অনুবাদ: ব্যর্থতা যখন কাম্য, কল্পনা যখন প্রয়োজনীয় – জে কে রোওলিং

[বিখ্যাত ‘হ্যারি পটার’ সিরিজের লেখিকা জে. কে. রোলিং-এর নাম শোনেন নি এমন মানুষ কমই আছেন। হার্ভার্ড অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের বার্ষিক মিটিঙে তার দেয়া উদ্বোধনী বক্তৃতার অনুবাদ এখানে দেয়া হল।]

শুরুতেই সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে নিচ্ছি। হার্ভার্ড যে আমাকে একটা অসাধারণ সম্মান দিয়েছে তাই নয়, আজকের এই বক্তব্য দেয়া নিয়ে দিনের পর দিন দুশ্চিন্তা করে আমার ওজনও কমে গেছে – দু’পক্ষেরই জয় হল আর কি! এখন আমাকে দুশ্চিন্তা ঝেড়ে ফেলে কেবল এ কথা ভেবে নিলেই চলবে যে আমি পৃথিবীর সবচাইতে বড় গ্রিফিন্ডর পুনর্মিলনীতে আছি।

কোন গ্র্যাজুয়েশনের অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দেয়াটাকে প্রথমে দারুণ কঠিন আর দায়িত্বপূর্ণ কাজ মনে হচ্ছিলো আমার, যতক্ষণ না নিজের গ্র্যাজুয়েশনের দিনের কথা মনে পড়েছে। সেদিন বক্তা ছিলেন বিখ্যাত ব্রিটিশ দার্শনিক ব্যারোনেস মেরী ওয়ারনক ((Baroness Mary Warnock))। তার বক্তব্য আমাকে আজকের জন্য প্রস্তুতি নিতে খুব সাহায্য করেছে। কারণ ভেবে দেখলাম, তার সেদিনের বলা একটা কথাও আমি মনে করতে পারছি না। এটা আবিষ্কার করে অন্তত একটা ব্যাপারে নিশ্চিত হলাম, আমার আজকের বক্তব্য আর যাই হোক, আইন, ব্যবসা কিংবা রাজনীতির সফল ক্যারিয়ার ছেড়ে তোমাদের কাউকে জাদুকর হতে ইন্ধন যোগাবে না।

দেখেছো? কয়েক বছর পর যদি তোমরা কেবল এই জাদুকরের কৌতুকটাও মনে রাখতে পারো, তবুও প্রমাণ হবে যে আমি ব্যারোনেসের চাইতে এগিয়ে আছি। আত্মোন্নয়নের পথে আমার প্রথম পদক্ষেপ!

সত্যি কথা বলতে কি, আজ তোমাদের সাথে কী কথা বলবো সেটা নিয়ে আমি এই ক’দিন আমার মন-মগজ হাতড়ে বেড়িয়েছি। ভেবেছি, নিজের গ্র্যাজুয়েশনের দিনে কোন্‌ কথাটা জানা আমার জন্য সবচাইতে জরুরি ছিল, আর সেদিন আর আজকের মাঝে পেরিয়ে যাওয়া একুশ বছরে আমি কী শিখেছি।

দুটো উত্তর পেয়েছি আমি। ঠিক করেছি, আজ যখন আমরা তোমাদের সাফল্য উদ্‌যাপনের জন্য একসাথে হয়েছি, তখন আমি তোমাদেরকে জীবনে ব্যর্থ হবার গুরুত্ব সম্পর্কে জানাবো। আজ যখন তোমরা বাস্তবজীবনের দোরগোড়ায় এসে দাঁড়িয়েছো, আমি তখন তোমাদেরকে শোনাবো কল্পনাশক্তির অভাবনীয় প্রয়োজনীয়তার কথা।

কথাগুলোকে আপাতত একটু ধাঁধাঁর মতো লাগতে পারে। ধৈর্য ধরে শোনো, বলছি।

গ্র্যাজুয়েশন ডে-র সেই ২১ বছরের আমার কথা ভাবাটা আজকের এই ৪২ বছরের আমার জন্য খানিকটা অস্বস্তিকর, সেই আমার কথা যাকে জীবনের ঠিক অর্ধেক সময় আগেই তার জীবনের লক্ষ্য নিয়ে নিজের আর কাছের মানুষদের আশা-আকাঙ্ক্ষা সামাল দিতে হিমসিম খেতে হচ্ছিলো।

আমার একমাত্র আগ্রহের জায়গা যে উপন্যাস লেখা, সে ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলাম আমি। তবে বাবা-মার কাছে আমার অতিসক্রিয় কল্পনাশক্তিকে একটা হাস্যকর স্বভাব ছাড়া আর কিছুই মনে হয় নি কখনো, যা দিয়ে না কখনো পেনশন যোগানো যাবে, আর না ধার শোধ করা যাবে। প্রসঙ্গত, তারা দুজনেই চরম দারিদ্র্যের মাঝে বড় হয়েছিলেন, আর কেউই কলেজে যান নি। তবে জানি, তাদের সেই বিদ্রুপটা আজ কেমন শোনাচ্ছে।

তারা চেয়েছিলেন আমি যেন কারিগরিতে ডিগ্রি নেই, আর আমি চাইলাম ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়তে। শেষমেষ কারোরই মন রক্ষা হল না, আমি আধুনিক ভাষা নিয়ে পড়া শুরু করলাম। আর কলেজের রাস্তার বাঁকে বাবা-মার গাড়ি চোখের আড়াল হতে না হতেই জার্মান পড়া শিকেয় তুলে আমি ক্ল্যাসিকের গলিঘুপচিতে ঘুরে বেড়াতে লাগলাম।

তবে এমনটা ভাবার কারণ নেই যে বাবা-মাকে আমি তাদের দৃষ্টিভঙ্গির জন্য দোষারোপ করছি। তোমাকে ভুল পথে নিয়ে যাওয়ার দায় বাবা-মার ওপর চাপানোর একটা সময়সীমা আছে। নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নেয়ার মতো বয়স হবার পর কারো কাজের দায় তার ওপরই আসে। তাছাড়া আমাকে কখনো অভাবে পড়তে হবে না, এমনটা ভেবে আমি তাদের সমালোচনা করতে পারি না। তারা দুজনেই অভাবী ছিলেন, আর সে সময় থেকে আমিও। আর এটা যে খুব সম্মানজনক কিছু না সে ব্যাপারেও আমি তাদের সাথে একমত। অভাবের সাথে আসে ভয়-ভীতি, দুশ্চিন্তা, মানসিক চাপ; গরীব হওয়ার অর্থ হাজারো অসম্মান আর কষ্ট সহ্য করা। নিজের চেষ্টায় অভাবকে জয় করতে পারা নিঃসন্দেহে গর্বের ব্যাপার, কিন্তু দারিদ্র্য নিয়ে কল্পনাবিলাস – সেটা কেবল বোকাদের পক্ষেই সম্ভব।

তোমাদের বয়সে যে জিনিসটাকে আমি সবচেয়ে বেশি ভয় করতাম, সেটার নাম অভাব নয় – ব্যর্থতা।

সে বয়সে ক্লাসে লেকচার শোনার তুলনায় কফি বারে বসে গল্প লিখেই আমি বেশি সময় কাটিয়েছি। তবু, বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে উৎসাহের কমতি থাকার পরও, পরীক্ষা পাসের গুণ ছিল আমার – যেটা তারপরের বেশ কিছু বছর ধরেই আমার আর আমার সহপাঠীদের সাফল্যের মাপকাঠি ছিল।

বয়সে তরুণ, ভাগ্যবান আর শিক্ষিত বলেই যে তোমরা কখনো ব্যর্থতার মুখোমুখি হও নি, এমনটা ভাবার মতো বোকা আমি নই। প্রতিভা কিংবা বুদ্ধিমত্তা কখনোই কাউকে ভাগ্যের খামখেয়াল থেকে বাঁচাতে পারে না, তাই আমি ভাবছি না যে তোমরা প্রত্যেকেই আজ পর্যন্ত অবিরত সুখ-সুবিধা ভোগ করে এসেছো।

তবে তোমরা যেহেতু হার্ভার্ডে পড়েছো, তার মানে ব্যর্থতার সাথে খুব বেশি পরিচয় তোমাদের নেই। ব্যর্থ হবার ভয়, আর সাফল্যের আকাঙ্ক্ষা – এ দুটো তোমাদের মাঝে সমানভাবেই আছে। তোমরা এতটাই সফল, যে ব্যর্থতা নিয়ে তোমাদের ধারণা, আর সাফল্য নিয়ে যে কোন সাধারণ মানুষের ধারণার মাঝে তেমন তফাৎ নেই।

ব্যর্থতা কী সেটা জানার জন্য আমাদের নিজেদেরকেই তা উপলব্ধি করতে হয়, আর পৃথিবীকে যদি তুমি সুযোগ দাও, তবে সে একে চেনার কিছু উপায় তোমাকে শিখিয়ে দেবে। তাই যে দৃষ্টিকোণ থেকেই দেখি না কেন, আমার ধারণা গ্র্যাজুয়েশনের সাত বছরের মাঝেই আমি এক মহাকাব্যিক ব্যর্থতার শিকার হয়েছি। একেবারেই ক্ষণস্থায়ী একটা বিয়ের পর একই সাথে আমি হয়ে পড়লাম চাকরিহারা, একলা মা আর থাকার জায়গা না হারিয়ে আজকের ব্রিটেনে যতখানি অভাবী হওয়া সম্ভব। আমাকে নিয়ে বাবা-মা আর সেই সাথে আমার নিজের আশঙ্কাও সত্যি হল। আমি তখন পর্যন্ত নিজের দেখা সবচাইতে ব্যর্থ মানুষ।

ব্যর্থ হওয়াটা খুব আনন্দের ব্যাপার – এমন কথা আমি তোমাদেরকে কখনোই বলবো না। ওটা ছিল আমার জীবনের এক ভয়ঙ্কর অধ্যায়। আর প্রেস তখনকার যে সিদ্ধান্তটাকে এখন রূপকথার গল্পের মতো করে উপস্থিত করছে, সে বিষয়েও বিন্দুমাত্র ধারণা ছিল না আমার। টানেলটা কতখানি দীর্ঘ সে সম্পর্কে কোন ধারণা তো ছিলই না, বরং টানেলের শেষ প্রান্তে আলোর দেখা পাওয়া যতটা না বাস্তব ছিল, তার চেয়েও বেশি ছিল আশা।

তাহলে আমি তোমাদের কাছে ব্যর্থতার গুণগান করছি কেন? কারণ, এটা জীবন থেকে অদরকারি যা কিছু, সেসবকে কাটছাঁট করে দেয়। যে সময়কার কথা বললাম, তারপর থেকেই আসলে যা নই তা হওয়ার চেষ্টা করা বন্ধ করেছিলাম আমি। আর নিজের সব ক্ষমতা দিয়ে সেই একটা মাত্র কাজে মনোনিবেশ করেছিলাম যেটা আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। অন্য কোনখানে সফল হলে দেখে যেতো আমি নিজের এই একমাত্র সম্ভাবনার জায়গাটাতে সফল হবার, তার চেষ্টা করার মতো মনোবল কখনোই পেতাম না। একমাত্র সবচেয়ে বড় ভীতি সত্য হবার পর এক কথায় আমার মুক্তি মিলেছিল। আমি যে তখনো বেঁচে ছিলাম সেই উপলব্ধি, একমাত্র আদরের মেয়ে, একটা পুরনো টাইপরাইটার আর দারুণ এক আইডিয়া – এসবের ওপরেই আমার নতুন জীবনের ভিত রচনা করেছিলাম।

আমার মতো এত বড় ব্যর্থতার মুখোমুখি হয়তো তোমাদের হতে হবে না, কিন্তু জীবনে কিছু কিছু ব্যর্থতা এড়ানো একেবারে অসম্ভব। একেবারেই ব্যর্থ না হয়ে বেঁচে থাকা সম্ভব নয়, যদি না তুমি এতটাই সতর্ক থাকো যাতে করে বেঁচে থাকা না থাকায় কিছু আসে যায় না। অমন হলে তো ব্যর্থতা আপনাতেই চলে আসে।

পরীক্ষায় পাস করে যা আমি কখনোই অর্জন করতে পারি নি, সেই নিরাপত্তাবোধ ব্যর্থতা আমাকে দিয়েছে। নিজের সম্পর্কে আমাকে এমন কিছু জানিয়েছে যা অন্য কোনভাবে জানা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। আমার যে দৃঢ় ইচ্ছাশক্তি, আশাতীত শৃঙ্খলাবোধ আর দারুণ মূল্যবান কিছু বন্ধু আছে – এসবই আমি তখন আবিষ্কার করেছি।

প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবেলা করে তুমি পুরনো তোমার চাইতে বিচক্ষণ আর যোগ্য হয়ে ফিরে এসেছো, এই তথ্য তোমার টিকে থাকার ক্ষমতাকে নিশ্চিত করবে, নিজের কাছেই। দুঃখ-দুর্দশায় পরীক্ষিত না হলে তুমি কখনো নিজেকে ভালোভাবে চিনতে কিংবা অন্যদের সাথে তোমার সম্পর্কগুলোর দৃঢ়তা সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারবে না। এই উপলব্ধি, একে অর্জন করতে যত ব্যর্থতা আর কষ্ট সইতে হয় তার পুরস্কার, যার চাইতে মূল্যবান কোন যোগ্যতা আমি আর অর্জন করি নি।

তাই একটা টাইম-টার্নার ((http://harrypotter.wikia.com/wiki/Time-Turner)) হাতে পেলে সেই ২১ বছরের আমাকে আজ আমি বলতাম, জীবন যে কতগুলো অর্জন আর প্রাপ্তির তালিকাই শুধু নয় – এটা জানার মধ্যেই ব্যক্তিগত সুখ নিহিত। তোমার যোগ্যতাগুলো তোমার জীবন নয়, যদিও আমার সমান কিংবা আমার চেয়ে বেশি বয়সী অনেককেই তোমরা এ দুটোকে গুলিয়ে ফেলতে দেখবে। জীবন দারুণ জটিল আর কঠিন, আর যে কারো নিয়ন্ত্রণের বাইরে – এ জিনিসটা স্বীকার করার মত বিনয়ই তোমাকে এর উত্থান-পতনগুলোকে সয়ে নেয়ার শক্তি দেবে।

এখন তোমাদের মনে হতে পারে, আমার কথার দ্বিতীয় বিষয়বস্তু ‘কল্পনা’ হবার কারণ এটা আমাকে জীবনকে নতুন করে গড়তে সাহায্য করেছে। কিন্তু ব্যাপারটা পুরোপুরি তা নয়। যদিও আমি আমার শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত রূপকথার গল্পগুলোর পক্ষে কথা বলে যাব, তবে কল্পনাকে আমি এর চাইতেও বড় পরিসরে মূল্য দিতে শিখেছি। কল্পনা শুধু মানুষের অসম্ভবকে দৃশ্যমান করার স্বতন্ত্র ক্ষমতাই নয় (যেটা সব উদ্ভাবন আর নতুনের উৎস), বরং এর সবচেয়ে রূপান্তরযোগ্য আর উন্মোচক ক্ষমতা হচ্ছে আমাদেরকে সেসব মানুষের মত করে ভাবতে শেখানো যাদের অভিজ্ঞতাগুলো আমাদের কখনো হয় নি।

আমার জীবনের সবচাইতে গঠনমূলক অভিজ্ঞতাটা হ্যারি পটার লেখারও আগে ঘটেছিল, যদিও এ অভিজ্ঞতা আমাকে যা শিখিয়েছে তার অনেক কিছুই ঐ বইগুলোতে পাওয়া যাবে। এই স্ফূরণ এসেছিল আমার একেবারে প্রথম দিককার এক চাকরির রূপ ধরে। ২০-২২ বছর বয়সে আমি লন্ডনে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল সদর দপ্তরের আফ্রিকান রিসার্চ ডিপার্টমেন্টে কাজ করে বাড়িভাড়া পরিশোধ করেছি (সাথে দুপুরে খাবার সময় গল্প লেখার জন্য পালানোও অব্যাহত ছিল বৈকি!)।

সেখানে আমার ছোট্ট অফিসটাতে বসে আমি কিছু মানুষের এলোমেলো হাতে লেখা চিঠিগুলো পড়তাম, যেগুলো লেখা হয়েছিল স্বৈরাচারী শাসকের চোখ এড়িয়ে। এরা বাইরের পৃথিবীকে তাদের অবস্থার কথা জানানোর জন্য কারাবাসের ঝুঁকি নিয়েও এ কাজগুলো করতেন। সামান্যতম চিহ্নও না রেখে উধাও হয়ে যাওয়া মানুষদের ছবি দেখেছি আমি তখন, তাদের পাগলপ্রায় আত্মীয়-স্বজনদের পাঠানো ছবি। নির্যাতনের শিকার মানুষগুলোর সাক্ষ্য শুনেছি, আর তাদের আঘাতের ছবি দেখেছি। আমি বিচার, মৃত্যুদণ্ড, অপহরণ আর ধর্ষণের চাক্ষুষ, হাতে লেখা বর্ণনা পড়েছি।

আমার অনেক সহকর্মীই ছিলেন প্রাক্তন রাজনৈতিক বন্দী, নিজেদের সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলার অভিযোগে বাস্তুহারা হতে কিংবা নির্বাসনে যেতে হয়েছিল যাদেরকে। আমাদের অফিসে কেউ আসতেন খবরাখবর দিতে, কিংবা যাদের তারা পিছে ফেলে এসেছেন তাদের খোঁজ-খবর নিতে।

নির্যাতনের শিকার আমার বয়সী সেই আফ্রিকান যুবকটিকে আমি কখনোই ভুলবো না, যে তার নিজের দেশে অনেক কিছু সহ্য করার পর মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলো। একটা ভিডিও ক্যামেরার সামনে নিজের ওপর চালানো অকথ্য নির্যাতনের বর্ণনা দেয়ার সময় তিনি দারুণভাবে কাঁপছিলেন। আমার চেয়ে এক ফুট লম্বা মানুষটাকে একটা শিশুর মত দুর্বল লাগছিলো তখন। পরে তাকে আন্ডারগ্রাউন্ড স্টেশনে ফিরিয়ে নিয়ে যাবার দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল আমার ওপর; আর এই মানুষটা, নিষ্ঠুরতা যার জীবনকে ধ্বংস করে দিয়েছে, নিখুঁত সৌজন্যের সাথে আমার হাত ধরে আমার সুখ কামনা করেছিলেন।

আর যতদিন বেঁচে থাকবো, আমার মনে পড়বে সে ঘটনার কথা যখন আমি একটা ফাঁকা করিডোর ধরে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ বন্ধ দরজার ওপাশ থেকে বেদনা আর আতঙ্কমাখা এমন এক চিৎকার শুনেছিলাম যেমনটা তারপর আর কখনো শুনি নি। দরজা খুলে গেলে তদন্তকারিনী তার মাথা গলিয়ে আমাকে বলেছিলেন দৌড়ে গিয়ে তার সাথে বসে থাকা ছেলেটির জন্য গরম পানীয় নিয়ে আসতে, এইমাত্র যাকে খবর জানানো হয়েছিল যে, তার দেশের সরকারের বিরুদ্ধে তারই স্পষ্টবাদিতার জন্য তার মাকে ধরে নিয়ে গিয়ে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে।

আমার ২০-২৫ বছর বয়সের সময়কার চাকরিজীবনের প্রতিটা সপ্তাহের, প্রতিটা দিনে আমি নতুন করে জেনেছি কত অবিশ্বাস্য রকমের ভাগ্যবান আমি। ভাগ্যবান কারণ আমার দেশে জনগণের ভোটে নির্বাচিত একটা সরকার আছে, ভাগ্যবান কারণ আমার দেশে প্রত্যেকের আইনের আশ্রয় আর সুষ্ঠু বিচার পাবার অধিকার আছে।

প্রতিদিন আমাকে নতুন নতুন উপায় দেখতে হতো, ক্ষমতা পাবার আর তা টিকিয়ে রাখার জন্য মানুষ মানুষের প্রতি কতটা নিষ্ঠুর হতে পারে। দিনে যা আমি পড়তাম, শুনতাম, দেখতাম; রাতে তা দুঃস্বপ্ন হয়ে ফিরে আসতো।

তবে সেই সাথে মানুষ কতটা ভালো হতে পারে, সেটাও জানতে পেরেছি অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালে আমার সেই দিনগুলোতে।

নিজেদের বিশ্বাসের জন্য কখনো কারারুদ্ধ কিংবা নির্যাতিত হয় নি, এমন অজস্র মানুষকে অ্যামনেস্টি সেসব মানুষদের জন্য কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করেছে যাদের সাথে এমনটা হয়েছে। মানুষের সহমর্মিতা আর তার ফলশ্রুতিতে অনেকের সম্মিলিত যে কাজ, তা অনেকের জীবন বাঁচায়, বন্দিদের মুক্ত করে। ব্যক্তিগত নিরাপত্তা আর ভাল থাকাটা পুরোপুরি নিশ্চিত যাদের, এমন বিশালসংখ্যক মানুষ একসাথে হয়ে তাদেরকে বাঁচানোর জন্য কাজ করে, যাদের তারা চেনে না, যাদের সাথে তাদের হয়তো বা কখনো দেখাও হবে না। এই প্রক্রিয়ায় ছোট্ট অংশগ্রহণ আমার জীবনের সবচাইতে উৎসাহ আর কৃতজ্ঞতা জাগানিয়া অভিজ্ঞতাগুলোর একটা।

এই গ্রহের অন্য কোন সৃষ্টির যে ক্ষমতা নেই, এমন ক্ষমতা মানুষের আছে – যে সে অভিজ্ঞতা ছাড়াই কোন কিছু শিখতে আর বুঝতে পারে। সে নিজের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন অবস্থানের একজন মানুষের জায়গা থেকে চিন্তা করতে পারে।

তবে হ্যাঁ, আমার তৈরি গল্পের জাদুর মতো এটাও এমন একটা ক্ষমতা যেটা নৈতিকভাবে নিরপেক্ষ। এই ক্ষমতাকে কেউ যেমন অন্যদের বুঝতে কিংবা সহমর্মী হতে ব্যবহার করতে পারে, ঠিক তেমনি মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করতেও।

আবার অনেকে আছে যারা নিজের কল্পনাশক্তিকে ব্যবহার করতে মোটেও আগ্রহী না। নিজেদের অভিজ্ঞতার গণ্ডিতে নিশ্চিন্তে বসে থাকতেই তাদের সুখ, তাদের যে অবস্থায় জন্ম হয়েছে তার অন্যথা হলে পরিস্থিতি কেমন হতো সে ব্যাপারে বিন্দুমাত্র ভাবারও অবকাশ নেই এদের। তারা কারো আর্তচিৎকার শুনতে কিংবা বদ্ধ খাঁচায় উঁকি দিতে না চাইতে পারে; তারা তাদেরকে স্পর্শ করে না এমন সব কষ্ট থেকে হৃদয়-মনকে দূরে রাখতে পারে; তারা অনায়াসে কোন কিছু না জেনে থাকতে পারে।

আমার যদি এমনটা মনে হতো যে, এসব মানুষের দুঃস্বপ্নগুলো সংখ্যা কিংবা তীব্রতায় আমারগুলোর চাইতে কম ভয়াবহ, তবে হয়তো আমার ইচ্ছে জাগতো তাদের হিংসে করতে। তবে বদ্ধ আর সংকীর্ণ জায়গায় থাকলে মনের মধ্যে আপনাতেই একরকম ভয় আর আতঙ্কের জন্ম হয়। ইচ্ছে করেই যারা অকল্পনাচারী থাকে, আমার মতে তাদের ভয়ের পরিধি আরো বেশি। তারা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আরো বেশি ভীতু হয়।

তার চেয়েও বড় কথা যেটা, যারা সহানুভূতিশীল হতে চায় না, তারা নিজেদের মাঝে সত্যিকারের দানবের জন্ম দেয়। কারণ কখনো সরাসরি কোন খারাপ কাজে অংশ না নিয়েও তারা এর মাঝে তলিয়ে যায়, নিজেদের উদাসীনতার কারণে।

১৮ বছর বয়সে ক্ল্যাসিকের যে পথ ধরে আমি এমন কিছুর সন্ধানে হাঁটা শুরু করেছিলাম যা সে সময় টের পাই নি, সে পথে চলতে গিয়ে শেখা অনেক কিছুর মাঝে গ্রিক লেখক প্লুটার্কের ((Plutarch)) এ কথাটাও একটা: “আমরা অন্তর্গতভাবে যা কিছু অর্জন করি তা বাইরের পৃথিবীকে পরিবর্তন করতে পারে।”

এই আশ্চর্য কথাটার সত্যতা আমাদের প্রতিদিনকার জীবনেও হাজারবার করে প্রমাণিত হয়। বাইরের পৃথিবীর সাথে আমাদের যে অনিবার্য সম্পর্ক, শুধু বেঁচে থেকেই যে আমরা কেমন করে অন্যদের জীবনকে কোন না কোনভাবে ছুঁয়ে দেই – এ কথাটা তাই মনে করিয়ে দেয়।

কিন্তু তোমরা, ২০০৮-এ হার্ভার্ড থেকে যারা গ্র্যাজুয়েশন শেষ করছো, অন্যদের জীবনকে তোমরা কতখানি ছুঁতে পারবে? তোমাদের মেধা, তোমাদের পরিশ্রম করার ক্ষমতা, তোমাদের অর্জিত আর প্রাপ্ত শিক্ষা – এসব তোমাদেরকে অনন্য করে তুলেছে; সেটা অবস্থানের দিক থেকেই না শুধু, দায়িত্বের দিক থেকেও। এমনকি তোমাদের জাতীয়তাও তোমাদেরকে অন্যদের থেকে আলাদা করেছে। বর্তমান বিশ্বের একমাত্র মহাশক্তি যে দেশ, তোমাদের বেশিরভাগ সেখান থেকে এসেছো। তোমরা যেভাবে ভোট দেবে, যেভাবে জীবন যাপন করবে, যেভাবে প্রতিবাদ করবে, তোমাদের সরকারকে যেভাবে চাপ দেবে, তার ফলাফল তোমাদের দেশের সীমানার বাইরেও প্রভাব ফেলবে। এটা একই সাথে তোমাদের সুযোগও, আবার বোঝাও।

তোমরা যদি তোমাদের ক্ষমতা আর অবস্থানের জোরে তাদের হয়ে কথা বলো যাদের ভাষা নেই; যদি তোমরা নিজেদেরকে কেবল শক্তিশালীদের অন্তর্ভুক্ত না করে শক্তিহীনদের একজনও মনে করো; যারা তোমাদের মতো ভাগ্যবান নয় তোমরা যদি তাদের অবস্থানে নিজেদের কল্পনা করো, তবে কেবল তোমাদের গর্বিত পরিবারই না, তোমরা যাদের জীবন পালটে দেবে সেই লাখো মানুষ তোমাদের অস্তিত্বের জন্য নিজেদের ধন্য মনে করবে। পৃথিবীকে বদলে দেবার জন্য আমাদের জাদুর দরকার নেই; এ জন্য যে ক্ষমতা দরকার তা ইতোমধ্যেই আমাদের ভেতরে আছে, সেটা হল কল্পনা করার ক্ষমতা।

আমার বক্তব্যের শেষে তোমাদের একটা আশার কথা বলবো, ২১ বছর বয়সে আমার যা ছিল। গ্র্যাজুয়েশন ডে-তে যাদের সাথে আমি বসেছিলাম, তারা আমার সারা জীবনের বন্ধু। আমার বাচ্চাদের অভিভাবক, আমার বিপদের সহায় এই মানুষগুলো, Death Eater ((http://en.wikipedia.org/wiki/Death_Eater)) হিসেবে তাদের নাম ধার নেয়ার পরও যারা আমার নামে মামলা ঠুকে দেয় নি। এক গাঢ় অনুরাগ আর ফেলে আসা দিনগুলোর মিলিত স্মৃতির এক অটুট বন্ধনে আবদ্ধ ছিলাম সেদিন আমরা।

আজ তোমাদের জন্য অমন বন্ধুত্বের চাইতে ভালো আর কিছু চাওয়ার নেই আমার। আর আগামীকাল আমার বলা একটা কথাও যদি তোমাদের মনে না থাকে, তবু সেনেকা নামের সেই বুড়ো রোমানের কথাটা মনে রেখো, ক্যারিয়ারের সিঁড়ি থেকে পালিয়ে প্রাচীন প্রজ্ঞার খোঁজে ক্ল্যাসিকের অলিতে গলিতে ঘুরে বেড়ানোর সময় যার সাথে আমার দেখা: “জীবন একটা গল্পের মতো; তা কত দীর্ঘ সেটা নয়, বরং কতটা ভালো সেটাই বড় কথা।”

আমি তোমাদের সবার অনেক ভালো জীবন কামনা করি। অনেক ধন্যবাদ।

মূল লেখার লিঙ্ক: ((http://harvardmagazine.com/2008/06/the-fringe-benefits-failure-the-importance-imagination))

সামিরা সম্পর্কে

পীচ-গলা তরলে আটকে পা, দুঃস্বপ্ন অন্ধ দুই চোখে/ অসতর্ক হৃদয় পোষ মানে মিথ্যে বলার আফসোসে.../// প্রকাশিত লেখার কপিরাইট সংশ্লিষ্ট লেখক সংরক্ষণ করেন এবং লেখকের অনুমতি ছাড়া লেখা আংশিক বা পূর্ণভাবে কোন মিডিয়ায় পুন:প্রকাশ করা যাবে না।
এই লেখাটি পোস্ট করা হয়েছে অনুপ্রেরণা, অনুবাদ, ইতিবাচক, চিন্তাভাবনা, সচেতনতা-এ এবং ট্যাগ হয়েছে , , , , , স্থায়ী লিংক বুকমার্ক করুন।

23 Responses to অনুবাদ: ব্যর্থতা যখন কাম্য, কল্পনা যখন প্রয়োজনীয় – জে কে রোওলিং

  1. স্বপ্ন বিলাস বলেছেনঃ

    এতো সুন্দর একটা ভাষণ। ভাষণ শব্দটা কেমন যেন কঠিন এই কথাগুলোর জন্য। জীবনটাকে কী ভিন্ন একটা দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা! অপূর্ব!

    আর, অনুবাদ তো খুবই ভালো হয়েছে।

    • সামিরা বলেছেনঃ

      আসলেই অসাধারণ একটা স্পীচ।
      অনুবাদ করতে গিয়ে এত্তবার পড়ছি, মুখস্থ হয়ে গেছে প্রায়। 😀
      ধন্যবাদ ভাইয়া। 🙂

  2. নীল রঙ পরী বলেছেনঃ

    আবারও আপনার লেখা পেলাম আপু.. এই ধরণের লেখাগুলোর জন্যই বসে থাকি…
    যত হতাশা থাকে এক নিমিষে কেমন করে যেন ধুয়ে নিয়ে যায় এই লেখাগুলো।

    অনেক ধন্যবাদ আপু। এমন একটা অনুবাদের জন্য। আরও বেশি বেশি এরকম লেখার প্রত্যাশায়…

  3. প্রথম-নাম বলেছেনঃ

    সামীরাঃ খুব সুন্দর হয়েছে অনুবাদ। ধন্যবাদ!

    হার্ভার্ড থেকে বের হওয়া ছাত্র-ছাত্রীরা হয়তো প্রায় সবাই উন্নত বিশ্বের ‘নিশ্চিত জীবন’ যাপন করবে। ব্যর্থতা, জীবণের ঝুঁকি বা বেসিক হিউম্যান রাইটস থেকে বঞ্চনা – এগুলো কি, সে সম্পর্কে তাদের জানার ইচ্ছা বা সুযোগ দুটোরই অভাব আছে সেই ‘নিশ্চিত’ জীবনে। রাউলিং-এর এই কথাগুলো তাদের জন্য তাই খুবই ইম্পোর্টেন্ট।

  4. বোহেমিয়ান বলেছেনঃ

    আমার কাছে এই পোস্টটা মনে হচ্ছে বাংলা ব্লগের জন্যই একটা চমৎকার উপহার। এত বড় এবং কঠিন একটা লেখার অনুবাদ! 😀

    দারুণভাবে অনুপ্রেরণাদায়ক।

  5. অরণ্য নীলিন বলেছেনঃ

    বোহেমিয়ানের সাথে সহমত, অনুবাদ অনেক ভালো হইছে। 😀

  6. ইতস্তত বিপ্লবী বলেছেনঃ

    কেবল আমার প্রিয় লেখিকার কথা বলেই নয়, অসম্ভব সুন্দর এই ভাষণটা কিছু সত্য কথা জানিয়েছে, যা খেয়াল না করলে কারো পক্ষে জানা সম্ভব নয়!

    অনুবাদককে ধন্যবাদ না দিলে অন্যায় হয়!

  7. বাবুনি সুপ্তি বলেছেনঃ

    একেবারেই না বুঝেই নিজের ইচ্ছে মতই চলেছি। তাই হয়ত তেমন কিছু হতে পারিনি। কিন্তু স্বপ্ন দেখি অনেক।
    জে. কে. রাওলিং বলা কথা গুলো মন ছুয়ে গেল। লেখা আর লেখিকাকে কিছুতেই আমি আলাদা করতে পারি না। কত স্বপ্নই না আছে তার কল্পনার দুনিয়ায়। কিন্তু তাও বাস্তবের অনেক কিছুই জুড়ে থাকে সেই কল্পনায়।

    সামিরা তুমি খুব সুন্দর কাজ করেছো। 🙂 এমনি অনুবাদ চালিয়ে যাও।

  8. রাইয়্যান বলেছেনঃ

    সামিরাপু’র লেখায় বানান ভুল ধরসি!!! ইয়াপ্পপিইইই xD xD

  9. সব সফল মানুষ থেকে আমরা একটাই মেসেজ পাচ্ছি, পেশান অনুযায়ী কাজ না করলে আমরা সফল হতে পারি না। এখানে নতুন যেটা জানা হল তা হচ্ছে, ব্যর্থ না হলে আমরা নিজেদের পেশানকেও চিনতে পারি না। আর কল্পনা ? আমার প্রিয় লেখক , স্টিফেন কভি তো বলেন , সব কিছুই তৈরি হয়, দুই ধাপে। প্রথমে কল্পনায়, পরে বাস্তবে। তাই যাদের কল্পনা শক্তি নাই বা থাকলেও কাজে লাগায় না, তারা নতুন কিছুই করতে পারে না। আর নতুন কিছু না করলে উন্নতি হয় না, অগ্রগতি হয় না। মানে কল্পনাশক্তির ব্যবহার ছাড়া উন্নয়ন অসম্ভব।

    অনুবাদ কেমন হয়েছে সেটা বলার মত যোগ্যতা আমার নাই। তা ছাড়া মুল লেখাও পড়া হয় নাই। তবে এই অনুবাদ থেকে সবাই কিছু শেয়ার করার মত পেয়েছে, তা ফেসবুক শেয়ার সংখ্যাই বলে দিচ্ছে। এখানেই অনুবাদকের সার্থকতা। অনুবাদক কে ধন্যবাদ দিয়ে খাটো করার প্রয়োজনীয়তা বোধ করছি না।

    সামনে আরও এরকম পড়তে চাই।

  10. অদ্ভুত ছেলে বলেছেনঃ

    রোলিং এর কথাগুলো আসলেই অনুপ্রেরণাদায়ক।
    অনুবাদ দারুন লেগেছে 😀

  11. আপু, আমি আমার নিজের ব্লগে আপনার এই লেখাটি এবং “কাজ আর সত্য, ঘৃণা আর প্রেম (অনুবাদ)” লেখাটি সংগ্রহে রাখতে চাই। অবশ্যই আপনার নামসহ 🙂 অনুমতি দিলে বাধিত থাকবো……….

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।