একটি নিছক গল্প

আমি একটা অস্ফুট শব্দ শুনতে পেলাম। বোধহয় একটা মানুষ। একটুপর শব্দটা আরেকটু জোড়ালো হল। না, একটি মানুষ নয়, একদল মানুষের গলা মনে হচ্ছে। তারা কিছু একটা নিয়ে কথা বলছে। আমি আরও একটু ভাল করে শোনার চেষ্টা করলাম। এবার মনে হচ্ছে স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি। নিজেকে একটা ফাইলের ভিতর বন্দী অবস্থায় আবিষ্কার করলাম। আর আমাকে ঘিরেই মানুষগুলো কথা বলছে। বোধহয় আমার বিষয়েই তারা কথা বলছে। একটি লোক বেশ ভারী গলায় অন্যদের বোঝানোর চেষ্টা করছে এবছর তাদের কত টাকা লাভ হতে পারে। আর, তাই শুনে একটু পর পর সবাই ক্রুর হাসি দিচ্ছে। কিন্তু, আমি কে? আমি কী খুব মূল্যবান কোন বস্তু?

একটু পরেই আমাকে ফাইল থেকে বের করা হল। আমি তখন সর্বপ্রথম জানতে পারলাম আমি আসলে ক্লাশ নাইন-টেনের একটি সৃজনশীল গাইডের খসড়া কপি। আমার গায়ে বড় বড় করে লেখা, মাধ্যমিক সৃজনশীল বাংলা গাইড, ২০০৯-১০। আমাকে ফিতাবন্ধ করে রাখা হয়েছে। আমি টের পেলাম একজন খসখসে, পুরু চামড়া আর ময়লা নখওয়ালা লোক আমার ফিতা খুলতে শুরু করেছে। আর বলছে এবার নাকি সৃজনশীল পদ্ধতি এসে ভালই হয়েছে। লোকজন ঘাবড়ে গেছে। কেউ কিছু বুঝে উঠতে পারছে না। এই প্রশ্ন কেমন হবে তা কেউ ঠিকমত জানে না। সরকারি স্কুলগুলোর মাস্টাররাও নাকি দ্বিধায় পড়ে গেছেন। এটাই হল ব্যবসা করার উপযুক্ত সময়। কেউ বুঝতে পারছে না কিভাবে পড়তে হবে। কাজেই, পুরোনো লেখাগুলোকেই নতুন মোড়কে ভরে বাজারে ছেড়ে দিতে পারলেই কেল্লা ফতে। টাকা নাকি হাত দিয়ে গুণে শেষ করা যাবে না। এই কথাগুলো বলতে বলতে লোকটি আমার বিভিন্ন পৃষ্ঠাগুলোয় চোখ বোলাতে লাগল। আমি এতক্ষণে আমার মুল্য বুঝে গেছি। আমি আসলে একটা মূল্যহীন গাইড বই। কয়েকদিন পরেই হয়ত ছেলেমেয়েদের হাতে গিয়ে পড়ব আর তাদের ভুল তথ্য দিতে শুরু করব।লোকটি আবার আমাকে ফাইলবন্ধ করে কারও হাতে চালান করে দিয়ে বলল, আজ রাতেই ছেপে ফেল। যত দ্রুত সম্ভব এটা বাজারে বের করতে হবে। আমি আবার কিছু মানুষের ক্রুর হাসি শুনতে পেলাম।

এরপর আমাকে নিয়ে যাওয়া হল প্রেসে। অক্ষরের পর অক্ষর সাজিয়ে আমাকে একটা রংচঙা, আকর্ষণীয় মোড়কে ছাপা হল। আমার অনেক গুণকীর্তির কথাও বলা হল। আমি সবচেয়ে অবাক হলাম, আমার গায়েই ফলাও করে লেখা হয়েছে দেশের নামি-দামি সব শিক্ষকদের নাম! তারা ছাত্রদেরকে আমাকে পড়তে বলছেন। কেউ দেখা বস্তুও অবিশ্বাস করতে পারে, শোনা ঘটনাও অবিশ্বাস করতে পারে। কিন্তু, এ যে স্বয়ং আমি! আমাকে আমি অবিশ্বাস করি কিভাবে? শেষ পর্যন্ত একজন শিক্ষকও গাইড বই পড়তে বলতে পারলেন?!

আমার ভিতর অসংখ্য ভুল তথ্য রয়েছে আমি জানি। কিন্তু তবুও আমার গায়ে ১০০% নির্ভুল কথাটা লিখে দেওয়া হল। আমি চলে গেলাম একটা বইয়ের দোকানে। সেখানে প্রতিদিন হাজার হাজার ছেলেমেয়ে আমাকে কিনছে। আমার সাথেকার বন্ধুদের কিনে নিয়ে হাসতে হাসতে বাড়ি ফিরছে। আমি গাইডের স্তুপের এক কোণে পড়ে আছি। না, অবহেলায় নয়, বেশ রাজার হালেই বলা চলে। আমার নাকি কাটতি প্রচুর। তাই দোকানদার আমাকে অতি যত্নে রেখেছেন। উপরন্তু, তিনি আমাকেই কেনার জন্য ছেলেমেয়েদের অনুরোধও করছেন!

তো, যাহোক, একদিন সন্ধ্যা বেলা আমাকে একটা মেয়ে তার বাবার সাথে এসে কিনে নিয়ে গেল। আমি একটা প্যাকেটে করে চলে গেলাম মেয়েটার সঙ্গে। শুরু হল আমার নতুন জীবন। মেয়েটা আমাকে বাড়ি নিয়েই টেবিলে রেখে দিল। সন্ধ্যায় এসে সে আমাকে প্যাকেট থেকে বের করল। এরপর আমাকে উল্টে-পাল্টে দেখতে লাগল। সে আমাকে পড়ছে। তার চোখের সামনে আমার ভুলগুলো ফুটে উঠছে কিন্তু সে বুঝতে পারছে না! কী আশ্চর্য! সে কি আমার ভুলগুলোকেও বুঝতে পারছে না? তার মুল বইয়ের সাথেও যদি সে মিলিয়ে দেখত তবেও তো ভুলগুরো বুঝতে পারত! সে কি তাহরে মুল বইটাও পড়ছে না?

এভাবেই সে আমাকে অন্ধের মত পড়ে গেল পুরো দুইটা বছর। ভাল রেজাল্টও করল সে। আমার প্রয়োজন ফুরালো। আমি চলে গেলাম তার ছোটা ভাইয়ের দখলে। সেও একইভাবে আমাকে পড়তে লাগল। তারও রেজাল্ট ভাল হল। বাড়িতে আনন্দের বন্যা এবং সেইসাথে আমার গুণগান। আমি কিছুতেই বুঝতে পারলাম না, কিভাবে আমাকে পড়ে এই ছেলেমেয়েদুটি ভাল রেজাল্ট করল? তো যাহোক, কোন এক বিচিত্র কারনে আমাকে তারা বিক্রী করে দিল না। আমার সাথেকার অন্যান্য বইগুলো বিক্রী হয়ে গেছিল অনেক আগেই। কিন্তু আমি একটা বস্তাবন্দী হয়ে পড়ে রয়েছি ঘরের এক কোণায়।

একদিন ভোরবেলা, শুনি কান্নার শব্দ। বাড়িতে শোকের মাতম। আমাকে যে মেয়েটি পড়ত সে নাকি আত্মহত্যা করেছে। কিন্তু, সে কেন আত্মহত্যা করল? তার তো ব্রিলিয়ান্ট রেজাল্ট ছিল, কারও সাথে মন দেয়া-নেয়ারও সম্পর্ক ছিল না, তার মা-বাবও তো তাকে কোনদিনও বকাবকি করেনি। তাহলে কেন সে আত্মহত্যা করল? এস, এস, সি তে সে ভাল রেজাল্ট করেছিল, এইচ,এস, সি তেও তাই। তার ইচ্ছা ছিল ডাক্তারী পড়বে। সেজন্য সে কোচিংও করেছিল। অনেক স্বপ্ন ছিল তার, তাহলে কেন মুখপুড়ী আত্মহত্যা করল? আমি আজও তার উত্তর খুঁজে পাই নি।

ইস্ক্রা সম্পর্কে

লেনিনের "ইস্ক্রা" পত্রিকা থেকে আমার কবি বড় মামা আমার নাম রেখেছিলেন ইস্ক্রা (Iskra>Isckra) যার অর্থ আগুনের ফুলকি (Spark)। আমার সঙ্গে পরিচিত হতে গিয়ে সবারই আমার নাম সম্পর্কে একটা আগ্রহ সৃষ্টি হয়। আমার নামের উৎপত্তি হল এই পত্রিকাঃ http://en.wikipedia.org/wiki/Iskra ব্যক্তিগত জীবনে আমি আগুনের ফুলকির মত মোটেও উজ্জ্বল হতে পারিনি, তবে উজ্জ্বল হবার চেষ্টা করছি। আগুনের যেমন সবদিকে ছড়িয়ে পড়ার মনোভাব, তেমনি আমারও। তবে ক্ষণজন্মা ফুলকি হতে চাই না, হতে চাই সর্বগমনকারী আগুনের মত উদ্দীপ্ত আর পুড়িয়ে দিতে চাই যত অনিষ্টের মূল। যেকোন ধরণের সৃষ্টিশীল কাজ করতে আমার ভাল লাগে, যেমনঃ সংগীত, লেখালেখি, আঁকাআঁকি, বিতর্ক, কম্পিউটার সম্পর্কিত বিষয়াদি বা অন্য যেকোন কিছু। আর, আমি সকল সৃষ্টিশীল মানুষদের পছন্দ করি ও শ্রদ্ধা করি।
এই লেখাটি পোস্ট করা হয়েছে বিবিধ-এ। স্থায়ী লিংক বুকমার্ক করুন।

4 Responses to একটি নিছক গল্প

  1. বোকা মানুষ বলেছেনঃ

    কল্পনা শক্তির প্রশংসা করতেই হবে। যথাযথ প্রাপ্য। শেষ হইয়াও হইল না শেষ।

  2. বোহেমিয়ান বলেছেনঃ

    কী চমৎকার! গাইড বই এর প্রবলেম কী চমৎকার করে তুলে ধরলে!
    :fire:

  3. ফিনিক্স বলেছেনঃ

    অসাধারণ কনসেপ্ট!
    দুর্ধর্ষ! :huzur: :huzur:

  4. ফিনিক্স বলেছেনঃ

    অসাধারণ কনসেপ্ট!
    দুর্ধর্ষ! :huzur: :huzur:

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।