( এই গল্পটি ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে একটি সত্য ঘটনা অবলম্বনে লেখা। ঘটনাটি শুনেছিলাম ভিকারুননিসা নূন স্কুল ও কলেজের শিক্ষক খালেদা হক আপার কাছ থেকে। বাংলাদেশী হিসেবে আমার মাঝে দৃঢভাবে নতুন এক চেতনার জন্ম দেবার জন্য এই মানুষটির কাছে আমি আজীবন কৃতজ্ঞ থাকবো। )
দরদর করে ঘামছি আমি। সমস্ত চেতনা লুপ্ত হয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। দম আটকে আসছে আমার, কেন যেন হা করে থেকেও চারপাশের কোথাও এক ফোঁটা বাতাস পাচ্ছি না!
স্বপ্নে দেখতে পাই, চারিদিকে রক্ত-মাংস ছড়িয়ে আছে আর পোড়া গন্ধে ভারি হয়ে উঠছে ঘরটা। ঐ তো ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে গেলো আমার মা, কোলে আড়াই মাস বয়সী আমার ছোট্ট বোনটা। ঐ যে, মায়ের ঠিক সামনেই দাঁড়িয়ে বাবা। আর তাদের সামনে পাঁচজন দানব অট্টহাসিতে ঢলে ঢলে পড়ছে। আমি আমাকেও দেখতে পাচ্ছি। ঐ যে সাত বছরের আমি, ঐ খড়ের গাদার ফাঁক দিয়ে চেয়ে আছি ভয়ার্ত চোখে।
চারিদিকে পোড়া গন্ধ আর লাশের ছড়াছড়ি। উফ! ঐখানে ওটা কে দাঁড়িয়ে? কিসলু চাচা না? তাকে তো সবাই রাজাকার বলে ডাকে আড়ালে আড়ালে। সে তো গতকাল রাতেই আমাদের বাড়িতে এসেছিলো ছোট মামার খোঁজে। মামা তো নেই, কিসলু চাচা এখানে কী করছে?
আরে আরে, আমার ছোট বোনটাকে কেড়ে নিলো কেন ঐ পাকিস্তানি আর্মিটা? হায় হায়, ওরা মায়ের কাপড় ধরছে কেন? আমার মায়ের তো একটাই পরার কাপড়। ওটা ছিঁড়ে ফেললে মা পরবে কী?
হায় আল্লাহ, ওরা আমার মাকে মারছে! খড়ের গাদার ভিতর থেকে কে যেন আমার চোখ দুটো চেপে ধরে রইলো। আমি ছাড়াতেও পারছি না!
মায়ের চিৎকারে আমার কানে তালা লেগে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ পরেই গুলির শব্দ। মা আমার পড়ে যাচ্ছে। তোমরা কেউ ধরছো না কেন আমার মাকে? ওই তো মা আমায় খুঁজছে, কেন খড়ের গাদার ভিতরে তোমরা আমায় জোর করে ধরে রাখলে? দেখতে পাচ্ছো না, মায়ের রক্তটাও আমায় খুঁজতে খুঁজতে গড়িয়ে গড়িয়ে ঠিক এদিকেই চলে এলো?
মাকে দেখে কিসলু চাচা অমন করে দাঁত বের করে হাসছে কেন? কিসলু চাচা এটা কী করলো? আমার বোনটাকে বাবার কাছে না দিলে ঐ আর্মি অফিসারটাকে দিয়ে দিলো? চাচা কি দেখতে পায় নি ঐ অফিসারটাই একটু আগে আমার মাকে কেমন করে মারছিলো?
আমার বাবাটা কাঁদছে। অফিসারের পা ধরে আছে, মনে হয় আমার বোনটাকে কোলে নিতে চাইছে। আমি এতো দূর থেকে তাদের কোন কথা শুনতে পাচ্ছি না। শুধু দেখতে পাচ্ছি, অফিসারটা আমার বোনটাকে ছুঁড়ে দিলো আরেক সেনার দিকে, সে আবার ছুঁড়লো আরেকজনের দিকে। আমার বাবাটা সবার পায়ে পায়ে ঘুরছে। আমার বোনটা যখন যার কাছে উড়ে উড়ে যাচ্ছে, বাবা তখনই তার পায়ে গিয়ে পড়ছে।
অফিসারটা কী করলো এটা? কী করলো? কী করলোওওও…?
আমি ঘুম থেকে জেগে উঠে দেখলাম দরদর করে ঘামছি। হা করে থেকেও কোন বাতাস পাচ্ছি না ফুসফুসে। পাশের ঘর থেকে চিৎকার ভেসে আসছে, “ইয়েস, পাকিস্তান সিক্স মেরেছে। ইয়েস! দে তোরা বাংলাদেশের মুখে লাত্থি মেরে। দেখিয়ে দে বাঘের বাচ্চারা বিলাই হয় কেমনে।”
আমি আবার চেতনা হারিয়ে ফেলতে শুরু করি। সবকিছু আঁধারে মিলিয়ে যাবার সাথে সাথে দেখতে পাই, সেই অফিসারটা আমার ছোট্ট বোনটার দুই পা ধরে দু’পাশে তীব্র বেগে টান দিয়ে মাথাসমেত ওকে দুটো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেললো। তারপর সেই রক্ত-মাংসের পিণ্ডটা ছুঁড়ে দিলো আমার বাবার দিকে!
আবার গুলির শব্দ। বাবা পড়ে যাচ্ছে আমার মায়ের পাশে। বাবার কোলে আমার ছোট্ট আদুরে আড়াই মাসের বোনটার ছিন্নভিন্ন দেহ!
উফ! চারিদিকে এতো রক্ত আর এতো লাশের গন্ধ কেন? আমার দম আটকে আসছে। আমি শত চেষ্টাতেও হা করে বুক ভর্তি নিঃশ্বাস নিতে পারছি না!
স্বপ্নের ভেতরে আমি অচেতনের মাঝে থেকেও ফের চেতনা হারাতে শুরু করি!
অসাধারণ । বলার কিছু পাচ্ছি না । কিন্তু মাঝে, খেলার ব্যাপারটা না আনাটা গল্পের সাথে ঠিক সামঞ্জস্যপূর্ণ মনে হল না । 🙁
খেলার ঘটনা আমি বানাই নি। গল্পের শুরুতেই বলেছি যে এটি সত্য ঘটনা অবলম্বনে লেখা। এখানে ঘটে যাওয়া প্রত্যেকটি ঘটনাই সত্য। আমি শুধু বক্তার চরিত্রের জায়গায় নিজেকে বসিয়ে ঘটনাটিকে গল্পের একটা রূপ দিয়েছি মাত্র।
:crying:
দানবীয় ঘটনাটা যেন চোখের সামনে ভাসতে দেখলাম!
আমি শোনার পর স্থির থাকতে পারি নি।
কাঁপছিলাম অনবরত। আক্রোশে, ঘৃণায়।
কী বলব!
চমৎকার লেখা।
হুমম।
ধন্যবাদ।
আপি এই লেখায় কমেন্ট করার যোগ্যতা আমার একদমই নেই। মুক্তিযুদ্ধের প্রতিটি ঘটনা শোনার সময় আমার রোম খাড়া হয়ে যায়, মাঝে মাঝে প্রচন্ড রকমের ক্ষোভের সৃষ্টি হয়, তোমার লেখাটা পড়েও একই অনুভুতি হল আর প্রচন্ড রকমের মন খারাপও হয়ে গেল 🙁 ৭১ এর ওই গুলাকে এখন পেলে মনে হয় :dhisya: :dhisya: :dhisya: ফায়ার করতাম
টাইম মেশিনে করে পিছনে গিয়ে সেইরকম কাহিনী কোনদিন যদি ঘটানোর সুযোগ পেয়ে যাস তাহলেও আমাকে সাথে নিয়ে নিস। :dhisya: দিতে আগ্রহী আমিও!
চেতনা বোধ জাগ্রত হোক সবার মাঝে। জাতীয়তা বোধ জাগ্রত হোক, প্রসারিত হোক চিন্তাধারা। হৃদয়স্পর্শী লেখাটি চমৎকার লাগল। এখন সবার বোধদয় হবার অপেক্ষায়….
এখন সবার বোধদয় হবার অপেক্ষায়…. আমিও!
এই লিখাটা পড়ার পর ধাতস্থ হতে বেশ খানিকটা সময় লেগেছে, আমি জানি না, এইরকম ভয়ানক অভিজ্ঞতা হয়তো কেউ বিশ্বাস করবে না, কিন্তু এমন হাজারো কষ্টের মাঝেই বেঁচে এসেছে আমাদের স্বাধীনতা……
স্যালুট সেই মানুষগুলোকে, যারা এর পরেও ঘুরে দাঁড়িয়ে আমাদের বিজয় এনেছিলেন…
স্যালুট সেই মানুষগুলোকে, যারা এর পরেও ঘুরে দাঁড়িয়ে আমাদের বিজয় এনেছিলেন…>> :huzur:
কী ভয়ানক এই লেখাটা আপু। চোখের সামনে দেখতে পেলাম।
হুম…
কী যেন এক অনূভুতি সমগ্র চেতনাকে গ্রাস করে ফেলছে। মাথা ঘুরছে বনবন করে, মনে হচ্ছে চোখেও দেখতে পাচ্ছি না। ঘৃণা, তীব্র রাগ সব মিশে গেলে বুঝি এমনই হয়……………
🙁
বেদনাদায়ক, যুগে যুগে ক্ষমতাবানদের কথিত চেতনার বলি হয়েছে সাধারন মানুষ।
সহমত।
বিছানায় শুয়ে শুয়ে লেখাটা পড়লাম। শুয়ে থেকেও টের পাচ্ছি আমার হাত-পা প্রচন্ড কাপতেসে
আমার কী বলা উচিত বুঝতে পারছি না!