প্রতিদিনের মত শহরের তীব্র যানজট পেরিয়ে বাস থেকে নামল প্রতীক। অফিস এসে গেছে। ১৯ তলা দীর্ঘ এই কর্পোরেট বিল্ডিংটাকে তার কখনই যুতসই মনে হয়নি। সিকিউরিটি পার হয়ে, যখন সে জোড়তলায় যাবার লিফটে উঠল, তখন তার অদ্ভুত একটা অনুভূতি হল। আগে এই লিফটে উঠতে তার খুবই বিরক্ত লাগত। অনেকটা ৬ নম্বর বাসের মত। প্রতি একতলা অন্তর অন্তর থামে। একজন উঠে তো দুইজন নামে। প্রতীকের মত উঁচুতলায় অফিস করা মানুষদের জন্য সময়টা তাই আরেকটু বেশি বিরক্তিকর হয়। কিন্তু আজকাল হঠাৎ করে প্রতীকের মনে হয়, এই লিফট যাত্রাটা খুব খারাপ না! সবাই কেমন অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করে কাঙ্ক্ষিত ফ্লোরে পৌছার জন্য। আবার কখনও কখনও লিফটের বিশাল আয়নায় নিজের পরিপাটি চেহারাও দেখা যায়। আর ৪ তলার রুবি আপু বা বিপুল ভাই, ৬ তলার রনি, ৮ তলার জয়, সারজানা বা সুমন ভাইয়ের সাথে দেখা হয়ে গেলে মজাটা আরও বেড়ে যায়। সবাই কেমন যেন ব্যস্ত আবার কেউই যেন ঠিক ব্যস্ত না। ব্যাপারটা চিন্তা করে প্রতীকের বেশ মজা লাগল। সাধারনত প্রতীক লিফটে উঠে একদম পেছনে গিয়ে দাঁড়ায়। এটা সে বাসে উঠার পরও করে থাকে। কারণ ধাক্কাধাক্কি প্রতীকের একদম পছন্দ নয়। প্রতীকের অবশ্য এমন অনেক কিছুই পছন্দ নয়। যেহেতু, আমাদের আজকের গল্পতে এদের কোন ভূমিকা নেই, তাই আপাতত এসবের বিস্তারিত বর্ণনা না দিয়ে, আমি মূল গল্পে চলে যাচ্ছি।
পাঠক, প্রতীক কিভাবে এই অফিসে চাকরীটা পেল সেই গল্পটাও আমি আরেকদিন বলব। তবে এটা ঠিক, ওর এই চাকরীটা পাওয়াতে সবচেয়ে খুশী হয়েছিল প্রিয়তি। প্রিয়তি আমদের আজকের গল্পের বেশ গুরুত্বপূর্ণ একজন চরিত্র। সচরাচর যা হয়, বুদ্ধিমান পাঠকেরা হয়তো ভেবে থাকবেন প্রিয়তি হল প্রতীকের গার্লফ্রেন্ড অথবা স্ত্রী। আসলে প্রিয়তি প্রতীকের অন্য কিছু একটা ছিল, যেটা প্রতীকেরও ঠিক জানা নেই। প্রতীক প্রায়ই প্রিয়তিকে বলত, তোমাকে গার্লফ্রেন্ড ভাবতে ভাল লাগেনা। শব্দটা কেমন যেন বিচ্ছিরি, বড্ড আধুনিক! আর তোমাকেতো আমি বিয়েও করিনি যে বউ ভাববো। কিন্তু তুমি সেই মানুষ, যাকে খুব ভালবাসি, যাকে আমার পাশে বসিয়ে রাখতে ইচ্ছে করে সবসময়। জানিনা একে কি বলে? প্রতীক বিরাট ধাঁধাঁয় পরে যেত। প্রিয়তি প্রতীকের এসব কথা শুনে ওকে কঠিন পাগল বলত।
বলত, তুমি বুঝাতে পারবানা, কিন্তু বাকি সব লোকই বুঝে!…
তারপর হাসত। প্রিয়তির হাসি খুব সুন্দর ছিল…
আরও সুন্দর ছিল প্রতীকের প্রতি ওর যত্নগুলো…
যাই হোক,আমি আবারও গল্প থেকে দূরে চলে আসচ্ছিলাম। এবার মনে হয় মূল গল্পে প্রবেশ করা আমার জন্য জরুরি হয়ে পড়েছে।
তো যেটা বলছিলাম, প্রতীক প্রথমে চাকরীটা নিতে চায়নি। এটার একটাই কারণ ছিল। আর তা হল, আগের অফিসে প্রতীক আর প্রিয়তি একসাথে কাজ করত। সপ্তাহে পাঁচদিন নয়টা-পাঁচটা অফিস, অফিস শেষে প্রিয়তিকে ওর বাসায় পৌঁছে দেয়া আর পরদিন সকাল ভোরে উঠে প্রিয়তিকে বাসা থেকে নিয়ে অফিসে যাওয়া। সব কিছু খুব সুন্দরভাবে কাটছিল প্রতীকের। এরমাঝে প্রতীকের সবচেয়ে ভাল লাগত লাঞ্চ টাইমটা। অফিসের পাশে গড়ে উঠা রেস্টুরেন্ট গুলোতে খেতে খেতে, দাম সহ মেন্যু মুখস্ত হয়ে গেল ওদের। অতঃপর খাবারের স্বাদও কমে যেতে লাগল। অতঃপর প্রিয়তি একসময় বাসা থেকে খাবার আনা শুরু করল। কিন্তু, কিসের কি? প্রতীক প্রিয়তির খাবার সকালে আসতে আসতেই শেষ করে ফেলত আর লাঞ্চ টাইমে ওকে নিয়ে বের হত। অবশ্য প্রিয়তিকে নিয়ে প্রতীকের এই খাবার অন্বেষণের স্বভাব বহু আগের। সেই ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় থেকে, যখন তারা বন্ধু ছিল, অথবা বন্ধুর চেয়ে গভীর সম্পর্কে জড়িয়েছে। পার্থক্য শুধু, তখন তারা যেত ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে, আর এখন অফিসের কাজের ফাঁকে। তারপর প্রতিদিন কাজ শেষে প্রতীক যখন প্রিয়তিকে বাসায় পৌঁছে দিত, তখন ওকে দেখলে মনে হত পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ। যেন অফিস শেষে রিক্সা যাত্রা খুবই সুখকর। প্রায়শই নতুন নতুন রাস্তায় রিক্সা চলা বন্ধ হত, আর প্রতীক ব্যাপারটা খুব এনজয় করত। কারণ এতে করে অফিস থেকে প্রিয়তির বাসায় যাবার সোজা আর অল্প পথটা, ধীরে ধীরে দীর্ঘ হতে লাগল। রিক্সাতে এই দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হওয়া জার্নিটাকে প্রতীকের খুব রোম্যান্টিক লাগত। তাই, প্রিয়তি যখন রিক্সাতে বসে যাবতীয় গল্পের ঝুড়ি খুলে বসত, প্রতীকের চোখে তখন রাজ্যের মুগ্ধতা লেগে থাকত। গল্প করতে করতে প্রিয়তি কখনও নিজেদের বিয়ের কথা তুলত, প্রতীকের মনে তখন অদ্ভুত সব চিন্তা আসত। সারাটা দিন একসাথে অফিস করে, একসাথে লাঞ্চ সেরে, সন্ধে বেলায় বাসায় পৌঁছে দিয়ে প্রতীকের মনে হত, সারাটা দিন তো একসাথেই থাকি, বিয়ের কি আর দরকার আছে! গত পাঁচ বছর ধরে চলে আসা এমন একসাথে থাকাটাকে ছেড়ে অন্য চাকরীতে যেতে তাই প্রতীক খুব আপত্তি জানিয়েছিল। কিন্তু, আমি তো আগেই বললাম, প্রিয়তি চেয়েছিল। কারণ চাকরীটা আসলেই খুব লোভনীয় ছিল আর প্রতীকেরও তা দরকার ছিল।
প্রতীক যেইদিন চাকরীটা ছেড়ে দিল, সেইদিন ওরা দুইজন অফিস শেষে অনেকক্ষণ একটা ক্যাফেতে বসে ছিল। হঠাৎ করেই প্রিয়তি বলে উঠল
– ইশ! তুমি সত্যি চাকরীটা ছেড়ে চলে যাচ্ছ?
– ছেড়েই তো দিলাম। কেন? তুমিইতো চাও…
– হুম। আমি তোমাকে অনেক মিস করব। তুমি যেভাবে আমার সব করে দিতে, সব সময় সাথে থাকতে…
– আমি তো এটা তোমাকে আগে থেকেই বলছিলাম।
– তো কি! আমি তোমাকে মিস করব আর সেটা বলতে পারবনা!
– আচ্ছা বাদ দাও। এখন বল আমার নতুন চাকরীর জন্য তুমি আজকে আমাকে কি গিফট দিবা?
– হুম। দাঁড়াও…
প্রতীক অবাক হয়ে দেখল, প্রিয়তি ওর জন্য অনেকগুলো বিস্কুটের প্যাকেট নিয়ে এসেছে। প্রথমবার চাকরীতে জয়েনের সময় প্রিয়তি প্রতীককে একটা হালকা নীল রঙের ব্র্যান্ডের শার্ট দিয়েছিল। গিফটটা এবার ব্র্যান্ডের শার্ট থেকে বিস্কুটে নেমে আসায় প্রতীক যখন অবাক, তখন প্রিয়তি বলল
– তোমাকে আমি চিনি। আমি না থাকলে তো ঠিক মত লাঞ্চ ও করবানা। তাই বিস্কুট কিনে দিলাম। শোন,সবসময় বিস্কুট কিনে তোমার ড্রয়ারে রেখে দিবা। অফিসে ক্ষুধা পেলে খাবা। বুঝস?
বিস্কুট প্রতীকের খুবই অপছন্দের। তাও যদি হত বাদাম অথবা ক্রীম দেয়া বিস্কুট। প্রতীক অবশ্য বাধ্য ছেলের মত বিস্কুটের প্যাকেটগুলো নিয়েছিল এবং তা অফিসে না নিয়ে বাসায় এনে রেখে দিয়েছিল। পরে যখন ব্যাপারটা প্রিয়তি জানতে পারে, এরপর থেকে আর কখনই প্রতীকের অফিসের ড্রয়ার বিস্কুট শুন্য থাকেনি।
এরপর অনেক সময় চলে গেছে। প্রতীকের তখনকার নতুন অফিসে ওর প্রায় আড়াই বছর কেটে গেছে। বিপুল ভাই, সুমন ভাই, রুবি আপু, রনি, সারজানা, জয়, প্রতীক আর অন্যান্য কলিগরা মিলে এখন বেশ ভালই কাটাচ্ছে অফিসের সময়গুলো। এইতো সেদিন, বিপুল ভাইয়ের প্রোমোশন হল। অফিসে কেউ কেউ হয়তো এতে খুশি না হলেও, প্রতীকদের সবাই খুব খুশি। নিশ্চিতভাবে বোঝাযাচ্ছিল সবার জন্য বড় রকমের একটা খাওয়া শীঘ্রই আসতেছে। সেই মাহেন্দ্রদিনের সকালে, সারজানা আর জয় মিলে একটা বিরাট কেক নিয়ে এল। প্রমোশন উদযাপন যে জন্মদিনের মত করে করা যায়, এটাই বোধহয় অফিসের সবাই খুব বিস্ময়ে প্রথমবারের মত দেখল। এমন সারপ্রাইজে সবচেয়ে অবাক হলেন বিপুল ভাই। সারজানার কানে কানে বলে আসলেন, মনে আছে তো তোমার? আজ থাইকো কিন্তু। আজকে তোমাদের সবাইকে বাফেট খাওয়াব।
সারজানা দেখল, বিপুল ভাই সব কয়টা দাঁত বের করে হাসছেন। যেন সবাইকে বাফেট খাওয়াতে পারাটা বিশাল আনন্দের একটা ব্যাপার।
বিপুল ভাই সারজানাকে বলল, আচ্ছা, প্রতীক কি তোমারে কিছু বলছে? ও কি আসবে?
কিছুই বলেনাই। কিন্তু মনে হয়না ও আসবে। আপনিতো সবই জানেন। সারজানার উত্তর।
হুম। ছেলেটা স্টুপিডই থেকে গেলো। কেন যে এত পাগলামি করে। আমি বুঝতে পারিনা।
পরিশেষঃ
প্রতীক ও বুঝেনা। ওকে বিপুল ভাইয়েরা কেন পাগল বলে। ও কি করেছে? ও শুধু বাইরে লাঞ্চ করেনা। কক্ষনও না। প্রতিটা দিন অফিসে লাঞ্চ করে শুধু বিস্কুট দিয়ে। এখানে চাকরী নেবার চারমাসের মাথায় প্রিয়তি প্রতীককে ছেড়ে চলে যায়। প্রিয়তির মনে অনেক কষ্ট ছিল, যেটা প্রতীক বুঝতে পারেনি। সেই কষ্টগুলোই প্রিয়তিকে তার জীবন নিয়ে সিরিয়াসলি ভাবিয়েছে। যেখানে প্রতীক তাকে ভালবাসা দিয়েছে ঠিকই, কিন্তু নির্ভরতা দিতে পারেনি। সময়ের আবর্তনে প্রতীকের ভূমিকা তাই নগণ্য হয়ে গেছে। কিন্তু প্রতীকের মত আবেগী মানুষেরা তা বুঝতে পারেনা। যেমন, প্রতীক আজও জানেনা প্রিয়তির সাথে ওর সম্পর্কটা কি ছিল। তাইতো সে বিস্কুট দিয়ে লাঞ্চ করে হারিয়ে যাওয়া প্রিয়তিকে খুঁজে পায়। অথচ তার জীবনে প্রিয়তির সংজ্ঞা প্রতীকের জানা নেই…
তোমায় ভালোবাসি
তাই ছায়ামেঘ আমি হবো যখন রোদ্দুরে তুমি হাঁটো।
থাক চোখভাঙ্গা হাসি
তাই নুনে ভরা ব্যথা জলটুকু তুমি আমার দু’চোখে বাটো।
সারা দিনমান যেখানেই তুমি
ঠিক সেখানেই থাকবো
যতটুকু ভালবাসা সম্ভব
ততটুকু ভালবাসবো
স্বপ্নেও ওম ওম হবো
হবো তোমার রেশমী চাদর
যখন ঘুমের রাজ্যে হাঁটো।
তোমায় ভালোবাসি
তাই ছায়ামেঘ আমি হবো যখন রোদ্দুরে তুমি হাঁটো। [বাপ্পা মজুমদার]
অসাধারণ গল্প! মনটা যদিও খারাপ হয়ে গেলো খুব।
কেন যে এই ধরণের সম্পর্কগুলোর সাথে মানুষের পরিচিত হতে হয়, যে সম্পর্ক থাকে স্পর্শের বাইরে।
:welcome:
ধন্যবাদ। অনুপ্রেরণা পেলাম।
তবে গল্পটা সত্যের ছায়া নিয়ে লেখা। তাই মন খারাপের জন্য আমি দায়ী নই। 🙁
ভালো লাগলো।
নিয়মিত পাবার আশায়
:welcome:
ধন্যবাদ…
চমৎকার গল্প। আরও চাই!
আর :welcome:
ঠিক জানি না প্রিয়তিরা কম নেই, খুব কমন। প্রতীক এর দেখা পাই নাই। হয়তবা পেতে চাইও না! তবে প্রতীক এর মত ছন্নছাড়ারা সুখে থাকুক!
প্রিয়তি বা প্রতীকের তুলনা আমি করতে চাইনা। তবে এটুকু জানি, প্রতীকের কাছে প্রিয়তি আগের মতই থেকে গেছে, অসংজ্ঞায়িত। তাই সে হয়ত প্রিয়তির প্রতি তার ভালবাসা টুকু কমতে দেয়নি… যদি কখনও আবার প্রিয়তি ফিরে আসে!
ভালো লেগেছে অনেক গল্পটা, কিন্তু মনটাও খারাপ হয়ে গেল খুব………
কে কী যে চায়!………
সুন্দর লেগেছে গল্পটা, আরো বতুন গল্প পড়ার আশায় থাকলাম।
সরবে স্বাগতম :welcome:
*নতুন :p
থ্যাঙ্ক ইউ স্বপ্ন বিলাস…
প্রথম কমেন্টের জন্য কৃতজ্ঞতা।
ভবিষ্যতে রম্য কোন লেখা দিয়ে পুষিয়ে দেবার চেষ্টা করব…. 😀
:welcome: 🙂
😀
এমন কোন সত্য ঘটনা আর না ঘটুক। লেখাটা সুন্দর! :welcome:
অবন্তিকাঃ আমিও তাই চাই…
হুম…
:welcome:
নারীর মন বলে কথা! 😛
:welcome:
মনটা খারাপ হয়ে গেলো পড়ে…… মানুষ কেনো ভালোবাসা ছেড়ে যায় ভেবে পাই না…………
স্বাগতম সরবে!
এমন চমৎকার আরো আরো লেখার অপেক্ষায়……
ধন্যবাদ