আনন্দযাত্রা ও কৃষ্ণচূড়ার গল্প

মায়ের ডাকে ঘুমডা ভাইঙা গেলো। আমি একটা খোয়াব দেখতাছিলাম। একটা জঙ্গলের মইধ্যে আমি একলা একলা ঘুরতাছিলাম। চাইরপাশে কি সুন্দর সব ফুল! গাছগুলা কি সুন্দর সবুজ! গাছে গাছে পাখি উড়তাছে। ফুলগুলাতে প্রজাপতি ঘুইরা বেড়াইতাছে। একটা সুন্দর প্রজাপতি ধরতে নিছি আর ম আইসা আমারে ডাক দিলো।

কতক্ষণ চোখ বন্ধ রাইখা আমি উইঠা বইলাম। এখন আর জঙ্গল নাই আমার চাইরপাশে। ঘরের বেড়ার ফাকা দিয়া রোদ ঢুকতাসে ঘরের মইধ্যে। ঘরের চালের নিচে একটা নীল পেলাস্টিকের কাগজ। চালের ফুটা দিয়া বৃষ্টির সময় ঘরে পানি পরে,তাই পেলাসটিকের পর্দা দিছে।

ঘরের কোণা থেইকা মা ডাইকা কইলো,কিরে মা,উঠছোস?

-হ,উঠসি

-ইসকুলে যাবিনা?

-মা যে কি কও! আইজকা শুক্কুরবার। ইসকুল নাই।

-ও!

মা আবার নিজের কাম শুরু করলো। আমার অনেক খুশী লাগতাছ অহন।আইজকা ইসকুলে যাইতে হইবো না। আমাগো ইসকুলে এমনিতেও পড়ালেখা হয়না। আমরা ট্যাকা-পয়সা দিতে পারিনা,আমাগো কি পড়াইবো। আইজকা সারাদিন ঘুইরা বেড়াইতে পারুম রাস্তায়। মা কামে যাইবোগা একটু পর,তারপরই আমি বাসা থেইকা বাইর হইয়া যামু।

ঘর থেইকা বাইর হইয়া কলতলায় গেলাম হাতমুখ ধুইতে। ছাই দিয়া দাঁত মাজতে মাজতে চাইরপাশের মানুষ দেখতে লাগলাম। কয়জন কাপড় ধোয়,গোসল করতাছে একজন,আমার মতো দাঁত মাজে দুইজন। এই রায়বাজার বস্তিতে কতো মানুষ! সারাদিন বইয়া বইয়া মাইনষের কাম দেখলেই দিন কাইটা যায়।

ঘরে ফেরত আইতেই মা পান্তা ভাত আর একটা মরিচ দিলো খাইতে।

-একটা পিয়াজ নাই,মা?

-পিয়াজ কই পাম?! যেই দাম!

বেশী কইরা লবণ নিয়া খাওয়া শুরু করলাম। মা এইবার আমারে কইয়া বাইর হইয়া গেলো কামে। লালমাটিয়া যাইবো,এক বাড়িতে বুয়ার কাম করে।

খাওয়া শ্যাষ কইরাই বাইর হইয়া গেলাম বস্তি থেইকা। আইজকা লাল জামাডা গায় দিছি। মাথায় তেল দিয়া ভালোমতো চুল আচড়াইয়া ঝুটি করছি। একটা টিপও দিছি কপালে। টিপটা মা গত সপ্তায় মেলা থেইকা কিনা দিছিলো। চোখে কাজল দিছিলাম,ক্যামনে জানি ল্যাপটাইয়া গেলো। মুইছা ফালাইছি।

রাস্তা দিয়া হাটলে কত বিদিক কিসিমের মানুষ দেখা যায়। একটা রিকশার লগ আরেকটা রিকশা লাইগা গেছে! দুই রিকশাওয়ালা কতক্ষণ চিল্লাচিল্লি কইরা এরপর শুরু করলো মারামারি। চাইরপাশে মানুষ ভিড় কইরা দেখতাসে। কিন্তু,কেউ থামায় না। ভিড় বেশী হইয়া গেছে। আমি ছোড মানুষ,আর দেখতে পারলাম না।

একটা জামার দোকানের সামনে দাঁড়াইলাম। নীল রঙের জামাডা কি সুন্দর! আহারে,পড়লে আমারে মনে হয় সুন্দর লাগতো। থাউক,এইসব ভাইবা লাভ নাই,মা-য় ঈদ ছাড়া জামা কিনা দিতে পারবো না।

মুদি দোকান থেইকা একটা চকলেট কিনসি। একটা টাকা ছিলো আমার কাছে। চকলেটটা মুখে দিলেই-কিযে মিষ্টি! অনেক ভাল্লাগে চকলেট খাইতে। বড় হইয়া আমি চকলেটের দোকান দিমু,আর দোকানে বইসা বইসা চকলেট খামু। তখন তো আর আমার চকলেট খাইতে টাকা লাগবো না।

বড় রাস্তার কাছ আইসা দেখি মোড়ের কাছে ফলের দোকান। কমলা আনছিলো মা একটা একদিন। মেমসাবে দিছিলো। আমি চাইর দিনে খাইছিলাম। মা এইসব খায়না……আমারে কয়-তুই খা,আমার এইসব ভাল্লাগে না।

মা যে কি কয় না…………আমার তো অনেক মজা লাগে!

আপেলও আমি চিনসি,আঙুরও। বইয়ে ছবি দেখছি এগুলার। আর কতগুলা কি যেন আছে,চিনিনা।

এইবার রাস্তা পার হইতে হইবো। রাস্তায় কতো গাড়ি! গাড়ির ভিতর কতো সুন্দর সুন্দর মানুষ বইয়া থাকে! আমাগো বস্তিতে এমুন সুন্দর মানুষ একটাও নাই। এমুন সুন্দর হইলেই মনে হয় মানুষ বড়লোক হয়,গাড়ি থাকে।একটা গাড়ি গেলো,আরেকটা বাস আইতাসে। দৌড় দিয়া মাঝ রাস্তায় চইলা আইলাম। রাস্তা পার হইতে মার অনেক ভয় লাগে। কত গাড়ি! কত বাস! রাস্তায় মাঝের উঁচা যায়গাডা আমার যে কি ভালো লাগে! কত সুন্দর সুন্দর গাছ। এই গাছের নাম কৃষ্ণচূড়া। লাল লাল ফুলে রাস্তার মাঝখানটা ভইরা গেছে। সবুজের মইধ্যে লাল,আমগো দেশের পতাকার মতো।

এইবার বাকি রাস্তা পার হইতে হইবো। ওই পাশে একটা খাওনের দোকান আছে। ওইখান থিকা যারা বাইর হয় খাওন হাতে লইয়া,চাইলে তারা মাঝে মইধ্যে আমারে দেয়। বনরুটির মতো একটা জিনিস,ভিতরে কি জানি-খাইতে অনেক মজা!

একটা ভাইয়া আর আপু বাইর হইতাসে! হাতে খাওন আছে। জোরে দৌড় দিলে হেগোরে ধরতে পারুম। দৌড়…দৌড়-হঠাৎ এতো জোরে গাড়ির আওয়াজ! তাকাই দেখি আমার থিকা একটু দূরেই বাসটা,আমার দিকেই আইতাসে। আমি আর হাটতে পারতাসি না! মা,তুমি কই। মা,আমারে একটু টান দিয়া সরাই লও এইখান থিকা।

বাসটা থামেনা ক্যান?…………

 

কৃষ্ণচূড়া

 

স্বপ্ন বিলাস সম্পর্কে

বাস্তবে মানুষ হবার চেষ্টা করে যাচ্ছি। জীবনের নানা পথ ঘুরে ইদানীং মনে হচ্ছে গোলকধাঁধায় হারিয়েছি আমি। পথ খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করি আর দেখে যাই চারপাশ। ক্লান্ত হয়ে হারাই যখন স্বপ্নে, তখন আমার পৃথিবীর আমার মতো......ছন্নছাড়া, বাঁধনহারা। আর তাই, স্বপ্ন দেখি..........স্বপ্নে বাস করি.....
এই লেখাটি পোস্ট করা হয়েছে গল্প-এ। স্থায়ী লিংক বুকমার্ক করুন।

20 Responses to আনন্দযাত্রা ও কৃষ্ণচূড়ার গল্প

  1. নীল বলেছেনঃ

    শেষটুক পড়ে কষ্ট পাইলাম!

  2. বোহেমিয়ান বলেছেনঃ

    🙁

    খাইছে! তুই দেখি চমৎকার গল্প লিখিস! কী চমৎকার একটা পয়েন্ট অব ভিউ!

    অসাধারণ হইছে দোস্ত। সিম্পলি অসাধারণ।

  3. মাহমুদ ফয়সাল বলেছেনঃ

    মন খারাপ হইসে 🙁

  4. ফিনিক্স বলেছেনঃ

    🙁 🙁

  5. তুই আসলেই একটা খারাপ মানুষ! আমার কোন দ্বিমত নাই এই ব্যাপারে……একদমই না! :mathagorom:

  6. সামিরা বলেছেনঃ

    মানুষ এত সুন্দর গল্প কীভাবে লেখে? 😮
    আমিও গল্প লিখতে চাই! কতদিন নিজে কিছু লিখি না। 🙁

  7. শিশিরকণা বলেছেনঃ

    ভালো লাগলো …. :guiter:

  8. কৃষ্ণচূড়া বলেছেনঃ

    উফ! শেষ টা কৃষ্ণচূড়ার মতই রক্তাক্ত!
    সুন্দর গল্প। কামনা করি, এটা গল্পই হোক,কারও জীবনের বাস্তবতা না।

  9. নিস্তব্ধ অমিত বলেছেনঃ

    শেষে খুব ভালো একটা ধাক্কা খেলাম…… ভালো লেগেছে……

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।