জবানবন্দী
১৯৭১ সালের ২৭ শে মার্চ একজন পরদেশী, ঢাকা সরকারী শিশু হাসপাতালের একজন সুইপার কী কী দেখেছিলেন তার জবানবন্দীর দৃশ্যকল্পঃ
আমি
পরদেশী
পিতাঃ ছোটন ডোম
সুইপার, সরকারী শিশু হাসপাতাল
ঢাকা।
দৃশ্য ১:
১৯৭১ সনের ২৭ শে মার্চ সকালে রাজধানী ঢাকায় পাকসেনাদের বীভৎস হত্যাকান্ডের পর ঢাকা পৌরসভার তৎকালীন চেয়ারম্যান মেজর সালামত আলি খান শূরের প্রশাসনিক অফিসার মি. ইদ্রিস পৌরসভার আরও কয়েকজন অফিসার সঙ্গে নিয়ে একটি মিউনিসিপ্যাল ট্রাকে পশু হাসপাতালের গেটে এসে বাগের মতো “পরদেশী, পরদেশী” বরে গর্জন করতে থাকে।
দৃশ্য ২:
আমাদের ট্রাকে করে ঢাকা পৌরসভা অফিসে নিয়ে আমাদের প্রায় আঠারজন সুইপার ও ডোমকে একত্রিত করে প্রতি ছয়জনের সাথে দুইজন করে সুইপার ইন্সপেক্টর আমাদের সুপারভাইজার নিয়োজিত করে ট্রাকে তিনদলকে বাংলাবাজার, মিটফোর্ড ও বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় প্রেরণ করা হয়। আমি মিটফোর্ডের ট্রাকে ছিলাম। সকাল নয়টার সময় আমাদের ট্রাক মিটফোর্ড হাসপাতালের লাশঘরের সম্মুখে উপস্থিত হলে আমরা ট্রাক থেকে নেমে লাশঘরের ভিতরে প্রবেশ করে বুকে এবং পিঠে মেশিনগানের গুলিতে ঝাঁজড়া করা প্রায় একশত যুবক বাঙালির বীভৎস লাশ দেখলাম। প্রতিটি লাশ পা ধরে টেনে বের করে বাইরে দাঁড়ানো অন্যান্য সুইপারের হাতে তুলে দিয়েছি ট্রাকে উঠাবার জন্য। সব লাশ তুলে দিয়ে একপাশে একটা লম্বা টেবিলের উপর চাদর টেনে উঠিয়ে দেখলাম একটি রূপসী ষোড়শী যুবতীর উলঙ্গ লাশ – লাশের বক্ষ, যোনিপথ ক্ষতবিক্ষত, কোমরের পিছনের মাংস কেটে তুলে নেওয়া হয়েছে, বুকের স্তন থেতলে গেছে, কোমর পর্যন্ত লম্বা কালো চুল, হরিণের মত মায়াময় চোখ দেখে আমার চোখবেয়ে পানি পড়তে থাকল, আমি কিছুতেই পানি আটকে রাখতে পারলাম না। আমি আমার সুপারভাইজারের ভয়াল এবং ভয়ঙ্কর কর্কশ গর্জনের মুখে সেই সুন্দরীর পবিত্র দেহ অত্যন্ত যত্ন সম্ভ্রমের সাথে ট্রাকে তুলে দিলাম।
দৃশ্য ৩:
মিটফোর্ডের সকল লাশ ট্রাকে তুলে আমরা ধলপুরের ময়লা ডিপোতে নিয়ে গিয়ে বিরাট গর্তের মধ্যে ঢেলে দিলাম। দেখলাম বিরাট বিরাট গর্তের মধ্যে সুইপার ও ডোমেরা রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন স্থান থেকে নিয়ে আশা লাশ ট্রাক থেকে গর্তের মধ্যে ফেলে দিচ্ছে। আমি অধিকাংশ লাশের দেহেই কোন আবরণ দেখি নাই। যে সমস্ত যুবতী মেয়ে ও রমণীদের লাশ গর্তের মধ্যে ফেলে দেওয়া হলো তার কোনো লাশের দেহেই আমি কোনো আবরণ দেখি নাই। তাদের পবিত্র দেহ দেখেছি ক্ষতবিক্ষত, তাদের যোনিপথ পিছন দিকসহ আঘাতে বীভৎস হয়ে আছে।
দৃশ্য ৪:
মানুষের পচা চর্বির গন্ধে আমার পাকস্থলি বের হতে চাচ্ছিল। পরেরদিন আমি আর লাশ তুলতে যাই নাই, যেতে পারি নাই। সারাদিন ভাত খেতে পারি নাই, ঘৃণায় কোনোকিছু স্পর্শ করতে পারি নাই।
দৃশ্য ৫:
পরেরদিন (২৯ শে মার্চ) পাটুয়াটুলি ফাঁড়ি পার হয়ে আমাদের ট্রাক শাখারীবাজারের মধ্যে প্রবেশ করল। ট্রাক থেকে নেমে আমরা শাখারীবাজারের প্রতিটি ঘরে ঘরে প্রবেশ করলাম – দেখলাম মানুষের লাশ, নারী-পুরুষ, যুবক-যুবতী, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, বালক-বালিকা, কিশোর-শিশুর বীভৎস লাশ, চারিদিকে ইমারতসমূহ ভেঙ্গে পড়ে আছে, মেয়েদের অধিকাংশ লাশ আমি সম্পূর্ণ উলঙ্গ দেখলাম, দেখলাম তাদের বুক থেকে স্তন তুলে নেওয়া হয়েছে। কারও কারও যোনিপথে লাঠি ঢুকানো আছে। বহু পোড়া, ভষ্ম লাশ দেখেছি। পাঞ্জাবী সেনারা পাষণ্ডের মত লাফাতে লাফাতে গুলি বর্ষণ করছিল, বিহারী জনতা শাখারীবাজারের প্রতিটি ঘরে প্রবেশ করে মূল্যবান আসবাবপত্র, সোনাদানা লুণ্ঠন করে নিয়ে যাচ্ছিল। আমরা অবিরাম গুলি বর্ষণের মুখে প্রাণের ভয়ে দুই ট্রাক লাশ তুলে লাশ তোলার জন্য সেদিন আর শাখারীবাজারে প্রবেশ করার সাহস পাই নাই।
দৃশ্য ৬:
আমি মিলব্যারাক ঘাটে পৌরসভার ট্রাক নিয়ে পৌরসভার ট্রাক নিয়ে গিয়ে দেখলাম নদীর ঘাটে অসংখ্য মানুষের লাশ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। প্রতিটি লাশের চোখ বাঁধা, হাত বাঁধা, শক্ত করে পিছন দিক থেকে। প্রতিটি লাশের মুখমন্ডল এসিডে জ্বলে বিকৃত ও বিকট হয়ে আছে। লাশের কোনো দলকে দেখলাম মেশিনগানের গুলিতে বুক ও পিঠ ঝাঁজড়া হয়ে আছে, অনেক লাশ দেখলাম বেটন ও বেয়নেটের আঘাতে বীভৎস হয়ে আছে, কারো মাথা চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে মগজ বের হয়ে আছে, কারও কাটা হৃৎপিণ্ড বের হয়ে আছে। নদীর পাড়ে ছয়জন রূপসী যুবতীর বীভৎস ক্ষতবিক্ষত, উলঙ্গ লাশ দেখলাম। চোখ বাঁধা, হাত-পা শক্ত করে বাঁধা প্রতিটি লাশ গুলির আঘাতে ঝাঁজড়া, মুখমন্ডল, বক্ষ ও যোনিপথ রক্তাক্ত ক্ষতবিক্ষত ও বীভৎস দেখলাম।
দৃশ্য ৭:
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলের পিছনে স্টাফ কোয়ার্টার, রোকেয়া হলের পশ্চিম দিকে জনৈক অধ্যাপকের বাসা থেকে আমি লাশ তুলেছি। অধ্যাপকের বাসা থেকে সিঁড়ির সামনে লেপের ভিতর পেঁচানো জনৈক অধ্যাপকের লাশ আমি তুলে নিয়ে গেছি।
দৃশ্য ৮:
আরও বলতে হবে? কাঁদার জন্য এই কী যথেষ্ট নয়? উপলব্ধির জন্য এই কী যথেষ্ট নয়???????
দৃশ্য বিন্যাসের সুবিধার জন্য সংক্ষেপিত ও পরিমার্জিত। মুল রচনাঃ
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ
দলিলপত্রঃ অষ্টম খন্ড
হাসান হাফিজুর রহমান
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার, তথ্যমন্ত্রণালয়
পৃষ্ঠাঃ ৫০
আরও তথ্য সূত্রঃ জোছনা ও জননীর গল্প, হুমায়ুন আহমেদ, পৃষ্ঠাঃ ১৪৯ থেকে ১৫২।
প্রিয় ইস্ক্রা,
নতুন ব্যবহারকারী হিসেবে আপনার উচ্ছ্বাস আবেগের প্রশংসা আমরা করি।
কিন্তু একই সাথে প্রথম পাতায় ২ টির বেশি লেখা দেওয়া যাবে না। এই নীতিটি মাথায় রাখার অনুরোধ করা হচ্ছে।
আপনার আগের ১ টি লেখা আমরা প্রথম পাতা থেকে সরিয়ে দিচ্ছি
আমি এই নীতিটি জানতাম না। এবার জানলাম। এবং এখন সতর্ক থাকব। 🙂
তোর এই লিখাটাও আগে পড়েছি বলে মনে পড়ে, তাই না? খুব বেশি প্রয়োজন আমাদের এই লিখাগুলোকে সামনে নিয়ে আসা……বিশ্বাস রাখি তোদের উপর, একদিন আমাদের সবাই জানবে মুক্তিযুদ্ধ মানে আসলে কি……
না, এটা আগে পড়োনি, কারন, এটা একটু আগেই লিখে শেষ করেছি। তবে এইরকমই একটা লেখা আগে পড়েছিলে।
একটা কথা আমার মনে হলো।
সরাসরি কোন বইয়ের সারসংক্ষেপ কাহিনী দেবার চেয়ে সেই বইকে তথ্যসূত্র হিসেবে উপস্থাপন করে মৌলিক লেখা দেয়া ভালো।
দুটো বই থেকে তিন-চার পৃষ্ঠা সংক্ষেপ করে পোস্ট না দিয়ে নিজের যুক্তি, বুদ্ধি দিয়ে নতুন আঙ্গিকে কিছু তথ্য তুলে ধরলে সেটা বেশি গ্রহণযোগ্যতা পায় বলে আমার বিশ্বাস। লেখকের সৃষ্টিশীলতার জায়গাটাও এতে অক্ষুণ্ন থাকে।
আর কোন বই পড়ার সাজেশন থাকলে তা পোস্টে অবশ্যই উল্লেখ করা যায়।
এই বিষয়গুলো মাথায় রেখে লিখলে আরও ভাল হবে আশা করি।