রূপকথাঃ হ্যামেলিনের হারমোনিকা

[আমার অসম্ভব প্রিয় একটা সাহিত্যকর্ম হল রূপকথা। ছোটবেলায় কমবেশি সবাই এর স্বাদ পেয়েছি। অনেক দিন আগে ঘটা কাহিনী নিয়ে রূপকথা লিখা হয়, আমি চেষ্টা করলাম ওরকম একটা গল্পের অনুকরণে ভবিষ্যৎকালের একটা রূপকথা লিখার। যদি মনে হয় ওই রূপকথাগুলোর মত করে খানিকটা হলেও পাঠকের মন ছুঁয়ে গিয়েছে, তবে আরও লিখার আশা রাখি!]

 

প্রায় এক হাজার বছর পরের পৃথিবীর একটা শহর। নাম হ্যামেলিন।

 

শহরটার দুটি বিশেষত্ব আছে।

প্রথমটি, লাল গোলাপ। পৃথিবীতে কেবলমাত্র এই একটি শহরে লাল গোলাপ ফোটে। এখানকার অধিবাসীরা সবাই লাল গোলাপ চাষ করে। এটা পৃথিবীর সর্বত্র রপ্তানি হয়। লাল গোলাপ চাষ এখানকার প্রধান জীবিকা।

দ্বিতীয়টি, অদ্ভুত এক রোগ- বিষণ্নতা। কোন কারণ ছাড়াই তারা বিষণ্ন থাকে। জীবনের যেসব মুহূর্তে খুশি হওয়ার কথা, তারা হতে পারে না। আনন্দের অনুভূতি যে একেবারেই আসে না তা নয়, কিন্তু সেটা ২-৩ মিনিটের বেশি একটানা থাকে না। আর এমন ঘটনাও কালে ভদ্রে আসে। গ্রহের নানা প্রান্ত থেকে অনেক চিকিৎসক  এসে চেষ্টা করেছেন- সফল হননি।

 

শহরটির প্রধান নেতা এখন একজন নারী- নাম আদ্রিতা। বয়স কুড়ি পেরিয়েছে, চেহারার লাবণ্যের ছটা দিতে বিধাতা কার্পণ্য করেননি। চুল নিকষ কালো, ঝর্ণার মত স্বাধীনতা দিলে কোমর পর্যন্ত চলে আসে। সবচেয়ে আকর্ষণীয় তার হাসি, ঠিক স্বর্গের অপ্সরীদের মত, সবচেয়ে মূল্যবান বলেই হয়ত, এটা দুষ্প্রাপ্য। নিজেও যে বিষণ্নতা বলয়ের বাইরে নয়!

শহরের সুন্দর এবং সুঠাম দেহবিশিষ্ট উচ্চ মর্যাদার যুবকদের প্রতি তার আকর্ষণ অপিরণত কিংবা অপূর্ণ কোনটাই নয়, যদিও ব্যাপারটা সে গোপন রাখে!

মন খারাপ করে বছরের শেষ চাঁদটাকে স্বাগত জানায় আদ্রিতা। রাতটা নিঃসঙ্গ কাটানোর ইচ্ছা। হাজার বছর আগেও মানুষ এই দিনে ফুর্তি করত, পরে বিষণ্নতায়ও আক্রান্ত হত। পার্থক্য, হাসিমুখ আর সহজে দেখা যায় না, আগে নাকি মানুষ অসাধারণ অভিনয় করতে পারত, বুকে ব্যথার মহাসমুদ্র নিয়েও অট্টহাসি হাসত! আজ আর পারে না, মানুষ অনেক দুর্বল হয়ে গেছে!

 

আদ্রিতার বাসভবনের গেটের বাইরে তখন এলোমেলো চুলের একটি ছেলে এসে দাঁড়ায়। ঠাণ্ডা বাতাসে কপালের উপর আছড়ে পড়া চুলগুলোকে এক ঝটকায় সরিয়ে দিয়ে ঝোলা থেকে বের করে সে একটি হারমোনিকা। অদ্ভুত মায়াবী এক সুরে সে বাজানো শুরু করল…এমন সুর এখানে আগে কেউ শোনেনি। টানা সাত মিনিট ধরে বাতাসের ছন্দের তালে তালে বাজল সে সুর। সুর থেমে যাওয়ার সাথে সাথে সব প্রহরীরা ঝটকা দিয়ে উঠে দাঁড়াল, আদ্রিতা নিজেও। জীবনে প্রথমবারের মত বোধহয় তারা একটানা সাত মিনিট ধরে অনুভূতিটি উপভোগ করতে পেরেছে- যার নাম আনন্দ!

 

দশ মিনিট পর।

আদ্রিতার আপ্যায়ন কক্ষ।

আদ্রিতাঃ তুমি কে?

ছেলেঃ আমার পরিচয়টা আসলে তেমন গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার নয়।

–    তা কী করে হয়? আমরা কখনও এত দীর্ঘ সময় ধরে বিষণ্নতা থেকে মুক্তি পাইনি! তুমি যখন হারমোনিকা বাজাচ্ছিলে আমরা সব বিষণ্নতা ভুলে গিয়েছিলাম! তুমি কে তা জানতে হবে না?

–    তাহলে তো বলতে হয় তোমার আগ্রহ আমাকে নিয়ে না, আমার হারমোনিকাকে নিয়ে!

–    আবার একটু বাজাবে?

–    বিষণ্নতা খুব কষ্টকর বুঝি?

–    তুমি এর কী বুঝবে!

–    একটু হাসবে?

–    কেন?

–    তোমার হাসি দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে।

–    হাসি যে আসে না!

–    তবে আমি হাসাই?

 

সেই রাতে ছেলেটি আদ্রিতাকে শোনায় অদ্ভুত এক সুর…সে সুরে পাহাড় পর্যন্ত কেঁপে ওঠে। চাঁদের বুড়ি চরকা কাটা বাদ দিয়ে তন্ময় হয়ে শোনে। আর শোনে আদ্রিতা। শুনতে শুনতে তার মনে হয় এক দানবের যেন মৃত্যু ঘটছে…পৃথিবীতে যেন অপার্থিব সৌন্দর্য নেমে এসেছে, যাকে ধ্বংস করার ক্ষমতা কারো নেই।

হারমোনিকা নিরব হওয়ার পর সে অনুভব করে, তার অস্বাভাবিকতা কেটে গেছে। বিষণ্নতা তাকে ছেড়ে গেছে…

বাম হাতে হারমোনিকা নিয়ে ডান হাতটা দিয়ে আদ্রিতার ডান হাতটা স্পর্শ করে ছেলেটি। “ছোটবেলায় এক অপ্সরীকে স্বপ্নে দেখেছিলাম, বিধাতা কেন দেখিয়েছিলেন জানি না, কিন্তু সে অপ্সরীকে দেখার পর আমি পাগল হয়ে গিয়েছিলাম প্রায়। এক জাদুকর তখন আমাকে এই হারমোনিকা দেয় আর মানুষকে হতাশা থেকে মুক্ত করার কিছু কৌশল শিখিয়ে দেয়। আর বলে যে আমি যদি মানুষকে মুক্ত করতে থাকি, তবে এই হারমোনিকা আমাকে পৌঁছে দেবে সে অপ্সরীর কাছে। আজ আমি পৌঁছে গিয়েছি!”

আদ্রিতার চোখের দিকে তাকাল সে সরাসরি, “আমি ইচ্ছা করলে তোমার শহরের সব মানুষকে এমনভাবে মুক্ত করে দিতে পারি। যদি করি, তুমি কি আমার হবে অপ্সরী?”

চোখের পলক না ফেলে জবাব দিল আদ্রিতা, “কথা দিচ্ছি, তোমারই হব”।

ছেলেটির মুখে এবার হাসি ফুটলো, “তোমার চোখ মিথ্যে বলছে না!”

 

পরদিন সকালে পুরো হ্যামেলিনবাসী জড় হল ছেলেটির কাছে, আর ছেলেটি বাজানো শুরু করল তার হারমোনিকা…সেই অদ্ভুত সুরে…বাজাচ্ছে…বাজাচ্ছে…বাতাস নেচে উঠলো…সমুদ্রের ঢেউগুলো সুরের সাথে নিজেদের ছন্দ মিলিয়ে নিল…বিমোহিত সুরে শহরবাসী মাতাল হয়ে গেল!

অসম্ভব দ্রুতলয়ের একটি টান সম্পন্ন করে অবশেষে হারমোনিকা থামলো! সকল শ্রোতা কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে যাওয়ার পর আবিষ্কার করল,তারা ভালো হয়ে গিয়েছে! বিষণ্নতা আর নেই, আনন্দের ব্যাপারগুলোতে ঠিকমতই আনন্দিত হতে পারছে তারা!

 

জনসমুদ্র পাড়ি দিয়ে আদ্রিতার বাসভবনে পৌঁছাতে একটু দেরিই হয়ে গেল ছেলেটির।

হাসিমুখে আদ্রিতা অভিবাদন জানালো তাকে, কিন্তু একা নয়, সাথে একজন সম্ভ্রান্ত সুদর্শন পুরুষ।

আদ্রিতা শুরু করল,“অসাধারণ কাজ করেছ। শহরবাসী আজ মুক্ত। এখন তোমার পুরস্কার বুঝে নাও। শহরের সবচেয়ে আকর্ষণীয় কিছু মেয়ে রেখেছি তোমার জন্য!”

ছেলেটির মনে হল তার হারমোনিকাটি কেউ ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করল যেন! “মানে?তুমি তো কাল কথা দিয়েছিলে সবাইকে মুক্ত করে দিলে তুমি আমার হবে!”

হাসলো আদ্রিতা। এই হাসিটাও অপূর্ব, কিন্তু এর মধ্যে পৈশাচিকতার একটা ছাপ আছে। “ওটা কালকে বলেছিলাম। সময়ে সব বদলে যায়,তাইনা? শহরের সম্ভ্রান্ত বলিষ্ঠ কত যুবক আছে,তাদের ছেড়ে তোমার দিকে তাকায় কে?”

ছেলেটির মনে হল,তার হারমোনিকাটি কেউ ভেঙে ফেলছে…“কিন্তু তোমার চোখ তো গতকাল মিথ্যে বলেনি!”

হাসিমুখে জবাব এল, “বলেছিল,কিন্তু ভালোবাসা তোমার চোখে ছানি ফেলে দিয়েছিল বোকা ছেলে! যা দিচ্ছি নিলে নাও, নইলে কেটে পড়।”

 

শক্ত করে হারমোনিকাটিকে আঁকড়ে ধরে বেরিয়ে আসে লম্বা চুলের ছেলেটি। একটা গোলাপ গাছ থেকে একটা লাল গোলাপ তুলে নেয় সে। সমুদ্রের পাড়ে বসে গোলাপটিকে সামনে রেখে সে শুরু করে বাজানো…এবার সম্পূর্ণ ভিন্ন সুরে। পৃথিবীতে কেউ কখনও এমন সুর শোনেনি। ভয়াবহ কম্পাংকে বাজতে থাকে সে সুর…  সবাইকে সুখী করে অসুখী হওয়া এক ছেলের অভিমান কিংবা কষ্টের ঠোঁট চেপে বসে ধাতুর উপর, সে থামে না, বাজাতেই থাকে। বাতাসের গতিপথে এবার গোলমাল লেগে যায়, ঢেউগুলো উন্মত্ত হয়ে পড়ে, হ্যামেলিনের সকল লাল গোলাপ গাছ আতঙ্কে জড়সড় হয়ে যায়।

 

দেখতে দেখতে ছেলেটির ঠোঁট কেটে যায়,সে তবুও থামে না, বরং আরো দ্রুত বাজাতে থাকে…রক্ত ছিটকে বেরিয়ে আসে একসময় তার মুখ থেকে…রক্তাক্ত মুখ থেকে বের হওয়া রক্ত পড়ে সামনে থাকা লাল গোলাপটির ওপর। অবাক হয়ে ছেলেটি লক্ষ্য করে, তার রক্ত ওই লাল গোলাপটির তুলনায় অনেক অনেক বেশি লাল! তীব্র সুরের ডানায় ভর করে এ খবর পৌঁছে যায় সব গোলাপ গাছের কাছে…হ্যামেলিনের সব লাল গোলাপ গাছ এ দৃশ্য দেখে লজ্জা পায়। ছেলেটি বাজাতে থাকে, রক্ত ঝরতে থাকে সস্তা তরলের মত, সে ধীরে ধীরে সমুদ্রের দিকে হাঁটতে থাকে… একসময় ডাঙার কেউ আর সে সুর শুনতে পায় না।

 

পরদিন থেকে হ্যামেলিন শহরে আর কখনও লাল গোলাপ ফোটেনি।

( রচনাকালঃ ০১/০১/২০১২ )

ইতস্তত বিপ্লবী সম্পর্কে

যদি কখনো আমায় মনে পড়ে যায়,খোলো দুয়ার আকাশের-আমি তারাময়!
এই লেখাটি পোস্ট করা হয়েছে গল্প, সাহিত্য-এ এবং ট্যাগ হয়েছে স্থায়ী লিংক বুকমার্ক করুন।

22 Responses to রূপকথাঃ হ্যামেলিনের হারমোনিকা

  1. ফিনিক্স বলেছেনঃ

    এইরকম গল্প বোধহয় চালু রাখা যায়। কারণটা এর পঠন সংখ্যা দেখলেই পরিষ্কার হয়ে যাবার কথা। আমি আর বেশি কিছু বলবো না। 🙂

    • ইতস্তত বিপ্লবী বলেছেনঃ

      ইউ সে বেস্ট হোয়েন ইউ সে নাথিং অ্যাট অল, আপু! :love: 😛

      রূপকথা সবাই ভালোবাসে, কারণটা বোধহয় এটা, গল্পটা নয়!
      আমি আমার নিজের শান্তির জন্য লিখি, তাই কেউ না পড়লেও ইচ্ছা থাকলে বোধহয় লেখা বের হবে! 🙂

  2. স্বপ্ন বিলাস বলেছেনঃ

    চমৎকার একটা গল্প! একটানা পড়ে শেষ করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম।
    খুব সুন্দর!

    • ইতস্তত বিপ্লবী বলেছেনঃ

      ধন্যবাদ ভাইয়া, আপনার কাছে যেহেতু খারাপ লাগে নাই, এটা আমার জন্য অনেক বিশাল কিছু!
      পরে এরকম আরো কিছু লিখার ইচ্ছাটা প্রেরণা পেল! 😀

  3. বোহেমিয়ান বলেছেনঃ

    চমৎকার গল্প ভাইয়া
    পিচ্চিকালের গল্পের রোমান্টিক ভার্সন! 😀

  4. সামিরা বলেছেনঃ

    সুন্দর হয়েছে! 🙂
    আরো পড়তে চাই। 😀

  5. নূরবাহার ঈয়াশা বলেছেনঃ

    অসাধারণ! এতদিন দেখি নাই কেন!!

  6. মাশুদুল হক বলেছেনঃ

    অসাধারণ গল্প ভাইয়া, শেষ করেছেন দারুন মুগ্ধতায়

  7. নিলয় বলেছেনঃ

    দারুণ হয়েছে! পঠন সংখ্যা দেখে বিন্দুমাত্র আশ্চর্য হইনি!
    নিয়মিত লিখবেন 🙂

  8. নূহা চৌধুরী বলেছেনঃ

    অসাধারণ লাগলো , একটানে পড়লাম , আরও পড়তে চাই 🙂

  9. অনাবিল বলেছেনঃ

    আগেই পড়েছি, মন্তব্য করা হয়নি।

    খুব চমৎকার লিখেছেন…… 🙂
    যাই, আপনার বাকি লেখাগুলো পড়ে আসি…… 🙂

    • ইতস্তত বিপ্লবী বলেছেনঃ

      আপনার মন্তব্যটাও আগেই পড়েছি, কেন জানি উত্তর দেওয়া হয়নি। আপনারা দু একজন এখনও পড়েন বলেই ফিরে আসা 😀

  10. Kamrul Hasan Hridoy বলেছেনঃ

    খুব ভালো লিখেছেন ভাইয়া ।গল্পের শুরু শেষ পর্যন্ত মনোযোগের এতোটুকও ভাঁটা পড়েনি http://shorob.com/wp-includes/images/smilies/icon_smile.gif চক্রক্রমিক হারে বেড়েছে এবং বাড়াটাই বোধহয় স্বাভাবিক http://shorob.com/wp-includes/images/smilies/icon_smile.gif তবে শেষটা অনবদ্য ছিল। শেষটায় ভেবেছিলাম ছেলেটা হয়তো এমন কোন সুর তুলবে যা আবার ফিরিয়ে আনবে হ্যামেলিনের আগের বিষণ্ণতা কিন্তু ”পরদিন থেকে হ্যামেলিন শহরে আর কখনও লাল গোলাপ ফোটেনি” ……………গল্পটাকে সত্যি পূর্ণতার চূড়ায় নিয়ে গেছে http://shorob.com/wp-includes/images/smilies/icon_biggrin.gif আশা করি আপনার এ চেষ্টা অব্যাহত থাকবে এবং ভবিষ্যতে আরো চমৎকার লেখা উপহার দেবেন http://shorob.com/wp-includes/images/smilies/icon_biggrin.gif

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।