(সঞ্জীব’দার সাথে আমার কখনো কথা হয় নি, কিন্তু তবু, কোন এক অদ্ভুত কারণে মানুষটা আমার খুব বেশি কাছের কেউ বলে মনে হয়, ঠিক যেন হঠাৎ খুঁজে পাওয়া কোন এক বড় ভাই, যে এখনি একটা ধমক লাগাবে, “তোরে চায়ের টাকা দিতে বলছি?? মাতব্বরি করিস ক্যান? তাইলে খাওয়া আবার, আরেক কাপ!”
সঞ্জীব’দার বুঝি কোথাও খুব কষ্ট ছিলো, মানুষটা হারিয়ে যাবার পর (হ্যাঁ, হারিয়ে যাওয়াই) বাপ্পা’র লিখাটা পড়ে নিজের অজান্তেই চোখ ভিজে আসছিলো, মনে হয়, এই মানুষটাকে আমি কেন এমন করে চিনি? কেন মনে হয়, উনি ঠিক পাশেই আছেন, মিটিমিটি হাসছেন, আমার ছেলেমি দেখে…
তবু সঞ্জীবদা, তোমার জন্মদিন এই চিঠিটা না লিখে পারছি না, যদি হয় তো পড়ো লিখাটা…)
সঞ্জীবদা,
জন্মদিনের শুভেচ্ছা রইলো, লেখক পরিচিতির মতো লিখতে ইচ্ছে হলো না, তোমার জন্ম অমুকদিন অমুক জায়গার অমুক গ্রামে, লিখতে ইচ্ছে হলো না শুধুমাত্র অনেকটুকু অভিমান পুঁজি করে তুমি চলে গেছো এমন একটা দেশে, যেখানে হয়তো আমার এই লিখা কখনোই পৌঁছুবে না, তবু কেন জানি আজ হঠাৎ করেই তোমাকে লিখতে মন চাইলো, মনে হলো, এখনো তোমাকে অনেক কিছু বলার বাকি, আমার অনেক অভিমানের কথা, তোমার উপর অভিমান, তোমার লিখা গানের উপর অভিমান……
তুমি কখনো আমাকে দেখো নি, বইমেলায় তুমি যখন পাশ দিয়ে হেঁটে গিয়েছিলে, কখনো খেয়াল করো নি, একটা ছেলে হা করে তোমার দিকে তাকিয়ে আছে, যার বিশ্বাস হচ্ছে না তখনো, এই মাত্র সঞ্জীবদা, দলছুটের সঞ্জীবদা তার পাশ দিয়ে হেঁটে গেছে! তোমার মনে থাকার কোন কারণও নেই! শুধু আমার সারাজীবনের একটাই পাওয়া ছিলো, তুমি একবার আমার পাশ দিয়ে হেঁটে গিয়েছিলে……
তোমার সাথে আমার প্রথম পরিচয়ের দিনক্ষণ মনে নেই, একদমই নেই। কোন গানে? সেটা মনে আছে, ঐ যে, অসাধারণ সেই গানটা তোমরা যখন গাইলে, “গাড়ি চলে না, চলে না, চলে না রে…”
কতই-বা বয়স আমার তখন? তারপর তোমাকে খুঁজে পেলাম দলছুটের সাথে, রাত জাগার ভীষণ বাজে (!) অভ্যাসের মাঝে তোমার, তোমাদের গানগুলো ছিলো কেমন জানি……
মনে আছে, প্রথম যেদিন শুনেছিলাম,
“আমি তোমাকেই বলে দেবো,
কী যে একা দীর্ঘ রাত –
আমি হেঁটে গেছি বিরান পথে;
আমি তোমাকেই বলে দেবো,
সেই ভুলে ভরা গল্প-
কড়া নেড়ে গেছি ভুল দরজায়;
ছুঁয়ে কান্নার রঙ, ছুঁয়ে জোছনার ছায়া”
মাথাটা কেমন জানি এলোমেলো হয়ে গিয়েছিলো, মনে হচ্ছিলো, এমন করে তো কেউ আমাকে কখনো বলে নি, কারো জেগে থাকা রাতে কখনো কড়া নেড়ে বলি নি, “আমার ভুলগুলো ফিরিয়ে নিতে এসেছি, আমার সবকটা ভুল……”
তোমার গানের মাঝে কি আছে জানি না, শুধু এটুকু বুঝতে পারি, আমার মতো ক্ষ্যাপাটে ঘরছাড়া মানুষের মতো তুমিও বুঝি কিছু একটা খুঁজে ফিরতে, তাই, যখনই প্রথমবার শুনি,
“কথা বলবো না আগের মতো কিছু নেই
পিছু ডাকবো না পিছু ডাকার কিছু নেই
সর্বনাশী ঝড় বুকে, উড়ে যাবার কিছু নেই
আগুনে পুড়েছি এ হাত বাড়িয়ে, পুড়ে যাবার কিছু বাকি নেই ”
বুকের ভিতর কোথায় জানি কিছু একটা নড়েচড়ে গিয়েছিলো, নিজেকে ধরে রাখতে পারি নি, চোখের কোণ বেয়ে টপটপ করে জল নেমে এসেছিলো, কেন জানি মনে হচ্ছিলো, তুমি বুঝি খুব বেশি অভিমানী, তাই কি সঞ্জীবদা? শুধু অভিমানের কারণেই কি এমন করে ছেড়ে চলে গেলে?
বলতে পারো, তোমার সাথে কখনো কথা না হবার পরেও কী করে তোমার সব ভাবনাগুলোর মাঝে আমি আমার স্বপ্ন খুঁজে পেতাম? কেন জানি খুব… খুব বেশি মনে হতো, তুমি বুঝি জীবনে কিছু একটা খুঁজে বেড়াও, এখনো কিছু একটা পাও নি, কিছু একটা এখনো তোমার ভেতর বুভুক্ষের মতো ঘুরে ফিরে…
খুব ঠিক করে রেখেছিলাম, এরপর কোথাও তোমার কনসার্ট থাকলে অবশ্যই যাবো, তোমার সাথে গলা মিলিয়ে চিৎকার করে গান গাবো, তারপর হঠাৎ করে খবর পেলাম একদিন তুমি নেই, হঠাৎ করে কাউকে কিছু না বলেই একদিনের মধ্যে চলে গেলে? কখনো চিন্তাও করি নি, আজকের দিনে এমন সব কিছু লিখতে হবে, কিন্তু লিখতে বসে টের পেলাম, লিখা আর বাঁধ মানছে না, তাই তাকে ছেড়ে দিলাম নিজের মতো করে……
তারপর তিনটি বছর চলে গেলো সঞ্জীবদা, এই যে ২০০৯ এর বইমেলায়, তোমার লিখা কবিতার বইটা উলটে পালটে দেখতে যেয়ে চোখে পানি চলে এলো অযথাই, হতচ্ছাড়া চোখটা আমাকেও খুব বেশি পোড়ায়, তোমার লিখা কী অদ্ভুত লাইনগুলো…
তার ঠিক পাশেই তোমায় নিয়ে একটা পোস্টার…আর অল্প কয়েকটা লাইন, পুরোপুরি মনে করতে পারি না এখন, তবু…
“নিশি রাত্রিরে ঘরে ফেরা আমি…
ঘরের থেকে ডাক, কে যায়?
আমি বলে যাই, বন্ধু, আমি তোমাদেরই লোক”
মিনিটখানেক দাঁড়িয়ে ছিলাম সেই পোস্টারটার সামনে, পা নড়ছিলো না, কেমন করে এইভাবে লিখে একজন মানুষ? কেমন করে সঞ্জীবদা, আমি তো কখনো পারি নি……
তুমি টের পেয়েছিলে বুঝি যাবার আগেই? তাই এমন করে বারবার বলতে, আমার কিছু হলে কিংবদন্তীকে দেখে রাখিস তোরা…খুব ইচ্ছে হয়, কখনো কিংবদন্তীর সাথে দেখা হলে আমি ওর মাথায় হাত রেখে একবার শুধু বলবো, “জানিস, তোর বাবা কিন্তু কোথাও যায় নি, তোর মাঝেই বেঁচে আছে, দেখিস…”
কী লিখছি আবোল তাবোল জানি না, কিন্তু তোমার কাছে আমার তো লিখার কিছু নাই, শুধু বুঝি,
“পাগল রাগ করে চলে যাবে, ফিরেও আসবে না,
পাগল কষ্ট চেপে চলে যাবে, খুঁজেও পাবে না…”
যতবার এই গানটা শুনি, চোখের পানি ধরে রাখতে পারি না। এখনো তোমাকে খুঁজে বেড়াই সঞ্জীবদা, কারো গানে, কারো কথায়……
কিন্তু তোমার কথাই ঠিক, এখনো খুঁজে পাই নি, হয়তো পাবোও না, হাতের উপর হাতের পরশ রবে না, কখনোই না…
সঞ্জীবদা কেমন মানুষ যখন থেকে জানতে পেরেছি তখন থেকেই ভক্ত হয়ে গিয়েছিলাম। ছেলেদের সম্পর্কে একটা ফ্যান্টাসি ছিল ছোটবেলায়। ভাবতে ভাল লাগত, আমায় এমন একজন ভালবাসবে যে একটু এলোমেলো, পাগল পাগল টাইপের, ভবঘুরে আর দুষ্টু। সঞ্জীবদার ভেতর এর সবগুলো গুণ বিদ্যমান ছিল। তবু কেন জানি না, প্রেমিক হিসেবে চাওয়ার থেকে সঞ্জীবদাকে ভাই বা দাদা হিসেবে চিনেছি অনেক অনেক বেশি।
কত দুষ্টু-মিষ্টি গান যে ছিল সঞ্জীবদার! বাপ্পা আর সঞ্জীবদা কোন লাইভ অনুষ্ঠানে এলে তা নিয়ে কতই না দুষ্টুমি করত। মনে আছে, বাপ্পা একবার বলেছিল, “সঞ্জীবদা মানুষটা কিন্তু খুব দুষ্টু। বাজি গানে লিখেছে- তুমি ই প্রথম বলি না এমন, শেষ হতে পারো কি? আচ্ছা, এইটার মানে কি দাদা?”
সঞ্জীবদা মুচকি মুচকি হাসে। সেই হাসি আমি আজও চোখের সামনে দেখতে পাই!
শুধু গানই নয়। এই আজকেই তো বাপ্পা বললো যে সঞ্জীবদা না-কি জ্ঞানের একটা ভাণ্ডার ছিলো। ফিজিক্স, কেমস্ট্রি, অ্যাস্ট্রনমি, ইতিহাস, রাজনীতি কিসে দাদার জ্ঞান না ছিলো! আকাশের তারা দেখে না-কি দাদা প্রত্যেকটা তারার নাম বলতে পারত!
একটা মানুষ চলে গেলেই বুঝিবা বোঝা যায় যে আমরা কী হারালাম! কেন আগে সেটা বুঝতে পারে না কেউ?
সঞ্জীবদা চলে যাবার পরে প্রথম আলোতে বাপ্পার লেখাটা পড়ে খুব কেঁদেছিলাম। মৃত্যুর আগেও মনে হয় কেউ কেউ ঠিক বুঝতে পারে যে সময় ফুরিয়ে এসেছে। নাহলে সঞ্জীবদা সুন্দরবন ভ্রমনের অমন সুন্দর স্বর্গীয় একটা মুহূর্তে বাপ্পাকে কেন বলতে যাবে, “আমি চলে গেলে আমার মেয়েটাকে দেখবি তো?”
কেন মৃত্যুর আগে পরিবারের সাথে শেষ সেই ভ্রমনের সময় সঞ্জীবদার বারবার মনে হত কেউ তাকে ডাকছে! কেন অন্যমনস্ক হয়ে যেত সে খানিক পরপর?
যারা মুসলমান নয় তাদের মৃত্যুর পর না-কি তাদের জন্য প্রার্থনা করা যায় না। আমি জীবনে নিজের আপন মানুষ ছাড়া অন্য কোন মানুষের মৃত্যুতে এতটা ভেঙে পড়ি নি। শুধু যেদিন শুনলাম সঞ্জীবদা আর নেই, সেদিন সবকটা টিভি চ্যানেলের সব কয়টা খবর দেখেছি আর কেঁদেছি, আর আল্লাহকে বলেছি, “আল্লাহ আমি কি এই মানুষটার জন্য একটু দোয়া করতে পারি? অল্প একটু? এই মানুষটাকে আমরা কিছুই দিতে পারি নি, তুমি এই মানুষটাকে কি এইবার একটু শান্তিতে ঘুমুতে দিতে পারো? যদি খুব বেশি অন্যায় আবদার হয়ে যায় তো আমাকে ক্ষমা করো তুমি। কিন্তু আল্লাহ পারলে আমার প্রার্থনাটা তুমি কবুল করো প্লিজ, প্লিজ আল্লাহ প্লিজ!”
আমি ভাবতাম সঞ্জীবদার জন্য আমি একাই এমন করি, কিন্তু এখন বুঝলাম, আসলে আমিই না, আমার মতো হাজারো মানুষজন আছেন, বেঁচে থাকুন সঞ্জীবদা, আপনাদের মাঝে……
সঞ্জীবদা আসলেই একজন সঞ্জীবদা!
কেন যে মানুষটার প্রতি এতো শ্রদ্ধা জাগে, কে জানে!
সত্যি ভাই আমি আগে ভাবতাম সঞ্জীবদার জন্য আমি একাই এমন করি, কিন্তু এখন বুঝলাম, আসলে আমিই না, আমার মতো হাজারো মানুষজন আছেন,
সঞ্জীবদা বেঁচে আছেন, বেঁচে থাকবেন আপনার/আপনাদের মত এমন অগণিত ভক্তদের মাঝে!
সঞ্জীবদা বেঁচে থাকবেন বহুদিন, ভালো মানুষের যে বড়ো বেশি দরকার আমাদের…
মনটা খারাপ হল। মানুষ এভাবেই চলে যায় খালি।
বেশি কিছু বলার নেই। মন থেকে লিখেছিস বুঝা যায়।
মন খারাপ। মন খারাপ
জানিনা কেন, কিন্তু এই মানুষটার জন্য নিজের অজান্তেই আমার বুকের ভেতর এক সমুদ্র হাহাকার……
সঞ্জীবদার গান বা কবিতাগুলোর মাঝে কী যেন আছে! বুকের ভিতরটায় ঝড় বইয়ে দিয়ে যায় শান্ত ক’টা লাইন।
কেন যে এতো তাড়াতাড়ি চলে গেলেন।
তোর লেখাটা কেমন অন্যরকম হয়েছে রে। মনে হচ্ছে, উনাকে যা বলতে চাইতাম সবই বলে দিলি………
আর কারো গান শুনলে এমন লাগে না, জানি না কেন, শুধু জানি, উনার কন্ঠে আমাদের গান বেজেছে সারাজীবন, আমাদের সবার…
“আমি তোমাকেই বলে দেবো,
কী যে একা দীর্ঘ রাত –
আমি হেঁটে গেছি বিরান পথে;
আমি তোমাকেই বলে দেবো,
সেই ভুলে ভরা গল্প-
কড়া নেড়ে গেছি ভুল দরজায়;
ছুঁয়ে কান্নার রঙ, ছুঁয়ে জোছনার ছায়া”
“চোখটা এত পোড়ায় কেন,
ও পোড়া চোখ, সমুদ্রে যাও…
সমুদ্র কি তোমার ছেলে,
আদর দিয়ে চোখ মাখাও”
মানুষ পারে এগুলা গাইতে?? 🙁
কান্নার রঙ আজো খুঁজে ফিরি তার গানের মাঝে… কেন যেন মনে হয়, উনি বড় আপন…হয়তো উনার মতই হব একদিন…
বিধাতা আবার একই দিনেই জন্মদিন করেছেন…
খালি এক বুক হাহাকার…লেখাটা আত্মা বের করে আনলো আবারো !! :crying: :crying: :crying:
সঞ্জীবদার মতো হবার ইচ্ছে ছিলো বহুদিনের, বহু বছরের, এখনো আছে, থাকবেই…
অসাধারণ একটা পোস্ট! অসাধারণ!
চোখ ভিজে গেলোরে!
লিখাটা লিখবার সময় ভীষণ রকম কষ্ট হয়েছে, বলে বোঝাতে পারবো না কখনোই, ভীষণ রকম চাপা একটা কষ্ট, অজান্তেই চোখ ভিজে এসেছে বার বার…
জোস 🙂
ধন্যবাদ…
এত ইমোশনাল হয়েছে লেখাটা।
পড়তে পড়তে আরেকজনের কথা মনে পড়ে গেলো।
জানি না কার কথা আপনার মনে পড়েছে, কিন্তু সঞ্জীব’দা বরারবরই কেন জানি খুব আপন মনে হয়……
খুব বেশি…
“তবে এই হোক তীরে জাগুক প্লাবন।
দিন হোক লাবণ্য হৃদয়ে শ্রাবণ।
তুমি কান্নার রঙ, তুমি জোছনার ছায়া”
মানুষটার কবিতা লিখার ক্ষমতাটা ঈর্ষনীয় ছিলো……
“আগুনের কথা বন্ধুকে বলি দু’হাতে আগুন তারও,
কার মালা হতে খসে পড়া ফুল রক্তের চেয়ে গাঢ়,
যার হাতখানি পুড়ে গেল বধু আঁচলে তাহারে ঢাকো,
আজো ডানা ভাঙ্গা একটি শালিক হৃদয়ের দাবি রাখ।”
😀