গুলিটা অবশ্য ছোট্ট টুনির নরম শুভ্র কপাল ভেদ করে বীভৎস সুঁই এর মত ঢুকে যায়। দুটো রক্তাক্ত মৃতদেহের মাঝে ফুর্তি করতে অনিচ্ছুক হওয়াতেই বোধহয়, পাক সেনারা তাকে উঠানে ধরে নিয়ে এসেছে।
পেটে হাত বুলিয়ে বাচ্চাটাকে অনুভব করার চেষ্টা করে সুলতানা। ঘরের ভেতরে কিছু অনুভূতি মৃত হয়ে পড়ে আছে, ওগুলো মৃতদেহগুলোর মতই শীতল, তার তুলনায় এই অনুভূতিটা অনেক বেশি জীবন্ত এখন পর্যন্ত।
না আসা এই শিশুটির চোখ আর কখনো ফুটবে না, দেখবে না সে এই রাতের আকাশের বৃত্তাকার চাঁদ, বাড়ির পাশের ভয়ঙ্কর সুন্দরী মেঘনা নদী, এই পরিচ্ছন্ন উঠোন, কিংবা ঘেউ ঘেউ করতে করতে ছুটে আসা গৃহপালিত কুকুরটি…কী যেন নাম ওর… ওহ,লালটু!
মাদী কুকুরটি অসম্ভব ক্ষিপ্রতায় ছুটে এসে সুলতানার বাম বাহু ধরে থাকা পাক সেনাটির পায়ে কামড় বসাতে উদ্যত হয়। পাশ থেকে আরেকজন গুলি করতে গিয়েও থেমে যায়, খেয়াল করে তাকাতেই সে বুঝে যায়, কুকুরটির পেট বাচ্চা।
সর্বশক্তি দিয়ে কুকুরটির পেটে লাথি চালায় সে। গর্জন করতে থাকা মাদী কুকুরটি ‘কুঁই’ করে একটা শব্দ করে শুধু, তারপর নিশ্চুপ। দুটো বুলেট তার কপাল ভেদ করে তাকে মুক্তি দেয় সকল প্রকার যন্ত্রণার হাত থেকে, ঠিক যেমন করে তার অনাগত বংশধরদের মুক্তি দেওয়া হয়েছে এই গ্রহের দূষিত যন্ত্রণা থেকে…আসার আগেই!
এক কী দুই ঘণ্টা পর শেষ পাকসেনাটি যখন সুলতানার ওপর অত্যাচার শেষ করে তাকে উঠানেই ফেলে যায়, তখন তার বাকি অনুভূতিগুলোও লাশকাটা ঘরের পথযাত্রী। ‘মানুষ’গুলো ওর পেটে পালাক্রমে লাথি চালিয়েছে, স্বর্গীয় সুখ কেউ ছাড়েনি! যেসব প্রাণীকে সে প্রতিদিন চোখের সামনে দেখত তাদের মধ্যে ও আগে কুকুরকে ভাবত সবচেয়ে নোংরা ও হিংস্র প্রাণী…ওই তো, ওর পাশেই পড়ে আছে মা হতে যাওয়া কুকুরটির ফোলা দেহ-চোখগুলোতে জীবনের বদলে রাতের আকাশের তারার আলো প্রতিফলিত হচ্ছে।
হাত বাড়িয়ে লালটুর পেট স্পর্শ করে সুলতানা। জীবনের শেষ মুহূর্তে এসে প্রথমবারের মত সে কুকুর স্পর্শ করল, যে প্রাণীটিকে সে সবচেয়ে বেশি ঘৃণা করত…গত এক কী দুই ঘণ্টায় যে জীবগুলোর চামড়া তার নিজের চামড়া ছুঁয়েছে, তার চেয়ে এই কুকুরটির চামড়া অনেক বেশি পবিত্র মনে হল তার কাছে…অনেক বেশি আপন।
পরস্পরকে স্পর্শ করে থাকা দুটি মা (একটি মানুষ এবং একটি কুকুর) এর মৃতদেহ পরদিন সকালে যারা আবিষ্কার করে, তাদের পক্ষে কোনদিনও জানা সম্ভব ছিল না মৃত্যুর আগে কত অদ্ভুত মমতায় মানুষ মা ছুঁয়ে দিয়েছিল মা কুকুরটির পেট।
এই সব লেখায় ইমো দেয়ার জো নেই।
অনেক ভালো লেগেছে
🙁
ভালো লাগলো……
হুম! 🙁
ভয়ংকর একটা লেখা!
এইভাবে আমি চিন্তাও করি নি কখনো!
তুই পারিস কেমন করে?
পু, পশুপাখি আর মানুষলে এক কাতারে নামানো হয়েছিল…আসলে জীব তো, ওদের কষ্টটাই বা হালকা করে দেখি কীভাবে? ওরাও অই গৃহবধূদের মত নিষ্পাপ ছিল… কিংবা অনাগত সত্তাগুলো …যাদের কষ্টের কথা এ জনমে জানা হবে না আমাদের!
লেখাটা প্রথমবার পড়ে স্তব্ধ হয়ে বসে ছিলাম, মন্তব্য করবার মতো ক্ষমতা, কিংবা যোগ্যতা কোনটাই বুঝি নেই, অদ্ভুত একটা ভালোলাগার অনুভূতি কাজ করে জানিস, যখন দেখি, আমাদের ইতিহাসটা মুছে যেতে যেতেও যায় নি, শুধু তোদের ভালোবাসায়, অবাধ্য জেদের কারণে……বেঁচে থাক তোরা, বেঁচে থাক তোদের স্বপ্ন আর ভালোবাসা, এই দেশটা বড়ো অভাগা রে……আমরা কতটুকু প্রাপ্য তাঁকে দিয়েছি জানিনা, শুধু বিশ্বাস রাখি, একদিন পারবো…
ভাইয়া, ৩০ লক্ষ কথাটা মুখে উচ্চারণ যেমন অনেক সহজ,বাস্তবটা অন্যরকম ছিল তা বলে দিতে হয়না। ৩০ লক্ষ মানুষের মৃত্যু ….শুধু একটি কারণে, সাথে অগণিত অনুভূতির লাশকাটা ঘরে স্থানান্তর…আত্মাগুলো সহজে রেহাই দেবে না! যে পতাকা তাঁরা এনেছেন, আপনারা বহন করে চলেছেন, তাকে আরো উঁচু করে তুলে ধরতে চাই… দৃষ্টিসীমার মধ্যেই!
আর ইতিহাস নিজের যোগ্যতায়ই টিকে থাকে…আমরা তার টিকে থাকার হাতিয়ার মাত্র!
ওহ্হ্। কী ভয়ানক। আর লেখাটা, অনেক ভাল হয়েছে।
শেষ মুহূর্তের অদ্ভুত অনুভূতিগুলো অগোচরেই রয়ে যায়… ভয়ানক বলেই হয়তো!
🙁 🙁 :crying:
দীর্ঘশ্বাসের কোনো ইমো আমার জানা নেই! ওটা দরকার ছিল খুব!
মন্তব্য করতে গিয়ে থমকে গেলাম, কিছুই চিন্তা করতে পারলাম না।
তবে ঐ বিবেকটা ঠিকমত না জন্মালে মানুষ পশুও থাকেনা।
আর নিজের ক্ষেত্রে যেটা বলতে পারি, রাস্তায় কখনও বের হলে আমার কুকুর বা বেড়াল এর খোজ করার একটা প্রবণতা আছে। তাদেরকে কিছু সময় না দেখলে মনে হয় আমরা অনেক অনেক একা, বৈচিত্র্যময় আত্মার সন্ধান পেতে তখন নিজের আত্মাটা হাহাকার করে উঠে।
লেখাটা অত্যন্ত ভালো হয়েছে।
ওদের মুখ নেই, কেবল চেয়ে থাকে, মানবশিশুর মত… বিবেকটাও কিছু মানুষের চামড়াধারীদের চেয়ে বেশি কখনো কখনো… সবাই বোঝে না ওদের কষ্ট ! ওদের চেয়েও কোটিগুণ ভয়ানক জানোয়ারে ভর্তি ছিল এদেশ…সেই একাত্তরে!
আমরা লেখায় তার কতটুকুই বা বুঝাতে পারি?
কী অসাধারণ একটা লেখা। কোন শব্দ নেই, অনূভুতি প্রকাশ করার মতো। শুধু বলি, চোখে পানি চলে এলো……………
… 🙁
এমন একটা লেখা পড়ে মন্তব্য করার কোন ভাষা থাকে না। ইমো দিয়ে অনুভূতি প্রকাশের সাহসও জাগে না। মন্তব্য না করে যাওয়াটাও পরবর্তীতে আক্ষেপের কারণ হয়ে দাঁড়ায়!
শুধু শৈশবদা’র সাথে সুর মিলিয়ে একটা কথাই বলি- শুধু বিশ্বাস করি, ইনশাল্লাহ আমারা পারবো, একদিন ভোর হবেই …